রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ রচনা থেকে আলােচ্য উদ্ধৃতিটি গ্রহণ করা হয়েছে। বুড়াে কর্তা মারা যাওয়ার সময় দেশের সমস্ত লােক তাকে জানাল যে, তিনি চলে যাওয়ার পর তাদের অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়ে পড়বে, তারা অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে। এ কথা শুনে মর্মাহত মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ দেশের লােকেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ভগবান তাই দয়াপরবশ হয়ে দেশবাসীকে জানালেন যে, চিন্তার কিছুই নেই, মৃত্যুর পর কর্তা ভূত হয়েই দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে থাকবেন। মানুষের মরণ থাকলেও প্রেতের তাে মৃত্যু নেই। ভূতদশাপ্রাপ্ত বুড়াে কর্তার অভিভাবকত্বে থাকার নিশ্চয়তা পেয়ে তাই দেশবাসী নিশ্চিন্ত হয়। দেশবাসীর এই চিন্তাহীনতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়েই লেখক প্রশ্নোক্ত উদ্ধৃতিটির অবতারণা করে বলেছেন যে, ভবিষ্যৎকে মানার ক্ষেত্রেই ভাবনাচিন্তার প্রশ্ন আসে, কিন্তু ভূতকে মানার ব্যাপারে কোনাে ভাবনা থাকে না।

আধুনিকতাকে মানতে গেলে সবকিছুকেই বিচারবিশ্লেষণ করতে হয়, যুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। কিন্তু ভূতরূপী ধর্মতন্ত্রকে অন্ধভাবে মানলে তাে কোনাে ভাবনাই থাকে না—সব ভাবনাচিন্তা ধর্মতন্ত্র তথা অদৃষ্টবাদের ওপর ন্যস্ত করে মানুষ দায়িত্বশূন্য হয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে।

প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তিটি বুড়াে কর্তার ভূত সম্পর্কে করা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত’ রচনায় আমরা দেখি যে, দেশবাসীকে নিশ্চিন্ত করতে দেবতা তাদের বলেন যে, মৃত্যুর পর বুড়াে কর্তা ভূত হয়েই তাদের ঘাড়ে চেপে থাকবেন। প্রসঙ্গত লেখক বলেন যে, ভবিষ্যৎকে মানার ক্ষেত্রেই চিন্তাভাবনার প্রশ্ন আসে, কিন্তু ভূতকে মানার ক্ষেত্রে কোনাে দুশ্চিন্তা থাকে না। সেক্ষেত্রে সব ভাবনাচিন্তা ভূতের ওপরই বর্তায়। এ প্রসঙ্গেই লেখক জানিয়েছেন যে, ভূতের মাথা নেই বলে কারও জ জন্য তার মাথাব্যথাও নেই।

প্রকৃতপক্ষে আলােচ্য উক্তিটির একটি রূপকার্থ আছে। ‘য়ুরােপ যাত্রীর ডায়ারি’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা বহুদিন হল পঞত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, আমাদের বর্তমান সমাজ তারই প্রেতযােনি মাত্র।” সুতরাং ‘পঞত্বপ্রাপ্ত’ সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতার প্রেতই আমাদের সমাজকে বর্তমানে পরিচালিত করছে। ধর্মতন্ত্র অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্র, ধর্মীয় সংস্কার ও লােকাচার যেহেতু অপরিবর্তনীয় এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ, তাই কোনাে ব্যক্তিমানুষ বা কোনাে মানবগােষ্ঠীর প্রতি তার কোনাে দায়বদ্ধতা থাকে না। তাই লেখক বলেছেন যে ভূতের মাথাব্যথাও নেই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত’ রচনায় আমরা দেখি যে, দেশবাসীকে নিশ্চিন্ত করতে দেবতা তাদের বলেন যে, মৃত্যুর পর বুড়াে কর্তা ভূত হয়েই তাদের ঘাড়ে চেপে থাকবেন। এ প্রসঙ্গেই লেখক বলেন যে, ভবিষ্যৎকে মানার ক্ষেত্রেই চিন্তা ভাবনার প্রশ্ন আসে, কিন্তু ভূতকে মানার ক্ষেত্রে কোনাে দুশ্চিন্তা থাকে না। সেক্ষেত্রে সব ভাবনাচিন্তা ভূতের ওপরই গিয়ে পড়ে।

প্রাচীন সভ্যতার প্রেতরূপী ধর্মতন্ত্রের প্রসঙ্গেই লেখক বলেছেন যে, তার মাথা নেই। ধর্মতন্ত্র অর্থাৎ ধর্মীয় সংস্কার ও লােকাচার যেহেতু অপরিবর্তনীয় এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ, তাই কোনাে ব্যক্তিমানুষ বা কোনাে মানবগােষ্ঠীর প্রতি তার কোনাে দায়বদ্ধতা নেই। অথচ দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা দেশবাসীকে বলেন যে, চোখ বুজে চলা অর্থাৎ ধর্মতন্ত্রকে অনুসরণ করে প্রশ্নহীনভাবে এইরকম এগিয়ে চলাই হল মানুষের আদিম চলন। নিয়তির কাছে, ভাগ্যের কাছে সঁপে দেওয়ার এই চলনই প্রকৃত পথচলা, কারণ, ‘সৃষ্টির প্রথম চক্ষুহীন কীটাণুরা এই চলা চলতচ ঘাসের মধ্যে, গাছের মধ্যে, আজও এই চলার আভাস প্রচলিত।’ তত্ত্বজ্ঞানীদের এই রক্ষণশীল বিধানের মাধ্যমে দেশবাসী তাদের প্রাচীন কৌলীন্য ও আভিজাত্যকে অনুভব করে আনন্দিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ রচনায় মনােরম ঠান্ডা আবহাওয়ার ভূতশাসিত দেশে প্রায়শই শােনা যায় ‘খোকা ঘুমােলাে, পাড়া জুড়ােলাে’– এই ছেলেভুলানাে ছড়াটি। এ ছড়া খােকার পক্ষে সুখদায়ক; খােকার অভিভাবকের পক্ষেও বটে। আর ছড়াতেই আছে যে -পাড়া ঠান্ডা হল। কিন্তু ছড়াটিতে এরপরেই আছে বর্গি এল দেশে’। ছড়াকার ছন্দ মেলানাের জন্যও বটে, আবার ইতিহাসকে বিকৃত না করার জন্যও এই অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ অনিবার্য অংশটির উল্লেখ করেছেন। এই প্রসঙ্গে দেশবাসীরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের শিরােমণি, চূড়ামণি প্রভৃতি উপাধিধারীকে বর্গি আসার কারণ জিজ্ঞাসা করেছেন। পণ্ডিতের দল টিকি নেড়ে দেশবাসীর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জানিয়েছেন যে, বর্গি-আক্রমণের জন্য ভূতের বা ভূতশাসিত দেশের কোনাে দোষ নেই, সে দায় বর্গিদেরই। বর্গিদেরই এদেশে আসা অন্যায় হয়েছে।

বিদেশি লুণ্ঠনকারীদের আগমন ও আক্রমণের জন্য দেশের ধর্মতন্ত্রের কুসংস্কার, জাতপাতের বিভাজন, দেশবাসীর প্রতিবাদহীনতা ও আত্মশক্তির অভাবই দায়ী। এই অপ্রিয়-সত্যকে অস্বীকার করার জন্যই ধর্মের ধ্বজাধারীরা সমস্ত দায় সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি লুণ্ঠনকারীদের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে।