রবীন্দ্রযুগ এবং রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় সম্ভবতঃ কাজী নজরুল ইসলামই (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রীঃ) শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবি রূপে যে নামটি সমস্বরে উচ্চারিত হয়ে থাকে, সে নামটি অবশ্য নজরুল, যদিও এর যাথার্থয বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধকালে নজরুল সৈন্যদলে যােগদান করেন এবং এই অবস্থাতেই ১৯১৯ খ্রীঃ তাঁর ‘মুক্তি’ নামে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯২১ খ্রীঃ ‘বিজলী’ পত্রিকায় নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতাটি প্রকাশিত হবার পরই তিনি পাঠক মহলে প্রভূত সাড়া জাগাতে পেরেছিলেন। তদবধি তিনি নিজেও ‘বিদ্রোহী কবি’ রূপেই পরিচিত হয়ে আসছেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসবার পর থেকে বস্তুতঃ তিনি সাহিত্য ও সঙ্গীত সাধনাকেই জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করেছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গেও তার যােগ ছিল। রাজদ্রোহাত্মক কাব্য রচনার দায়ে তাঁকে রাজরােষেও পড়তে হয়েছে। নজরুলের জীবনের শেষার্ধ (১৯৪২- ১৯৭৬) বড়ই করুণ; এই সুদীর্ঘ সময় তিনি জীবন্মৃত অবস্থায় বর্তমান ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি লােকান্তরিত হন।
কাজী নজরুল তাঁর কাব্য-জীবনের গোড়ার দিকেই রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিজীবনে ও কাব্যে রবীন্দ্র প্রভাব থাকলেও তার কাব্যের প্রধান ধারাটি ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি একটা ধুমকেতুর মতাে আবির্ভূত হয়ে যেন প্রচলিত সমস্ত বিধি-বিধান ভেঙে চুরে দিতে চেয়েছেন। আবেগ ও উন্মাদনায় সঞ্চিত তিনি যুবজন-মনে এমন আলােড়ন সৃষ্টি করতে চান, যা প্রচলিত রাজশক্তি, সামাজিক কাঠামাে, আর্থনীতিক বুনিয়াদ সমস্ত কিছুকে আমূল পরিবর্তিত করে দেবে। বস্তুতঃ সমকালের রাজনৈতিক সামাজিক পরিবেশে এর যথার্থ উপযােগিতা ছিল বলেই সমকালের পাঠক সমাজ তার একান্ত অনুরাগী হয়ে ওঠে। নজরুলের স্বভাবজ কবি প্রতিভাও ছিল, কিন্তু তা যথাযথভাবে পরিশীলিত হয়ে উঠতে পারেনি বলেই তার কাব্য যুগাতিশায়ী হতে পারেনি, সাময়িকতার বাইরে তা অনেকটাই মূল্যহীন। এমন কি তাঁর রচিত অসংখ্য সঙ্গীত, যেগুলি একান্তভাবেই গীতিপ্রধান, সেখানেও তিনি যে পরিমাণে উচ্ছসিত হয়েছেন, তদনুপাতে গভীরতায় নিমজ্জিত হতে পারেন নি। ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন- “নজরুলের আবেগের মধ্যে তরুণের স্বপ্নাবেশ, ভাবাতিরঞ্জনের স্পর্শ প্রচুর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অপরিণতির নিদর্শন রাখিয়া গিয়াছে। তাহার প্রকৃতি ও প্রেম বিষয়ক কবিতার মধ্যে রূপবিহুলতা আছে, কিন্তু কোন গভীর সুর নাই। মনে হয় যে, এই জাতীয় কবিতায় তিনি ইন্দ্রিয়ানুভূতিবেদ্য রূপাস্বাদন অপেক্ষা গভীরতর কোন স্তরে অবতরণ করেন নাই।”
