অথবা, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিকাশে কল্লোল পত্রিকার অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে
লেখ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যে সব থেকে প্রভাব বিস্তারকারী সাহিত্যিক। রবীন্দ্র সমসাময়িক অধিকাংশ সাহিত্যিক তাঁর লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্র প্রভাব বলয় থেকে আলাদা ধরনের কিছু লেখার জন্য বেশ কিছু নবীন সাহিত্যিক ‘কল্লোল’ [১৯২৩] পত্রিকাকে ঘিরে একত্রিত হয়েছিলেন। এদেরকেই কল্লোলগোষ্ঠী নামে অভিহিত করা হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন দীনেশ রঞ্জন দাশ। কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা লিখতে শুরু করেন প্রধানত দুটি উদ্রেশ্যকে সামনে রেখে ক. রবীন্দ্র বিরোধিতা খ. বিদেশি সাহিত্যের অনুসরণে মানুষের সহজাত কামনা-বাসনাকে সাহিত্যে তুলে ধরা। কল্লোলের পুরোধা হিসেবে যাদের নাম সবার আগে স্মরণীয় তাঁরা হলেন- অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসু। পরবর্তীতে কল্লোলগোষ্ঠীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলাল
মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, পরিমল গোস্বামী প্রমুখ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে এদেশের সমাজে নানাবিধ সমস্যা ও সংকটের সৃষ্টি হয়। পুঁজিবাদ সমস্ত মানবিক মূল্যবোধের বিনাশ সাধন করে সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করে। পুঁজিবাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে বিশ্ববাসীর জীবনে তখন নাভিশ্বাস উঠেছিল। পৃথিবীজুড়ে সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবোধের বিচ্যুতি প্রভৃতি কারণে মানবসমাজে তখন জন্ম নেয় নৈরাশ্যবাদ, হতাশা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ইউরোপীয় সাহিত্যে তখন মানব মূল্যায়নের নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হয়। এই নতুন চেতনার পিছনে কাজ করে জীবন ও সমকাল সম্পর্কে মানুষের মনে নাড়া দেওয়া কিছু নতুন উপলব্ধি। পাশ্চাত্য সাহিত্যে উদ্ভূত মানব মূল্যায়নের এই নতুন আদর্শ ক্রমশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে সঞ্চারিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সূচিত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্বকালীন বাংলার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, দুর্ভিক্ষ, ঔপনিবেশিক শাসন, যুবসমাজের অবক্ষয় ও বেকারত্ব প্রভৃতি বিষয় কল্লোলগোষ্ঠীর কবিদের বিশেষভাবে নাড়া দেয় এবং কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা ও পথের অবতারণা হয়। সাহিত্যের এই আদর্শ প্রথম ফুটে উঠে মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখায়। মানবমুক্তির জয়গান তাঁর কবিতায় উচ্চকিত। নিজের ভিতরে কবিতা সুন্দরীকে বন্দি করেছিলেন জীবনবাদী মোহিতলাল মজুমদার। দেহানুগ, বাস্তব প্রেম স্বাভাবিক নিয়মে আশ্রয় বাঁধে কল্লোলগোষ্ঠীর প্রাণ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কবিতায়। প্রবৃত্তির অচ্ছেদ্য কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। বিকৃত ক্ষুধায় দলিত ও পীড়িত মানবের চিত্র রূপায়িত হয়েছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতায়। মুটে-মঞ্জুর, কুলি-কামার প্রভৃতি নিম্নশ্রেণি ও খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি আগ্রহ বোধ করেছেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। যুগের যন্ত্রণা ও দাবি আদায়ের সংকল্প কল্লোলের মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠে। কল্লোলগোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় সাহিত্যে স্থান পায় শ্রমিক-মুটে-মজুর, ঘিঞ্জি বস্তি ও খোলা ফুটপাতের অবহেলিত জীবন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment