প্রশ্নঃ ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসের আলােকে কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা কর।

উত্তরঃ বাংলাদেশের প্রধান কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম সেলিনা হােসেন (জন্ম. ১৯৪৭)। তার সাহিত্যের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে বহমানকাল, রাষ্ট্র ও মানবজগৎ। তার উপন্যাসে রাজনৈতিক সময় বা আন্দোলন অধিকতর পরিপ্রেক্ষিত অর্জন করে। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় নতুন মাত্রা অর্জন করে। নারীর শাশ্বত দৃষ্টি, সনাতন আদর্শ বজায় থাকে তার লেখায়। এক্ষেত্রে তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির ঐতিহ্যের প্রতি দৃঢ় এবং দায়িত্বশীল। এমন প্রত্যয়ে গৌরবােজ্জ্বল পর্বগুলাে উন্মােচিত হয় কাহিনিগাত্রে; জাতীয় চরিত্র প্রতীকায়িত হয় আদর্শের আশ্রয় থেকে। এভাবে তার রচনাসম্ভার হয়ে উঠেছে অনবদ্য এবং অভিনব।

‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ (১৯৮৯) উপন্যাসে তেভাগা আন্দোলনের বিষয়াদি উপস্থাপিত হলেও এ উপন্যাসে জোতদারি প্রথায় কৃষকদের সার্বিক পরিস্থিতি উপস্থাপিত হয়েছে। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আসার পরেই ঘটে গেল পঞ্চাশের মন্বন্তর, অনাহারে মরতে লাগল হাজার হাজার মানুষ আর মুনাফালােভী জোতদার আর চোরাকারবারির দল সেই সুযােগে সর্বস্বান্ত করতে চাইল খেটে খাওয়া মানুষদের। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নাৎসীবাদের চূড়ান্ত পরাজয় ও দুনিয়াব্যাপী নতুন যুগের সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিতেই তেভাগার সূচনা। নিপীড়িত, অত্যাচারিত কৃষক সমাজের উপর জোতদারদের জোরজুলুম বন্ধ করার দাবি নিয়ে এসেছিল তেভাগা। সারা বছরের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে ধান কাটা, জোতদারদের খােলানে কাটা ধান বহন করা, ঝাড়াই মাড়াই করা আর গােলাভর্তি করে বেগার খেটে যৎসামান্য ধান নিয়ে নিজের ভরণপােষণ করাই ছিল চাষিদের কাজ। কিন্তু এ ক্ষোভের মেঘ পুঞ্জিভূত হতে হতে বিশাল আন্দোলনের আকার নেয় এবং স্লোগান ওঠে ধান কেটে ঘরে তােলাে এবং দখল রেখে চাষ করাে এবং ‘আধির বদলে তেভাগা চাই।’ অর্থাৎ মােট উৎপন্ন ফসলের দুভাগ পাবে চাষি এবং একভাগ পাবে জমির মালিক। এমনি করে প্রচলিত অন্যায় ব্যবস্থাকে গুড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে চলল মেহনতি মানুষের মিছিল এটাই তেভাগা আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে তখনাে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক সমাজ দূরেই ছিল, কারণ দেশ-বিভাজনের বিষবাষ্প তখনাে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ক্রমে ক্রমে ফাটল ধরল, মুসলিম কৃষকদের মধ্যে থেকেও তেভাগার ডাক আসতে লাগল। মানুষ বুঝতে শিখল মুসলমান জোতদার আর হিন্দু জোতদারদের মধ্যে যেমন পার্থক্য নেই তেমনি মুসলমান আর হিন্দু কৃষকের মধ্যেও কোনাে পার্থক্য নেই। ধর্মের গণ্ডিকে মানুষ সহজেই পেরিয়ে এসে বলল ‘দাড়ি টিকি ভাই ভাই, লড়াই এর ময়দানে জাতভেদ নাই।’ মূলত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ লাভের অধিকার থেকেই কৃষকসম্প্রদায় তেভাগা আন্দোলনের সূচনা করে। উল্লেখ্য- তেভাগা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সাঁওতালরা।

