ভূমিকা: ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ কালপ্রবাহের উৎস সলিলে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬] অবগাহন করেছিলেন। তাই তোঁর কালের চেতনা তাঁর ব্যক্তিজীবনে এবং সাহিত্যিক জীবনে গভীরভাবে স্পন্দিত। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। জুলিয়াস সীজারের মতো বাংলা সাহিত্যে ‘তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।’ তাঁর এক-একটি কবিতা প্রকাশিত হতে লাগল ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়- আর সমগ্র বাঙালি শিহরিত হলো এক নতুন কবির আশ্চর্য কবিতার শক্তিতে। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর এক হাতে রণতূর্য’ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন বিদ্রোহী কবি। তাঁর অনেক কবিতা-প্রবন্ধে ব্রিটিশ বিরোধী শাসনের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।

কাজী নজরুল ইসলামের অধিকাংশ কবিতা-প্রবন্ধের মূলসুর ঝংকৃত হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী শাসনকে কেন্দ্র করে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়াও অসংখ্য কবিতায় বিদ্রোহের প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর অসংখ্য গদ্য রচনা, কবিতায়, গানে তাঁর এ বিদ্রোহীভাব প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর এ বিদ্রোহ সত্তা বুঝতে হলে তাঁর কথা এবং রচনা থেকে কিছু ভাব উদ্ধৃত করা যায়। যেমন-

(ক) “মহামারী, মারীভয়, ধ্বংস আমাদের উল্লাস, রক্ত আমাদের তিলক, রৌদ্র আমাদের করুণা। এরই মাঝে আমাদের নবসৃষ্টির অভিনব তপস্যা শুরু হবে। এস আমার সূর্যতাপস তরুণের দল। সান্ধ্যা শ্মশান আর গোরস্থান আমাদের সান্ধ্যা সম্মিলনী, আলেয়া আমাদের সান্ধ্যপ্রদীপ, মড়াকান্না আর পেচকশিবাদির রব আমাদের মঙ্গল হুলুধ্বনি। মরীচিকা আমাদের লক্ষ্য, আঘাত আমাদের আদর, মার আমাদের সোহাগ, সর্বনাশ আমাদের স্নেহ, বজ্র-মার আমাদের আলিঙ্গন। উল্কা আমাদের মালাখসা ফুল, সাইক্লোন আমাদের প্রিয়ার এলোকেশ। সূর্যকুণ্ড আমাদের স্নানাগার, অনন্ত নরক-কুণ্ড। এই অমঙ্গল, অভিশাপ আর শনির জ্বালানো রুদ্র চুল্লির মধ্যে বসে তোমাদের নব সৃষ্টির সাধনা করতে হবে। তোমাদের এই রুদ্র তপস্যার প্রভাবে সকল নরকাগ্নি ফুল হয়ে ফুটে উঠবে।… এস আমার অভিনব, তরুণ তপস্বীর দল। তোমাদের ধ্বংসে আহ্বান করছি।”

(খ) “আপনাকে চেন। বিদ্রোহের মত বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার তবে নিদ্রিত শিব জাগবেই, কল্যাণ আসবেই। লাথির মত লাথি যদি মারতে পার, তাহলে ভগবানও তা বুকে করে রাখবে। ভৃগুর মত বিদ্রোহ হও, ভগবানও তোমার পায়ের ধুলো নেবে। কাউকে মেনো না, কোনো ভয়ে ভীত হয়ো না বিদ্রোহী। ছুটাও অশ্ব, চালাও রথ, হানো অগ্নিবাণ, বাজাও দামামা দুন্দভি।… বল, আমিই নতুন করে জগৎ সৃষ্টি করব।”

কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বাঁশী’ ও ‘ভাঙার গান’ কাব্যগুলোকে একত্রে কাব্যত্রয়ী বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ কাব্যত্রয়ীর মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যের গণযাত্রা আরম্ভ হয়। নজরুলের’ অগ্নি-বীণা’ কাব্য প্রকাশের সময় তাঁর বয়স ছিল তেইশ বছর। তেইশ বছরের প্রাগজীবন আলোচনা করলে দেখা যায়, জন্মের পর প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠা এবং বহুবর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় বাধা-সংকটের ভিতর দিয়ে যৌবন অতিক্রম এবং পরাধীন দেশের শৃঙ্খল মোচনের জন্য যে প্রাণান্তরকর চেষ্টা এবং ইচ্ছা যুগপৎভাবে কাজ করেছিল- যা তাকে অনিবার্যভাবে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। ব্রিটিশ সরকারের অব্যাহত শোষণ, অত্যাচারের এবং সামাজিক অবক্ষয় ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে মানব মুক্তির তীব্র বাসনা জেগে ওঠে নজরুলের মনে। তিনি দেশকালের সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে দুঃশাসন অপশাসনকে ডিঙিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উচ্চারণ করলেন-

