কাইকোবাদ (১২৮৭-‘৯০ খ্রিঃ):

বলবন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মহম্মদকে নিজের উত্তরসুরি হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর অকালমৃত্যুর ফলে তিনি কনিষ্ঠপুত্র বুগরা খাঁ’র কথা ভাবেন। কিন্তু বুগরা দিল্লির সিংহাসনের পরিবর্তে বাংলার শাসক-পদে থাকা বেশি পছন্দ করেন। এমতাবস্থায় বলবন মৃত্যুশয্যায় আমির ও মালিকদের ডেকে মহম্মদের পুত্র কাইখসরুকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। বলবনের মৃত্যুর পর দিল্লির কোতোয়াল ফব্রুদ্দিন-সহ অন্যান্য অভিজাতবর্গ বুগরা খাঁ’র পুত্র কাইকোবাদকে পরবর্তী বাদশা হিসেবে ঘোষণা করলে কাইখসরু নীরবে সরে দাঁড়ান।

কাইকোবাদ দিল্লির সিংহাসনে বসেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। কৈশোরে পিতামহ বলবনের কঠোর নিয়ন্ত্রণে তাঁর বিদ্যাচর্চা শুরু হয়। অস্ত্রবিদ্যা, অশ্বচালনা, তিরন্দাজি, খেলাধুলা, হস্তলিখন ইত্যাদি নানা বিভাগে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেন। তাই কাইকোবাদ যখন সিংহাসনে বসেন (১২৯০ খ্রিঃ) তখন তাঁর কাছ থেকে দেশবাসী অনেক কিছুই আশা করতে পারত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর চারিত্রিক রূপান্তর সব হিসাব গোলমাল করে দেয়। যে ব্যক্তি এতদিন পর্যন্ত কোনো সুন্দরী রমণীর মুখদর্শন কিংবা একফোঁটা সুরাপান করতে পেতেন না, তিনি অকস্মাৎ সুরা ও সাকিতে এত মত্ত হয়ে ওঠেন যে, তাঁর পদের মর্যাদা ও দায়িত্ববোধ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যান। এই সুযোগ নেন ক্ষমতালোভী তুর্কি মালিক মহম্মদ নিজামউদ্দিন।

সুরা-সাকি আর বিলাসব্যসনে আকণ্ঠ ডুবে থাকার জন্য কাইকোবাদ যমুনার অপর তীরে কিলখোরী নামক স্থানে এক সুদৃশ্য প্রাসাদ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। সুলতানের হয়ে শাসন পরিচালনা করতে থাকেন দিল্লির বৃদ্ধ কোতোয়াল ফরুদ্দিন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই ফব্রুদ্দিনের হাত থেকে ক্ষমতার দণ্ড সরে আসে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা জামাতা নিজামউদ্দিনের হাতে। ফরুদ্দিনের আড়ালে থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নিজামউদ্দিন ধীরে ধীরে দিল্লির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিজের হস্তগত করেন। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি নিজের অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ করেন। কাইখসরুর সমর্থক তুর্কি-মালিকদের যেমন—বাকসারিখ, হাসান বাসরি, খাজা খতির প্রমুখকে পদচ্যুত, বন্দি, হত্যা বা বিতাড়িত করেন। মোঙ্গলদের সাথে জোট বেঁধে সুলতানি দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ এনে তিনি কাইখসরুকেও হত্যা করেন। মুলতানের গভর্নর মালিক আলাউদ্দিন শেখ এবং বরণের গভর্নর নাসিরুদ্দিন তুজকি প্রমুখ অতিদক্ষ ও বিশ্বস্ত তুর্কি-মালিকদের অকারণে হত্যা করে তিনি দিল্লির প্রশাসনকে প্রতিভাহীন করে দেন। নিজামউদ্দিনের বাড়াবাড়িতে ক্ষুব্ধ ফকরুদ্দিন তাঁকে লোভসংবরণ করার পরামর্শও দেন। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী নিজামউদ্দিন একইভাবে অন্যায় পথে এগোতে থাকেন।

কাইকোবাদ যখন সিংহাসনে বসেন, সেই সময় তাঁর পিতা বুগরা খাঁ ‘‘সুলতান নাসিরুদ্দিন’ নাম নিয়ে লখনৌতিতে স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন। বাংলায় বসেই তিনি পুত্রের ব্যভিচার এবং সেই ফাঁকে তাকে নিমজ্জিত করার কাজে মালিক নিজামউদ্দিনের অপচেষ্টার সংবাদ পান। পুত্রকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে বুগরা খাঁ সসৈন্যে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। আমির খসরু লিখেছেন যে, বুগরা খাঁ’র লক্ষ্য ছিল দিল্লির মসনদ দখল করা। কিন্তু বারাণীর মতে, তিনি পুত্রকে পরামর্শ দ্বারা কর্তব্যমুখী করার জন্যই দিল্লির দিকে এসেছিলেন। যাই হোক, পিতা-পুত্রের সাক্ষাৎকারের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশেই সম্পন্ন হয়। বুগরা কাইকোবাদকে নানা সদুপদেশ দিয়ে বাংলায় ফিরে যান।

নিজামউদ্দিন কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার এবং অত্যাচার অপদার্থ সুলতান কাইকোবাদ মেনে নিলেও অন্যান্য তুর্কি-আমিররা নীরবে মেনে নিতে পারেননি। তাই সামান্য সুযোগ পাওয়া মাত্রই তাঁরা বিষপ্রয়োগে নিজামউদ্দিনকে হত্যা করেন। বারাণীর মতে, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে একজন ক্ষমতাগবী এবং ষড়যন্ত্রী মানুষের বিনাশ ঘটেছিল ঠিকই; কিন্তু একইসঙ্গে নিজামউদ্দিনের মতো দক্ষ প্রশাসকের অবর্তমানে দিল্লির প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল এবং দরবারি রাজনীতি উত্তাল হয়েছিল। এদিকে অত্যধিক মদ্যপান ও ব্যভিচারের ফলে কাইকোবাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে। এই সময় তিনি সামানা থেকে মালিক ফিরোজ খলজিকে এনে ‘আর্জ-ই-মামালিক’ পদে নিয়োগ করেন এবং ‘শায়েস্তা খাঁ’ উপাধি দিয়ে দিল্লির দরবারি রাজনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেন। ফিরোজের নেতৃত্বে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে ‘খলজি বিপ্লব’ সংঘটিত হয় এবং দিল্লি-সুলতানির কর্তৃত্ব তুর্কিদের পরিবর্তে খলজিবংশের হস্তগত হয়।