১৯২৯ সালে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে রেহাই পায়নি ভারতবর্ষ। সে ধাক্কা এসে লাগে কৃষকের মধ্যেও, ফসলের দাম যায় কমে। জোতদাররা এই বােঝা চাপাতে চাইল বর্গাচাষিদের ওপর। দাবি করলাে ফসলের তিনভাগের দু’ভাগ- বর্গাচাষিদের পক্ষে এ বােঝা বহন করা ছিল অসম্ভব। তারা প্রতিবাদ করলে জমি থেকে উচ্ছেদ করা শুরু হলাে। আকণ্ঠ নিমজ্জিত ঋণে নিমজ্জিত কৃষককুল খাজনার বােঝা বহনে অক্ষম হলে, জমিদারি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ক্রমবর্ধমান কৃষক অসন্তোষের চাপে ব্রিটিশ সরকার ভূমি-সংস্কারের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে। ১৯৩৮ সালের ৫ নভেম্বর ফজলুল হক মন্ত্রিসভা এই ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ কমিশন তার রিপাের্ট দাখিল করে। কমিশনের রিপাের্টে বলা হয়-

“কমিশনের রিপাের্ট অনুসারে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাবার জন্য আন্দোলন শুরু করা হবে। ঐ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় তেভাগা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। জলপাইগুড়ি, রংপুর, দিনাজপুর, যশাের, খুলনা এবং আরাে অনেক জায়গায় তেভাগা আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছে।”

দেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষকদের মহাসমারােহে ফসল কাটা উৎসব শুরু হয়। এই উৎসবের কোনাে সাম্প্রদায়িক ভিত্তি নেই। হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল- সবাই এসেছে। এই উৎসবের হৃদয় ফসল, শরীর অধিকারের প্রতিষ্ঠা। সবাই ব্যস্ত- লালপেড়ে সাদাশাড়ি পরে আসে ইলা মিত্র। গরুর গাড়িতে ধান চলে যায় মাতলার বাড়িতে। সবাই হৈচৈ করে সেখানে উপস্থিত হয়। সারারাত গানবাজনা হয়- ঢােল, হাড়িয়া এবং ছাগলের ঝলসানাে মাংস দিয়ে সাঁওতালরা নাচে, উদ্দাম হয়ে ওঠে ওরা।

মেয়েদের স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার কাজ নিয়েই বসে থাকলেন না ইলা বরং স্বামীর সঙ্গে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লেন। তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে ইলা মিত্রকে সঁওতাল থেকে শুরু করে বাঙালি কৃষক সকলেই পরম সমাদরে গ্রহণ করে নিয়ে তাদের ভালােবাসার, শ্রদ্ধার রানিমা’তে রূপান্তরিত করে দিল। জোতদারেরা যারা তেভাগা মানেনি ইলা মিত্রের নির্দেশে তাদের খােলান থেকে ধান তুলে নিয়ে আসা হলে। ক্রমে ক্রমে এ আন্দোলন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরে কেউ কেউ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল- কিন্তু অল্পদিনেই তারা বুঝে নেয় ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে মাত্র সাধারণ কৃষকের ভাগ্য এতে কোনাে পরিবর্তন হবে না। উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে, কৃষকরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে, দিনাজপুরে নারায়ণ জোতদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে শহিদ হয়। এরপর রামচন্দ্রপুর হাটে এক বড় জনসভায় মে দিবস পালিত হয়। মিটিংয়ের দিন কৃষ্ণগােবিন্দপুর হাট লােকে লােকারণ্য হয়ে যায়।