“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন!”
কিংবা,
“মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।”

‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’ কবিতায় হিন্দু পুরাণের দেবীকে আহবান করা হয়েছে অত্যাচারীদের নাশ করার জন্য। এ কবিতায়ই ঘোষিত হয়েছে দানব শক্তিকে পরাজিত করার মূলমন্ত্র:

“ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর
সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।”

‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’ রচিত হয়েছিল প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে অসহযোগ ও খেলাফত, তথা স্বদেশী আন্দোলনের নিদারুণ চিত্ত বিক্ষোভের দিনে। এ চিত্ত বিক্ষোভের মূলে কাজ করেছিল নির্যাতিতা বন্দিনী দেশমাতার লাঞ্ছনা অপমানের সদা জাগ্রত স্মৃতি ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, আর সর্বব্যাপী নিঃস্বতা ও অসহায়তার বোধ। বিদেশির তৈরি কারা প্রাচীর ও স্বদেশি সমাজের অচলায়তন সেদিন জাতির সকল আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুক্তি পাগল ব্যাকুল জাতি সেদিন দেহের শিকল ও মনের শিকল দুই শিকলের বাঁধনে ছটফট করে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল। সেই লগ্নেই জাতির প্রাণ বেদনার তিক্ত স্মৃতি নিয়ে বিশ্ব মানবতার চির অসম্মানের দুঃস্বপ্ন নিয়ে ‘অগ্নি-বীণার’ আগুন, ‘বিষের বাঁশির’ বিষ ও ‘ভাঙার গানের’ ক্ষ্যাপামির খোরাক এখানেই জুটেছিল। আর এ বিশেষ কারণেই দেখা যায় ‘বিদ্রোহী’ বিশেষণটি নজরুলের একেবারে কণ্ঠভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘অগ্নি-বীণা’র অগ্নিগর্ভ বাণীর ঝঙ্কার মিলিয়ে যেতে না যেতেই কবি ‘বিপ্লব বাঁশিতে’ সুর সংযোজন করলেন। ‘চিরতিক্ত প্রাণের’ গভীর থেকে উদগত ‘কণ্ঠছেঁড়া বিষ অভিশাপ তিক্ত’ গান রচনার সংকল্প থেকেই ‘বিশের বাঁশীর” সুর লহরীর উদ্ভব। কাব্যের ভূমিকায় এ সম্পর্কে কবি জানিয়েছেন:

“বিষের বাঁশীর বিষ যুগিয়েছেন আমার নিপীড়িতা দেশমাতা আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।”

তবে রাজরোষে পতিত ‘অগ্নি-বীণার’ পরিণাম দেখে তিনি যে এ কাব্যে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন, তা তাঁর ভূমিকার বক্তব্য থেকেই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তিনি বলেছিলেন:

“বিশেষ কারণে কয়েকটি কবিতা ও গান বাদ দিতে বাধ্য হলাম। কারণ ‘আইন’ রূপ-‘আয়ান ঘোষ’ যতক্ষণ তার বাঁশ উচিয়ে আছে, ততক্ষণ বাঁশিতে তথাকথিত ‘বিদ্রোহ’ রাধার নাম না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এ ‘ঘোষের পো’র বাঁশ বাঁশীর চেয়ে অনেক শক্ত। বাঁশে ও বাঁশিতে বাঁশাবাঁশী লাগলে বাঁশীরই ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”

