অথবা, দেশবিভাগের ক্ষেত্রে দাঙ্গার ভূমিকা কতটুকু?
অথবা, দাঙ্গার পরিণাম আলােচনা কর।
উত্তরঃ সেলিনা হােসেনের ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে হিন্দু-মসুলমানের দাঙ্গার চিত্র উঠে এসেছে; ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পূর্বে ভারতবর্ষে বিভিন্ন কারণে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা সংঘটিত হয়।
ভারতীয় সভ্যতা বিভিন্ন কারণে বহুবার রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এ উপমহাদেশের একটি বিস্ময়কর বিষয় হলে শত শত বছরের সহাবস্থানের পরেও এ অঞ্চলের প্রধান দুটি সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে রয়ে গেছে অনেক ব্যবধান। উভয় সম্প্রদায় একই জলে-বাতাসে-খাদ্যে-পরিবেশে কাছাকাছি বসবাস করেন কিন্তু হৃদয়গত দিক থেকে তারা অবস্থান করেন অনেক দূরে। ফলে, অনেকসময় এ বিভেদজাত অবস্থানের কারণে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সংঘটিত হয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এ-সাম্প্রদায়িক ধ্বংসযজ্ঞের গভীরে কাজ করেছে হিন্দু-মুসলমানের উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা, রাজনীতিবিদদের নেতিবাচক স্বার্থচিন্তা এবং ঔপনিবেশিক শাসনামলে এর পিছনে ইন্ধন যুগিয়েছেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকচক্র।
এ সব দাঙ্গার ধ্বংসযজ্ঞে ও পৈশাচিক হত্যালীলায় সমগ্র উপমহাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এদেশের জনপদে সংঘটিত দাঙ্গাগুলির মধ্যে ১৯৪৬ সালের চিত্রটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। রমেনের চোখ দিয়ে লেখক সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন-
“১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘােষণা করেছিল। এই দিন প্রচণ্ড দাঙ্গায় কলকাতার বায়ু দূষিত হয়। রমেন চোখ বুজলেই দেখতে পায় সেই দৃশ্য দেখতে পায়, উপুড় হয়ে এক যুবক, মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এক মহিলা, দ্বিখণ্ডিত শিশু, ভাবতেই অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে।”
শুধু কলকাতা নয়- সেই দাঙ্গা যে বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল তার বর্ণনাও আমরা এই উপন্যাসে পাই-
“দাঙ্গায় সারা ভারত জ্বলছে। খবর পেয়েছে ওরা, নােয়াখালীর দাঙ্গায় জীবন দিচ্ছে হাজার হাজার নর-নারী। কলকাতার পরই নােয়াখালীর দাঙ্গায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। মহাত্মা গান্ধী নােয়াখালিতে তার সেবাকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করছেন।”
ভয়াবহ দাঙ্গায় মানুষ ভুলে গেল মানুষের কথা, সবাই রূপান্তরিত হয়ে গেল হিন্দু আর মুসলমানে। অবশ্য অন্য ধর্মের যারা, তারা তাে একদমই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ঘৃণা এবং বিদ্বেষ দ্রুত ঢুকতে থাকে ওদের রক্তে। চারদিকে অন্ধকার-নৈরাজ্য। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঘােষণা করে যে, ১৯৪৮ এর জুন মাসের মধ্যে তারা ভারত ছেড়ে চলে যাবে। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ যে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল তার মূলে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা।
Leave a comment