নজরুল প্রধানতঃ কবি, তবে গদ্য-রচনায়ও তিনি অকূপণ ছিলেন। গল্প উপন্যাসে তার কৃতিত্ব খুব উচ্চাঙ্গ না হলেও কবিস্বভাব তাতেও প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ফারসী ভাষা থেকে তিনি বেশ কিছু রুবাঈ’-এর অনুবাদ করেছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), ‘ব্যথার দান’ (গল্প ১৯২২), ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫), ‘রিক্তের বেদন’ (গল্প ১৯২৫), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬), ‘ফণীমনসা’ (১৯২৭), ‘বাঁধনহারা’ (উপন্যাস, ১৯২৭), ‘প্রলয়শিখা’ (১৯৩০), ‘শিউলিমালা’ (গল্প, ১৯৩১), ‘কুহেলিকা’ (উপন্যাস, ১৯৩৭), ‘মৃত্যুক্ষুধা’ (উপন্যাস) প্রভৃতি। কবি নজরুলের যথার্থ কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত রচনায়। তাঁর রচিত সঙ্গীতের সংখ্যা অসংখ্য। নিম্নোক্ত গ্রন্থগুলিতে তাঁর বহু সঙ্গীত সঙ্কলিত হয়েছে, সম্ভবতঃ এর বাইরেও রয়েছে অজস্র ও ‘দোলনচাপা’ (১৯২৩), ‘ছায়ানট’ (১৯২৪), ‘পুবের হাওয়া’ (১৯২৫), ‘সিন্ধু হিন্দোল’ (১৯২৭), ‘চক্রবাক’ (১৯২৯), ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ ও ‘বুলবুল’, ‘চোখের চাতক’, ‘বনগীতি’, ‘গীতিশতদল’ প্রভৃতি গীতিসঙ্কলন।
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে; বস্তুতঃ তাঁর সমগ্র কাব্য চেতনার মধ্যে বিদ্রোহই বরাবর সচেতনভাবে ধরা দিয়েছে। তার এই বিদ্রোহের পশ্চাতে দেশাত্মবােধের প্রেরণা ছিল নিশ্চিতই, কিন্তু তা-ই সব নয়। তার বিদ্রোহ যাবতীয় সামাজিক আর্থনীতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তার আবেগ উদ্বেল হয়ে উঠেছে যেখানে কোনপ্রকার ভেদবুদ্ধি দেখেছেন, তারি বিরুদ্ধে, তা’ রূপ পেয়েছে জাতপাতের বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে’ ধনী দরিদ্রের বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এমন কি তিনি বলেন, ‘আমি সাম্যের গান গাই। আমার চোখেতে পুরুষ নারীতে কোন ভেদাভেদ নাই।’ লক্ষণীয় এই, শুধু কাব্য-কবিতায় নয় বাস্তব জীবনেও নজরুল আপন বিশ্বাস অনুযায়ী পরিচয় দিয়েছেন, সম্ভবতঃ সমধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন শ্যামাসঙ্গীত রচনাতেও। তার পারিবারিক জীবনে-এর প্রতিফলন দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তিতে সমগ্র বিশ্ব জুড়েই যে মানবজাতির মনে একটা বিরাট মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল এবং সমকালে রাশিয়ায় যে একটা আমূল পরিবর্তিত সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল, তারি উদ্দীপনায় নজরুল দেশের যুবশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন তার কবিতার সাহায্যে, যদিও এ বিষয়ে এর আগে পথ কেটে রেখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সবুজের অভিযান’ কবিতায়। যাহােক, নজরুলের উদ্দীপনাময়ী বিদ্রোহাত্মক কবিতাগুলি যুবমানসে প্রবল প্রেরণা সঞ্চার করলেও তিনি রাজরােষে পতিত হন এবং তার ‘বিষের বাঁশী’, ‘অগ্নিবীণা, ‘সর্বহারা’ প্রভৃতি গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। নজরুলের কবিতায় মানবিকতার জয়গান ঘােষিত হলেও তা প্রচারধর্মিতার জন্যই সমসাময়িকতাকে অতিক্রম করতে পারেনি।