‘বিষের বাঁশীর’ অধিকাংশ কবিতা ও গান বিদ্রোহের উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত ও অস্থির। এ কবিতা ও গানগুলোর উদ্দীপন ভাব যুগিয়েছে পরাধীনতার জ্বালাবোধ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও স্বদেশের দুঃখ-বেদনার প্রতি গভীর সমবেদনাবোধ। পরাধীনতার অভিশাপের বিরুদ্ধে স্বদেশ প্রেমের নিজস্ব মূর্তি নির্মাণেই ‘বিষের বাঁশীর’ বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। ‘বিদ্রোহীর বাণী’ শীর্ষক কবিতায় নজরুল সে বিদ্রোহের স্বরূপ নির্ণয় করেই যেন বলেছেন-

“যেথায় মিথ্যা, ভণ্ডামি ভাই করব সেথায় বিদ্রোহ।”

কবির বিদ্রোহের লক্ষ্য কি তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন-

“আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ।” এ স্বাধীনতার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষাই প্রবল উত্তাল হয়ে উঠেছে বিভিন্ন কবিতা ও গানে। ‘বিদ্রোহীর বাণী’ কবিতাটি ছাড়া ‘সেবক’, ‘জাগৃতি’, ‘অভিশাপ’, ‘মুক্ত পিঞ্জর’ কবিতায় কবি বিদ্রোহীর অন্তর্লোকের সন্ধান পাওয়া যাই। যেমন-

“মুখে বলিলাম তবু ‘বন্ধু। আর দেরি নাই, যাবে রসাতলে
পাষাণ- প্রাচীর-ঘেরা ঐ দৈত্যাগারে,
আসে কাল রক্ত-অশ্বে চড়ি হের দুরন্ত দুর্বার।”

‘সেবক’ কবিতায় কবি আদর্শ দেশ সেবকের অপরূপ মহিমান্বিত মূর্তিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। চোখে তাঁর ‘জয় সত্যম, মন্ত্রশিখা’, তাঁর বজ্র হাতের ঘায় ‘ত্রিশ কোটি মানুষের জিন্দানে’র ভিত্তি নড়ে ওঠে। এ মূর্তির পেছনে অসহযোগ আন্দোলনের নেতা গান্ধীর ছায়াপাত স্পষ্ট।

‘জাগৃতি’ কবিতায় কবি দেশমাতার ‘ছিন্নমস্তক’ কালীরূপ এবং কল্যাণী মাতৃমূর্তি দুর্গারূপ দুই রূপের কল্পনার মধ্য দিয়ে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রূপেরই যেন ছবি এঁকে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াস পেয়েছেন। ‘অভিশাপ’ কবিতার বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ধূমকেতু’ কবিতারই সুরের অনুরণন লক্ষ করা যায়। যেমন-

“আমি বিধির বিধান ভাঙিয়াছি, আমি এমনি শক্তিমান!
মম চরণের তলে, মরণের মার খেয়ে মরে ভগবান।”

‘বিষের বাঁশী’র প্রধান সম্পদ এর গানগুলো- এখানেও ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের স্পষ্ট প্রকাশ ফুটে উঠেছে। কোথাও তিনি নব জাগরণের নকীব রূপে আমাদের ‘অভয়মন্ত্র’ শুনিয়েছেন। বজ্র বিষাণে মহা দুর্জয় মহা-আহবান বাজিয়ে জাতির আত্ম শক্তির উদ্বোধন কামনা করেছেন, কোথাও বা ‘তুর্য-নিনাদ’ তুলে দুর্যোগ রাত্রির শেষে নব যুগের স্বাধীন মুক্ত জীবনের আহবান করেছেন। ‘বন্দিবন্দনা’ ‘বন্দনা-গান’, ‘মুক্তি সেবকের গান’, ‘শিকল পরার গান’, ‘মুক্ত বন্দী’ এ পাঁচটি গানে উদ্দীপন ভাব যুগিয়েছে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কারাবরণের স্মৃতি। বক্তব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে কবিতাগুলো অসাধারণ হয়ে উঠেছে। যেমন-

“এই শিকল পরার ছল মোদের এই শিকল পরা ছল।

এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।।

তোদের বন্ধ করার আসা মোদের বন্দী হতে নয়,

ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন ভয়।

এই বাঁধন প’রেই বাঁধন ভয়কে করবো মোরা জয়।।”

(শিকল-পরার গান)

‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ নজরুলের একটি শ্রেষ্ঠ জাগরণী গীতি। ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও গভীর দেশাত্মবোধের মন্ত্র বললে অত্যুক্তি হয় না। স্বাধীনতা সংগ্রামের মরণপণ আকাঙ্ক্ষা ও ইতিহাস- নির্দেশক অমোঘ, নির্মম নির্দেশ বাণী শুধু কবির লেখনীসম্ভূত নয়, এ যেন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত ইতিহাস চেতনার কাব্যিক রূপায়ণ।

স্বদেশ ও স্বজাতির যে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটির জন্ম, সেখানে শুধু বক্তব্যে নয়, নামকরণেও তার ছায়াপাত অনিবার্য। তাই কবিতায় রাজনৈতিক দুর্যোগের অনুষঙ্গরূপে আসে দুর্গমগিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার ইত্যাদির চিত্রকল্প। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দুর্যোগ পথভ্রান্তি ও জনসাধারণের দোদুল্যমানতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে-‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ’ ইত্যাদি ছত্রে। কবিতার সূচনায় জাতিকে সাবধান করার ইঙ্গিত, আর পরবর্তী অংশে আছে সর্ব সংস্কারমুক্ত নবযৌবনকে আহ্বান স্বদেশ ও স্বজাতির সংকটক্ষণে নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য-‘কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।’ সমস্ত বিভেদ বিচ্ছিন্নতা, বিভ্রান্তিমনস্কতা, চক্রান্ত ইত্যাদি উত্তীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার স্বর্ণ উপকূলে উপনীত করানো অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্য। ফলে কাণ্ডারীকে স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীর অত্যাচারে জাতীয় জীবন অত্যাচারিত, রক্তাক্ত বেদনায় দীর্ণ। নজরুল ইসলামের ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি দেশাত্মবোধের জ্বালাময়ী অগ্নি স্রোতের প্রবাহ হলেও, স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিকদলের প্রেরণামূলক রণসংগীত হলেও কবিতাটি রূপকল্পে, শব্দে, ছন্দে বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম প্রেরণাদাত্রী কবিতা। ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ যেন পীড়িত, বঞ্চিত, পরাধীন মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাওয়ার গান।

পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি কলম ধরেছিলেন। শুধু কলম চালিয়েই সন্তুষ্ট না থেকে কবি পত্রিকা সম্পাদনায়ও হাত দিয়েছিলেন। তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ব্রিটিশবিরোধী নিবন্ধ প্রকাশের অভিযোগে কবিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি ‘ধূমকেতু মামলায়’ অভিযুক্ত কবি আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে দাখিল করার জন্য যে লিখিত বক্তব্য তৈরি করেছিলেন তাই ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন পুস্তকাকারেও এর দুটি সংস্করণ বেরিয়েছিল।

বিদ্রোহী কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাজদ্রোহের। এ কারণে তাঁকে কারারুদ্ধ করে বিচারিক আদালতে হাজির করা হয়েছিল। কবি নির্ভীক চিত্তে তাঁর বক্তব্য লিখিতভাবে আদালতে পেশ করেন। তিনি নিজেকে সত্যের পূজারী এবং সরকার ও তার আদালতের কর্মচারীদের অসত্যের প্রতীক বলে এই জবানবন্দীতে আখ্যায়িত করেছেন। কবি ব্রিটিশ রাজশক্তিকে অত্যাচারী দখলদার শক্তি বলে মনে করতেন। তাই তাদের আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকে তিনি পরোয়া করতেন না। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য যাকে রাজশক্তি রাজদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করেছিল তাকে কবি ভগবানের বাণী হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, “আমার বাণী সত্যের প্রবেশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে; কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজবিচারে দণ্ডিত হতে পারে; কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্যস্বরূপী।” কবির এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী অকুতোভয় চেতনার সম্যক পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে। এ বক্তব্য তার আপসহীনতার পরিচায়ক।

