রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ ছােটোগল্পে স্বাধীনভাবে ভাবতে চাওয়া দেশবাসীর কথা-প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন যে, তারা ভূতের কানমলা খায়। মৌলিক চিন্তার অধিকারীদেরই ভাগ্যে জোটে ‘ভূতের কানমলা’ অর্থাৎ কঠোর বিধিনিষেধ এবং অনুশাসন। সেই কানমলা থেকে নিজেকে মুক্ত করা যেমন কঠিন, তেমন। সেখান থেকে পালানােও শাস্তিগ্রহণকারীর পক্ষে অসম্ভব। এমনকি সেই বিনা-অপরাধের শাস্তির জন্য কোথাও অভিযােগও করা যায় না। কেননা, ভূতের বিরুদ্ধে বিচারের কোনাে ব্যবস্থাই যে কারাের জানা নেই।
‘য়ুরােপ যাত্রীর ডায়ারি’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা বহুদিন হল পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়েছে …।” এই ‘পঞত্বপ্রাপ্ত’ সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা ই এই গল্পের কর্তা এবং সে-সভ্যতার ‘ধর্মতন্ত্র’-ই হল তার ভূত। অন্য দেশগুলিতে ভূতের উপদ্রব হলে মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ওঝার খোঁজ করে, আমাদের দেশবাসী কিন্তু সেসব চিন্তাও করে না। কেন-না, এদেশের ওঝাদের আগেভাগেই ভূতে পেয়েছে। কথাগুলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অর্থ হল, বিদেশে ধর্মতন্ত্র ও কুসংস্কারের বাড়াবাড়ি হলে মানুষ বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের দ্বারস্থ হয়। এই দেশের লােকেদের সে চিন্তা নেই, কারণ এ দেশের বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের অধিকাংশই ধর্মতন্ত্র ও কুসংস্কারে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত রচনায় লেখক ভূতগ্রস্ত দেশের অধিবাসীদের ঘানি ঘােরানাের সঙ্গে বিদেশিদের ঘানি ঘােরানাের তুলনামূলক আলােচনা করেছেন। প্রথমে ভূতশাসিত ভূতুড়ে জেলখানার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন যে, ভূতনিয়ন্ত্রিত দেশরূপ কারাগারে দেশবাসী অবিরত ঘানি ঘুরিয়েও এমন এক ছটাক তেলও উৎপন্ন করতে পারে না, যার বাজারমূল্য আছে। অন্যদিকে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলিকে ভূতে পায়নি বলে সেসব দেশে ঘানি থেকে কেবল তেলই বের হয়। ভূতগ্রস্ত দেশবাসীর ঘানি ঘােরানাের ফলে তাদের তেজ বা প্রাণশক্তি বেরিয়ে যায়। সেই শক্তি বের হয়ে যাওয়ার ফলে দেশবাসী নেতিয়ে পড়ে। এই পেষণযন্ত্রে পেষণকারীর তেজই শুধু বেরিয়ে যায় না, তার রক্তও নিংড়ে বের করা হয়। এই রক্ত ভূতের খুলিতে ঢালার তরল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে ভূততন্ত্রকে সচল রাখে। অন্যদিকে, বিদেশের ঘানি থেকে নির্গত তেল যেমন সেই দেশের রথচক্রকে সচল রাখে, তেমনি সেইসব দেশের মানুষজনকে সচল, সজীব এবং জাগ্রত রাখে।
