কলিঙ্গরাজের বিনা অনুমতিতে তারি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত গুজরাটে নিজে রাজা হয়ে বসেছিলেন কালকেতু-ভাভুদত্ত-মারফত এই সংবাদ পেয়ে কলিঙ্গরাজ কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু এই যুদ্ধে কলিঙ্গ সৈন্যদল পরাজিত হ’লেও ভাড়ুদত্তের উত্তেজনায় তারা আবার কালকেতুর পুরী আক্রমণ করে। পরাজিত সৈন্যদল আবার ফিরে এল কেন বুঝতে না পেরে কালকেতু হতবুদ্ধি হয়ে গেলো; পরাজিত হয়েও যখন শত্রুপক্ষ ফিরে আসে, তখন তার পশ্চাতে নিশ্চয়ই কোন অজ্ঞাত শক্তিমান কারণ রয়েছে এই অনুমানে তখন পত্নী ফুপরার পরামর্শে কালকেতু ধনঘর বা ধান্যঘরে আত্মগোপন করে। কূটচক্রী ভাড়দত্ত কৌশলে ফুল্লরার কাছ থেকে এটা বুঝতে পেরে কলিঙ্গ সৈন্যদের জানিয়ে দেয়—ফলে কালকেতু কলিঙ্গ সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়। কিন্তু বন্দী হবার আগে কালকেতু অমিত বিক্রমে যুদ্ধ ক’রে বিরোধী পক্ষকে পর্যুদস্ত করলেও কালকেতুকে শীঘ্রই সুরলোকে নিয়ে যেতে হ’বে বলে দেবী চণ্ডী কালকেতুর বল হরণ করেন, ফলে কালকেতু বন্দী হ’ল।

কলিঙ্গরাজ কর্তৃক কালকেতু বন্দী হ’ল-

‘এমন সময়ে আসি ফুল্লরা সুন্দরী।

গলাতে কুড়ালি বান্ধি করহে গোহারি।’

ফুল্লরা নিতান্ত ইতরা রমণীর ন্যায় কোটালের হাতে-পায়ে ধরে কালকেতুর প্রাণ ভিক্ষা করে। সে জানায়, রাজ্যে তার প্রয়োজন নেই—

‘কুলিতার ধনু দেহ তিন গোটা বাণ।

মাটিয়া পাথরা আর পুরাণ খুঞা খান।।’

এই নিয়েই স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ফুল্লরা রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু কোটাল নিজে কখনও কালকেতুকে ছেড়ে দিতে পারে না, তবে সে ভরসা দিল, রাজাকে বলে সে কালকেতুর প্রাণ রক্ষার জন্য চেষ্টা করবে। তারপর

‘হাতে বাঘহাতা দিল গলাতে জিঞ্জির।

চরণে ডাড়ুকা দিয়া বান্ধে মহাবীর।।’

তারপর কালকেতুকে নিয়ে যাওয়া হ’ল কলিঙ্গরাজার দরবারে। কলিঙ্গরাজ কালকেতুর সার্বিক পরিচয় জানতে চাইলে কালকেতু বললো

‘গুজরাটে বসতি নিবাস চণ্ডীপুর।

আমার রাজ্যের রাজা মহেশ ঠাকুর।।

আমি তথা মহাপাত্র চণ্ডী অধিকারী।

তার তেজ ধরি আমি তার আজ্ঞাকারী।’

চণ্ডী কালকেতুকে এত ধন দিয়েছেন— কলিঙ্গরাজ এটা বিশ্বাস করতে না পেরে গজপদ-তলে তাকে হত্যা করতে আদেশ দিলেন। নির্ভয়ে কালকেতু জানালেন

‘দেহ যদি গজতলে নিবারিতে নারী।

লভ্য অপচয়ভোগী হন মহেশ্বরী।।’

দেবী চণ্ডীর বরপুত্র বলে কালকেতুকে মেনে নিয়ে সভাসদগণ তাকে হত্যা করতে কলিঙ্গরাজকে নিষেধ করে। ফলে কালকেতুকে হত্যা না ক’রে কারাগারে বন্দী করবার আদেশ দিলেন কলিঙ্গরাজ। কারাগারে কালকেতুকে অত্যন্ত কঠোর ও নিষ্ঠুর বিধানে রাখা হ’ল। কালকেতু কারাগারে বসে পূর্বস্মৃতি রোমন্থন ক’রে কাদতে লাগলো। তার এই দুর্দশার মূলে রয়েছেন চণ্ডী—এই কথা মনে হ’তেই কালকেতু দেবী চণ্ডীকে স্মরণ ক’রে চৌত্রিশ অক্ষরে তার স্তুতি পাঠ করতে লাগলেন

‘মহাবীর এত যদি কৈল স্তুতি বাণী। 

কৈলাসে জানিল মাতা হরের ঘরণী।।’

অতঃপর দেবী কারাগারে উপস্থিত হ’য়ে অবলীলায় কালকেতুর বন্ধন মোচন ক’রে দিয়ে তাকে চলে যেতে বললেন। কালকেতু তখন বললো—

‘বন্ধন ঘুচায়্যা তুমি যাইবে কৈলাস। 

প্রভাতে উঠিয়া রাজা করিবে বিনাশ।।

দেবী চণ্ডী তখন কলিঙ্গরাজকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে কালকেতুকে মুক্তি দানের আদেশ করেন। কলিঙ্গরাজ পরদিন রাজসভায় সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের বিস্তৃত বিবরণ দান করেন। সভাসদগণ রাজার কথা শুনে বললেন যে দেবী চণ্ডীর আশ্রিত কালকেতুর প্রতি রাজা অবিচার করেছেন, এখন

‘বীরের করিয়া পূজা    গুজরাটে কর রাজা।

চণ্ডীর সত্তোষ হ’বে মনে।’

কলিঙ্গরাজ কারাগারে গিয়ে কালকেতুকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন। তারপর তাকে সিংহাসনে বসিয়ে গুজরাটের রাজারূপে অভিষিক্ত করেন। কালকেতু রাজ-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হ’লেও তার অসংখ্য সৈন্যের মৃত্যুতে তাদের স্ত্রীগণ অনুমৃতা হতে চাইলে কালকেতু অত্যন্ত দুঃখিত হন। তিনি দেবী চণ্ডীকে স্মরণ করলে দেবী আশ্বাস দিলেন

‘জিয়াইয়া দিব আমি মৃত সেনাগণ।’

কালকেতুর মৃত সৈন্যগণ দেবীর দ্বীপায় পুনর্জীবন লাভ করে। অতঃপর সকলে মিলে গুজরাট নগরে ফিরে এলে গুজরাটে উৎসবের বন্যা বয়ে যায়। শুধু ভাড়ুদত্ত আবার ফিরে এসে চাটুবাক্য উচ্চারণ করতে থাকলে কালকেতু তাকে যথেষ্ট অপমানিত করেও শেষ পর্যন্ত তার ঘর-বাড়ি ফিরিয়ে দিলো।