নজরুলের সহজাত কবি-প্রতিভা ছিল, কিন্তু কাব্য-রূপায়ণে তিনি ততােটা অবহিত হন নি। বলেই কাব্য-বিচারে অনেক সময় তিনি যথার্থ স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন নি। পরিমার্জনার ধৈর্য তার মধ্যে ছিল না বলেই রচনায় অনেক সময় শৈথিল্য দেখা দিয়েছে, সাধু শব্দ, গ্রাম্য শব্দ একাসনে স্থান পেয়েছে। তার কবি-স্বভাব বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু যথার্থই মন্তব্য করেছেন ঃ “অদম্য স্বতঃস্ফূর্ততা নজরুলের সাদৃশ্যে ধরা পড়ে—সেই কাঁচা, কড়া, উদ্দাম শক্তি, সেই চিন্তাহীন অনর্গলতা, কাব্যের কলকজার উপর সেই সহজ নিশ্চিত দখল, সেই উচ্ছঙ্খলতা, আতিশয্য, শৈথিল্য, সেই রসের ক্ষীণতা, রূপের হীনতা, রুচির স্বলন।”
শব্দ ব্যবহার বিষয়ে নজরুল একপ্রকার সহজ স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করতেন বলেই ভাব-অনুযায়ী শব্দ-প্রয়ােগে তিনি ছিলেন নিরঙ্কুশ। প্রয়ােজনীয় ক্ষেত্রে তিনি নির্দ্বিধায় প্রচুর আরবী, ফার্সী ও হিন্দী শব্দ যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি করেছেন তৎসম, তদ্ভব ও দেশি শব্দের ব্যবহার। ফলতঃ তার রচনারীতি প্রয়ােজনমতাে ওজস্বিতা এবং মাধুর্য লাভ করলেও তিনি সর্বত্র শব্দ ব্যবহারে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন নি। তার ফলে আবার অনেক সময় কবিতায় স্বচ্ছতা এবং সবলতা ক্ষুন্ন হয়েছে। ছন্দ-ব্যবহারেও নজরুলের ছিল অপরিসীম দক্ষতা। বিশেষতঃ চট্ুল ছন্দ-প্রয়ােগে তিনি যথেষ্ট বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
নজরুলের কবিত্বশক্তি ছিল সহজাত। কিন্তু সেই কবি-প্রতিভার যথার্থ বিকাশ বা পরিণতি ঘটে উঠতে পারেনি। তিনি নিজেকে বলেছেন ‘চিরকিশাের’, বস্তুতঃ তার কাব্যও সেই কৈশাের অতিক্রম করে যৌবনের ঘন-পিনদ্ধ বলিষ্ঠতায় কিংবা বার্ধক্যের শান্ত সমাহিত সৌন্দর্যে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। তিনি যেখানে আরম্ভ করেছেন, প্রায় সেখানেই তাঁর সমাপ্তি-তাতে বিকাশ নেই, পরিণতি নেই। বুদ্ধদেবের ভাষায়, “তার প্রতিভার প্রদীপে ধীশক্তির শুভ্র শিখা জ্বলেনি, যৌবনের তরলতা ঘন হলাে না কখনাে, জীবন-দর্শনের গভীরতা তাঁর কাব্যকে রূপলােক থেকে ভাবলােকে উত্তীর্ণ করলাে না।” হয়তাে বা মস্তিষ্কের গুরুতর পীড়াহেতু তার অকাল-স্তব্ধতাই এর জন্য দায়ী অথবা এই ছিল তাঁর কবি-স্বভাব।
কাব্যালােচনার ক্ষেত্রে নজরুলের কিছু কিছু ত্রুটি বা অপূর্ণতার কথা উল্লেখ করা হলেও অপর একটি ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্বের কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। তার মােট কবিতার সংখ্যা নিরুপণ করা সম্ভব নয়। তবে গজল, প্রেমসঙ্গীত এবং ইসলামী সঙ্গীত রচনায় যে তিনি তার কবিতা অপেক্ষা সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন, তা সন্দেহাতীত। যুগাবসানেও এই সঙ্গীতগুলিই তাকে অমরত্ব দান করবে।
Leave a comment