দেশবাসীর ঘানি ঘােরানাের অর্থাৎ ধর্মতন্ত্র-নির্দেশিত শ্রমের ফলে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের কোনাে সুরাহা হয় না। পৃথিবীর অন্য দেশগুলি এই ধর্মতন্ত্রের মােহজালে আচ্ছন্ন হয়ে নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত একটি রূপকধর্মী গল্প। এখানে দেখা যায় যে, সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতার অবসানকালে আধুনিক যুগের আত্মবিশ্বাসহীন দেশবাসী ভবিষ্যতের কথা ভাবতে বসে প্রাচীন সভ্যতার ধর্মৰ্তন্ত্রকে আঁকড়ে ধরাই নিরাপদ বলে মনে করল। কিন্তু ধর্মশাস্ত্র তথা ধর্মতন্ত্র যেহেতু অপরিবর্তনীয়, তাই কারও জন্য তার বিশেষ দুশ্চিন্তাও নেই। তবে, নিজস্ব প্রকৃতিগত কারণে যে দু-একজন মানুষ স্বাধীনভাবে ভাবার চেষ্টা করে, ধর্মত্ত্রের শাস্তি নেমে আসে তাদের ওপর।
ধর্মতন্ত্রের কারাগারে বন্দি ভারতবাসীর পাহারাদার হল পুরােহিতশ্রেণি। সেই কারাগারের পাঁচিল আসলে অন্ধ ধর্মমােহের বাধা, যার অবস্থান মানুষের মনে। ধর্মতন্ত্র নির্দেশিত শ্রমে অর্থাৎ যাগ-যজ্ঞ-পূজা-অর্চনাসহ যাবতীয় লােকাচারে দেশবাসী সবসময় ব্যস্ত থাকতে থাকতে তাদের যুক্তিসংগত চিন্তাভাবনা ও প্রতিবাদের শক্তি হারিয়ে যায়। কিন্তু এতে দেশে দুঃখ-দারিদ্র্য থাকলেও শান্তি রয়ে যায়। সে শান্তি অবশ্য শ্মশানের শান্তি।
এদিকে দু-একজন ভীরু দেশবাসী আত্মকর্তৃত্ব বা আত্মশক্তি লাভের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তার জন্য মানসিক শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয় না। আসলে জনসাধারণের আত্মশক্তির অভাব এবং ভয়ের কারণেই দেশে ধর্মীয় সংস্কার এবং ধর্মতন্ত্র বাসা বেঁধে রয়েছে। ধর্মতন্ত্রের অবস্থান আসলে ভীত দেশবাসীর অন্তরে।
রবীন্দ্রনাথের কর্তার ভূত রচনার বাইরের গৌণ আখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও একটি সমান্তরাল আখ্যানসেটিই মুখ্য। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে য়ুরােপ যাত্রীর ডায়ারি-র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা বহুদিন হল পঞত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, আমাদের বর্তমান সমাজ তারই প্রেতযােনি মাত্র।’ এই পঞত্বপ্রাপ্ত, সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতাই কর্তার ভূত গল্পের কর্তা এবং সে-সভ্যতার ‘ধর্মতন্ত্র’-ই হল তার ভূত। রবীন্দ্রনাথ এ রচনায় দেখিয়েছেন যে, প্রাচীন সভ্যতার অবসান হলেও সে সভ্যতার ধর্মতন্ত্র আধুনিক ভারতবর্ষকে কেমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। ফলে যুক্তিবুদ্ধি-বিচার-বিবেচনাহীন হয়ে পরাধীন দেশবাসী সেই ধর্মতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে ঘুমের ঘােরে দিন কাটিয়ে চলেছে।
এ গল্পে ত্রৈলােক্যনাথ মুখােপাধ্যায়ের কঙ্কাবতী’ রচনার মতাে উদ্ভট কল্পনাও আমরা লক্ষ করি, যখন দেখি যে অনবরত ঘুরেলা ভুতুড়ে জেলখানার ঘানি থেকে তেলের বদলে দেশবাসীর তেজ বেরিয়ে যাচ্ছে। তবুও একে ‘প্যারাবল’ (Parable) বলা যায় না। কর্তার ভূত’ রচনাকে কোনাে একটি নির্দিষ্ট অভিধায় তাই বেঁধে ফেলা কঠিন। তবে একে ‘রূপকধর্মী ছােটোগল্প হিসেবে উল্লেখ করা যেতেই পারে।
‘কর্তার ভূত’ অবলম্বনে ‘স্বভাবদোষে যারা নিজে ভাবতে যায়’ তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করাে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘কর্তার ভূত’ রচনায় দেশসুদ্ধ সবাই বলতে কোন্ ধরনের মানুষের কথা বলা হয়েছে?