কবি ছিলেন সত্যের পূজারী। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি আপসহীন আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন “সত্য- স্বয়ং প্রকাশ”। সত্যকে কোন প্রবল প্রতাপশালী রাজশক্তি মিথ্যার বেড়াজালে ঢাকতে পারে না। সত্যকে কোন রক্তআঁখি রাজশক্তি নিরোধ করতে সক্ষম হবে না। কবি সেই চিরন্তন স্বয়ং প্রকাশের বীণা হাতে যুদ্ধে নেমেছিলেন। তিনি নিজেকে “ভগবানের হাতের বীণা” বলে দাবি করেছেন। কবি মনে করতেন, এ কথা ধ্রুব সত্য যে, সত্য আছে- ভগবান আছেন। সত্য ও ভগবান চিরন্তন। এই দুই শক্তি চিরকাল থাকবে। যারা ভগবানকে উপেক্ষা করে সত্যকে বিনাশ করতে চায় তাদের অহঙ্কার একদিন ধ্বংস হবেই। কেননা সত্য ও ভগবান অবিনশ্বর ও নিত্য। এদেরকে কেউ ধ্বংস করতে পারে না। যে রক্তচক্ষু রাজশক্তি এদেরকে উপেক্ষা করার ঔদ্ধত্য দেখায় কালের আবর্তনে একদিন এরাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরা অনিত্য ও নশ্বর। কবি সবসময় নিপীড়িত প্রজাকুলের পক্ষে। রাজশক্তির রক্তচক্ষুকে তিনি ভয় পান না। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী কবির কাছে দেশ ও দেশের মানুষই বড়ো। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠাই তাঁর ধর্ম। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর অঙ্গীকার। সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের কাছে মানবকল্যাণ ও ন্যায়সুন্দরের বাণী ছিল মহান কর্তব্য ও আদর্শ। তাঁদের মতো কবি নিজেও সত্যের হাতের বীণা। এ বীণা বাজানোর দায়িত্ব স্বয়ং ভগবান তাঁকে দিয়েছেন। এ বীণা রুদ্ধ করার সাধ্য কারো নেই। কেউ গায়ের জোরে কবির কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে পারবে না।

যুগে যুগে তিমিরবিদারী সূর্যের মতো স্বাধীনতাকামী মহাপুরুষের জন্ম হয়েছে। তাঁরা গানে, কবিতায়, আবিষ্কার উদ্ভাবনে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছেন। শাসকের ও শোষকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ন্যায় ও সত্য সাধনার শক্তিতে তারা শোষিত বঞ্চিত মানুষকে রক্ষা করেছেন। রাজশক্তির কোপানলে পড়ে এঁদের অনেকেই অকাতরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু তাঁদের মহৎ কর্ম থেমে যায়নি। অন্যেরা নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে তাঁদের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কবি যা করতে গিয়ে বন্দি হয়েছেন, যা বলতে গিয়ে তাঁর বাকরুদ্ধ করা হয়েছে, তাঁর অবর্তমানে অন্যরা তা করবে এবং বলবে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।

কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ কবি আত্মচেতনার শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন। তিনি ছিলেন পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই যাকে তিনি অন্যায় বলে বুঝেছেন তাকে অন্যায় বলেছেন, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছেন। তিনি কাউকে তোষামোদ করেননি, প্রশংসা ও প্রসাদের লোভে কারও পো ধরেননি। তিনি কেবল শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেননি- সমাজ, জাতি ও দেশের সকল প্রকার অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তাঁর বজ্রকণ্ঠ। বিদ্রূপ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত অপরিমেয় পরিমাণে বর্ষিত হলেও কোনকিছুর ভয়ে তিনি পিছপা হননি। লোভের বশবর্তী হয়ে আত্মচেতনাকে কবি কারও কাছে বিক্রি করেননি। তিনি তাঁর দেশ ও জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতার কামনায় স্থিরচিত্ত থেকেছেন। কোনো লোভ ও ভয় তাঁকে টলাতে পারেনি। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নিবন্ধে তিনি অমৃতের গান গেয়েছেন-
মুক্তির জয়ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছেন।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধে সময়ের দাবির যথার্থরূপ দিয়েছেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব এবং তাৎক্ষণিক অনুভূতি থেকে এসব কবিতা-প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এসব রচনায় তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছেন ব্রিটিশশাসনের অবসান- আর এ কারণে তাঁকে কারাবন্দি হতে হয়েছে- তবু তিনি তাঁর লেখা এবং মতামত থেকে দূরে সরে যাননি। ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন যে আসন্ন তা তিনি তাঁর রচনায় বারবার বলেছেন। তাঁর এ আশাবাদ যে অমূলক ছিল না- তা ১৯৪৭ সালেই প্রমাণ হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।