চণ্ডিপুর, কেন্দুয়া, গাড়া, শিবনগর, মান্দা, গােলাপাড়া, মল্লিকপুর, কালপুর, মহীপুর সব জায়গা থেকে দলে দলে লােক আসে। পিঁপড়ের সারির মতাে মানুষ চারদিক ঘিরে ফেলে। শত শত কণ্ঠে স্লোগান ওঠে- “জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ কর, লাঙল যার জমি তার, ইজারাদারি বন্ধ কর।” গর্জন থামে না, গর্জনের সে স্রোত মহানন্দা নদীর স্রোতের সাথে মিশে যায়। লেখক জানাচ্ছেন এভাবে-

“এসব শ্লোগান হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হয়, ওদের ভাঙা পাঁজর থেকে বেরিয়ে আসে নিঃশ্বাসের মতাে। এসব আকুতি উচ্চারণের জন্য ওরা নিজেদের ধন্য মনে করে সামনে একটাই আশা যদি কোনদিন সত্য হয়ে ওঠে লাঙল এবং জমির অধিকার।”

জনসমাবেশ দেখে ঘাবড়ে যায় স্থানীয় জোতদার, ইজারাদার, মহাজনরা কোণঠাসা হয়ে আছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ভােলাহাট, গােমস্তাপুর, মল্লিকপুর- সর্বত্র এখন তেভাগার কথা। মানুষের জিজ্ঞাসা শেষ হয় না, যারা সক্রিয়ভাবে জড়িত নয়, তারাও জানতে চায় তেভাগার খবর। আন্দোলনকারীরা টের পেল মসলিম লীগ এ আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক মােড় দেবার চেষ্টা করছে। হয়ত যখন তখন মুসলিম লীগ উচ্চারিত ভারতীয় দালাল তেভাগার নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করতে পারে পাকিস্তানি পুলিশ, সকলকেই তাই আত্মগােপন করতে হলাে। কম্যুনিস্ট পার্টি যে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সরকার তা জানে। তাই কম্যুনিস্টদের গ্রেফতার করে বিনাবিচারের আটক করার তৎপরতা ক্রমাগত বাড়ছে। এক্ষত্রে পুলিশের নাচোল থানার দারােগা তফিজউদ্দিনের ভাষ্য স্মরণযােগ্য-

“তােমরা দেশদ্রোহী, রাষ্ট্রের দুশমন, ভারতের দালাল। তােমরা চাও পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে, চাও আমাদের স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে। তােমরা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছ, প্রশাসন চালু করেছ। পিপড়ের মতাে গলা টিপে মারলে তবে তােমাদের উচিত শাস্তি হবে। এখুনি এখান থেকে চলে যাও, নইলে পরিণাম ভয়াবহ হবে।”

উপন্যাস রচনার ফাঁকে ফাঁকে লেখক নানা গল্প পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন তা থেকে স্পষ্ট হয় তৎকালীন কৃষকদের ওপর জোতদারদের নির্মমতার চিত্র। রংপুরের ডিমলা থানার খগাখবাড়ি গ্রামে তন্ননারায়ণের বাড়ি ছিল- এ গ্রামে অর্থ এবং জনবলের দিক থেকে প্রতাপশালী কিছু জোতদার ছিল। এমন সময় তেভাগা আন্দোলনের নতুন উদ্যম এসেছে। ধান কাটা শুরু হয়েছে- সমিতির নির্দেশ আছে, কেউ আলাদাভাবে নিজের ধান কাটবে না। সংঘবদ্ধ হয়ে অনেকগুলাে ক্ষেতের ধান স্বল্প সময়ে কেটে শেষ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হয়- ধান জোতদারদের খােলানে যাবে না- যাবে চাষির বাড়িতে। অন্যদিকে গােপনে গােপনে সংঘবদ্ধ হয় জোতদাররা- তারা রাতের আঁধারে গুলি করে হত্যা করে অন্ননারায়ণকে।

জোতদাররা ভেবেছিল গুলির ভয়ে সবাই পালিয়ে যাবে। কিন্তু ফল হলাে উল্টো বন্দুকের শব্দে চারপাশ থেকে হাজার হাজার কৃষক জোতদারদের তাড়া করে। শত শত মানুষের জঙ্গি আক্রমণে তন্ননারায়ণের বাড়ি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। শেষে জোতদাররা অন্ধকারে পালিয়ে যায়। অন্ননারায়ণ শান্তিতে শুয়ে থাকে এই মৃত্যুর মধ্যেও আনন্দ এই যে তার মৃত্যু বৃথা যায়নি। পরদিন তন্ননারায়ণের হত্যার প্রতিবাদে কৃষকদের বিশাল মিছিল বের হয় তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়-

“আধির বদলে তেভাগা চাই, অন্ননারায়ণের হত্যার প্রতিশােধ চাই, জোতদারি প্রথা ধ্বংস হােক।”

কৃষক সম্প্রদায় তাদের শত্রু জোতদারদেরকে কোণঠাসা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জেলেরা মাছ দেবে না, দুধওয়ালা দুধ দেবে না, তরকারিওয়ালা তরকারি দেবে না। আরাে প্রস্তাব হয় জোতদারদের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভকে ছড়িয়ে দেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এরপর দেখা যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে জোতদার বিরােধী আন্দোলন এবং তেভাগার পক্ষে জোরালাে আন্দোলন শুরু হয়। রাঙা মিয়া, চরণ মাঝি ও এছান মিয়ার খােলান থেকে ধান নিয়ে আসা হয়েছে। ওরা তেভাগা ও সাত আড়ি জিন মেনে নেয়নি। আজ ধান ভাগ করে ওদের হিস্যা জোতদারদেরকে পৌছে দেওয়া হয়। মাতলার তত্ত্বাবধানে সব ব্যবস্থা নিখুঁত হয়- কোথায় কোনাে বিশৃঙ্খলা লক্ষ করা যায় না। অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব পালন করে শেখ আজহার হােসেন। তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রত্যেক রাতে এলাকার প্রতি গ্রাম থেকে দু’জন করে স্বেচ্ছাসেবক সারারাত পাহারায় থাকে। প্রায় তিন-চারশাে স্বেচ্ছাসেবক ক্যাম্পের আশেপাশে থাকে। নাচোল এখন মুক্ত অঞ্চল নিজেদের শাসন চালু হয়েছে- জমিদার- জোতদাররা টু শব্দ করতে পারে না। আইনমতে ধান ভাগ হয়ে চলে যায় যার যার বাড়িতে। কৃষকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা দেখা যায়- সুদিনের প্রত্যাশায়।

তেভাগা আন্দোলনকারী কৃষক স্বেচ্ছাসেবীরা প্রকাশ্যে চলাফেরা করে, অন্যায়ের প্রতিবাদে সক্রিয় হয়ে ওঠে, গড়ে চার থেকে পাচশাে স্বেচ্ছাসেবী চণ্ডিপুরের এই প্রধান ক্যাম্পে খাওয়া দাওয়া করে। পাটির নির্দেশ অনুসারে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে। মাতলা সর্দারের নেতৃত্বে তারা সুশৃঙ্খল। মাতলার কথা তারা মন্ত্রের মতাে শােনে।