কর্তার ভূত ছোট গল্পের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করাে।
কর্তার ভূত ছোট গল্প অবলম্বনে ভুতুড়ে জেলখানার বর্ণনা দাও। কাদের সম্বন্ধে এবং কেন লেখক বলেছেন যে, তারা ভয়ংকর সজাগ আছে?
“দেশের লােক ভারি নিশ্চিন্ত হল।”—কীভাবে দেশের লােক ভারী নিশ্চিন্ত হল?
“একেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা।”- ‘কর্তার ভূত’ রচনা অবলম্বন করে এই ‘অদৃষ্টের চালে চলা’র তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।
“সেই জেলখানার দেয়াল চোখে দেখা যায় না।- সেই জেলখানার বিস্তৃত বিবরণ দাও। সেই জেলখানার কয়েদিদের ঘানি ঘােরানাের কথা আলােচনা করাে।
“শুনে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আর মাসতুতাে-পিসতুততার দল কানে হাত দিয়ে বলে,—কোন্ কথার উত্তরে কী বলে তারা?
“কেননা ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোনাে ভাবনাই নেই;”—প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।
“অথচ তার মাথা নেই, সুতরাং কারও জন্য মাথাব্যথাও নেই।”— কার সম্বন্ধে, কেন লেখক এ কথা বলেছেন?
“শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে।”- আদিম আভিজাত্য’ অনুভব করার কারণ কী?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ রচনায় ‘দেশে যত শিরােমণি-চূড়ামণি’-র বক্তব্য কী ছিল?
“এখন কথাটা দাঁড়িয়েছে, ‘খাজনা দেব কিসে।” কারা, কাদের কাছে খাজনা চেয়েছে? খাজনা দিতে না পারার কারণ কী?
“দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ” -এর সঙ্গে বুড়াে কর্তার কথােপকথন ‘কর্তার ভূত’ অবলম্বনে লেখো এবং রূপকার্থ আলােচনা করাে।
‘ওরে অবােধ, আমার ধরাও নেই ছাড়াও নেই, তােরা ছাড়লেই আমার ছাড়া’—এখানে কে কাদের অবােধ বলেছেন? উক্তিটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।
“কর্তা বলেন, সেইখানেই তাে ভূত।”- কোন প্রসঙ্গে এবং কেন কর্তা এ কথা বলেছেন?
‘কর্তার ভূত’ রচনায় ওঝা প্রসঙ্গটির তাৎপর্যটি লেখাে।
“সে ভবিষ্যৎ ভ্যাও করে না ম্যাও করে না” -সে ভবিষ্যৎ ভ্যা বা ম্যা করে না কেন?
“কেননা ওঝাকেই আগেভাগে ভূতে পেয়ে বসেছে”- ওঝাকে ভূতে পেলে কী ক্ষতি হওয়ার কথা লেখক বলেছেন?
‘কর্তার ভূত’- কি নিছক ভূতের গল্প, নাকি রাজনৈতিক রূপক কাহিনি? ব্যাখ্যাসহ লেখাে।
“ভূতের রাজত্বে আর কিছুই না থাক…শান্তি থাকে”- মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করাে।
কেন কিছু দেশবাসীর ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে দ্বিধা জাগল?
‘কর্তার ভূত’-রচনাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করাে।
রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ভূত’ রচনাটির ভাষাশৈলী তথা রচনাশৈলী পর্যালােচনা করাে।
‘তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।’ -কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের এমন ‘ভয়ংকর সজাগ থাকার কারণ কী?
“কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল।”—কারণটি পর্যালােচনা করাে।
কর্তার ভূত গল্পে যে সামাজিক সত্যের দিকে লেখক নির্দেশ করেছেন তা নিজের ভাষায় লেখাে।
Leave a comment