জোতদার, রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ মিলে এ আন্দোলনের চিড় ধরাতে চাইলেও আজ কৃষকরা রানিমাকে ছেড়ে ভুল করতে রাজি নয়। উনিশ শ’ পঞ্চাশের জানুয়ারির পাঁচ তারিখের ঝলমলে সকালে চকচকে কাস্তে হাতে হাজার কৃষক নেমে পড়ে মাঠে। তবে জোতদারবর্গ পুলিশকে জানিয়েছে, আজ তাদের ধান চোরেরা লুট করবে। বিশাল জনতার মিছিল আর তেভাগার সমর্থনে শ্লোগানে হকচকিয়ে যায় পুলিশ বাহিনী। তবুও গুলি খেয়ে এক কৃষকের মৃত্যু হলেই জনতা। পুলিশকে আক্রমণ করে এবং খুন করে কবর দেয় মাটিতে। ঘটনাটির পর দ্রুত যেন সবকিছু ঘটতে থাকে। তিন পুলিশের খুনের পর সাধারণ চাষিদের উপর পাকিস্তানি পুলিশ শুরু করে নারকীয় অত্যাচার। যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ করা থেকে শুরু করে বাড়ি ঘরের মধ্যে আগুন সংযােগ, নাবালক শিশু থেকে দুধের গাই এমনকি বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যায়- প্রজাপতিদের যেন এবার কাঁটাতারে বিদ্ধ হওয়ার পালা এসে যায়। লেখকের ভাষায়-

“দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে গ্রাম। ঘাসুরা, চণ্ডিপুর, কেন্দুয়া, জগদল, ধরল, শ্যামপুর, নাপিতপাড়া সর্বত্র আগুনের লেলিহান শিখা- কালাে ধোয়া বিস্তৃত হচ্ছে এক গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অন্য গ্রামে- নদীতীর এবং তার ওপার। গুলির মুখে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ।… তখন বারুয়া মাঝির ষােল বছরের মেয়েটাকে নিষ্পেষিত করে একজন পুলিশ। সােমেনের পুরাে পরিবার কলাগাছের ঝােপের আড়ালে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ওরা পাঁচজন ছিল।… তারিণ মাঝির মেয়ে সুফলাকে ধরতে ব্যর্থ হয়ে- রাগে দিশেহারা হয়ে পুলিশটি ওকে মেরেই ফেলে, ওর ফুসফুস ফুটো হয়ে গুলি চলে যায়।”

সঁওতালদের মধ্যে আন্দোলনের প্রাণ সঞ্চার করে সে। তেভাগা আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় তার বিরুদ্ধেও হুলিয়া জারি হয়। পুলিশি নির্যাতন এবং কৌশলগত কারণে পিছিয়ে আসার বিষয়েও তার আছে জোরালাে যুক্তি-

“আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছি, আমরা পরাজিত হয়েছি, কিন্তু মাথা নিচু করেনি। আবার আমরা শক্তি সঞ্চয় করব, আবার আমরা লড়ব। মনে রেখাে, আমরা শােক করব না।”

গােটা নাচোলের ষাট ভাগেরও বেশি সাঁওতাল কৃষক। প্রথম তেভাগার বীজ ওদের মধ্যেই রােপিত হয়েছে। আর সেই সাঁওতালদের একত্রিত করেছে- নেতৃত্ব দিয়েছে মাতলা সর্দার- সেই তেভাগা আন্দোলনের প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত। তারা পুলিশি নির্যাতনের চরমতম মুখােমুখি হয়েও আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখে মনের গােপন কুঠিরে। লেখক জানিয়েছেন এভাবে-

“বাইরে কালাে মানুষগুলাের বুকের মধ্যে মহাকাল স্তব্ধ। ওরা মৃত্যু দিয়ে স্বদেশের ঋণ শােধ করেছে। যারা বেঁচে আছে, ওদের আটক করার দরকার হয় না। ওদের নড়ার কোনাে শক্তি নেই, পালিয়ে যাবার কোনাে আকাক্ষা নেই। খােলা আকাশের নিচে দিগন্ত-ছোঁয়া অন্ধকারের পটভূমিতে মানুষগুলাে মাথা কুটে মরে, প্রভু আমাদের আলাে দাও।”

সুতরাং আমরা বলতে পারি- ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সারাজীবনই কৃষকসম্প্রদায় তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা উৎপাদনের অংশীদার হলেও কখনাে ভােগের অধিকার পায়নি। যদিও আধুনিক সভ্যতায় কৃষকরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন- তবুও প্রতিনিয়ত তাদেরকে অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিত্য সংগ্রাম করতে হয়।