কমেডির স্বরূপবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত। Hobbes, Bergson, Meredith এর মতেও আমরা যখন কোনও ব্যাক্তির দুর্বলতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি ইত্যাদি সম্পর্কে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করি, সে সময়ই কমেডির হাস্যরস সৃজিত হয়। Aristotle, Kant, Schopenhauer প্রমুখ চিন্তাবিদদের মতে, যে কোনও ধরনের অসঙ্গতি, আমাদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পার্থক্যই কমেডির হাস্যরসের উৎস। কমেডির হাস্যরসে এই দুটি ধারাই দেখা যায়। বেশির ভাগ কমেডিতে হাস্যরসের সঙ্গে সহানুভূতিকে মিশ্রিত হতে দেখা যায়, যার উদ্ভট, বিসদৃশ আচরণ আমাদের হাসির খোরাক, তার সঙ্গে আমরা আত্মীয়তা অনুভব করতে পারি। Aristotle কমেডি সম্পর্কে বলেছেন: “A comedy is an imitation of men worse than the average; worse however, not as regards any and every sort of fault, but only as regards particular kind, the ridiculous, which is a species of the ugly. The ridiculous may be defined as a mistake or deformity not productive of pain or harm to others.” অসঙ্গতির পীড়ন যখন এমন স্বল্পমাত্রায় থাকে বা আমাদের কাছে আনন্দদায়ক হয়, তখনই আমরা কমেডির উদাহরণ পাই। কমেডি আমাদের শুধু নিছক লঘু আনন্দ বিতরণ করে না, উচ্চাঙ্গে র কমেডিতে জীবনের সত্যদৃষ্টি আভাসিত হয়।
ক্ল্যাসিকাল কমেডি বলতে আমরা মূলত গ্রীক কমেডিকেই বুঝে থাকি। অ্যারিস্টলের কমেডি সংক্রান্ত প্রধান আলোচনা পাওয়া যায় নি, যেটুকু পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, তিনি প্রাচীন কমেডির গঠনগত শৈথিল্য ও বিদ্রুপপ্রবণতা পছন্দ করেন নি। তাঁর কালের নতুন কমেডি (New Comedy) এবং তাঁর রোমান অনুকারী Plautus ও Terence-এর রচনাই তাঁর পছন্দ ছিল। Aristophanes প্রাচীন কমেডির সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত শিল্পী, ব্যক্তির ত্রুটিবিচ্যুতি, বিকৃতি, সমকালীন প্রথা ইত্যাদিকে তাঁর রচনায় তীক্ষ্ণভাবে বিদ্রুপ করেছেন। ক্যাসিকাল কমেডি রক্ষণশীল, সাধারণ প্রথা, সংশয় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে শোভনতার ধ্যানধারণা প্রভৃতি লঙ্ঘনকারীর আচরণ উদ্ঘাটনই এই কমেডির প্রধান লক্ষ্য। এই কমেডির প্রধান আকর্ষণীয় দিক পরিহাস (Ridicule), আচরণ ও নীতিসংশোধনই তার লক্ষ্য। বিদ্রুপও তার অঙ্গ। ক্ল্যাসিকাল কমেডিতে সমাজের সাধারণ বিচারবোধের মানদন্ডে ব্যক্তির মানসিকতা ও আচরণের অসঙ্গতি ও বিচ্যুতি প্রদর্শন করা হয়। Menander ক্ল্যাসিকাল কমেডির সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত প্রবক্তা। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী নাট্যকার Moliere ও ইংরেজ নাট্যকার Jonson এই ক্ল্যাসিকাল কমেডি বা New Comedy-র ধারা অনুসরণ করেছিলেন। এই জাতীয় কমেডির চরিত্রগুলি টাইপ চরিত্র, লোভী ব্যক্তি, দন্তস্ফীত সৈনিক, পরগাছার মত অপরের ওপর নির্ভরশীল মানুষ ইত্যাদি। পরিস্থিতির বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য, চক্রান্তের উদ্ভাবন, হাসির উচ্ছলতা, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ প্রভৃতি নাট্যকারদের মৌলিকতার পরিচয় বহন করে। ট্র্যাজেডির অনেক গঠনবৈশিষ্ট্য ক্ল্যাসিকাল কমেডিতে লক্ষ্য করা যায়।
রোমান্টিক কমেডির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা এলিজাবেথীয় যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্সপিয়ার। তিনি Lyly, Greene, Peele প্রভৃতি নাট্যকারদের অনুসরণে এই নাট্যধারাকে পরিণত শিল্পরূপ দান করেন। Lyly, Greene প্রমুখ নাট্যকারদের রচনায় রোমান্স ও কমেডির সমন্বয় লক্ষণীয়। শেপীয়র তাঁর Love’s Labours’s Lost, A Midsummer Night’s Dream, Twelfth Night, As You Like It. Much Ado About Nothing প্রভৃতি রচনায় রোমান্টিক কমেডিকে বিশেষ রূপ ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। ক্ল্যাসিকাল কমেডির সঙ্গে তাঁর রোমান্টিক কমেডির পার্থক্য সুস্পষ্ট। সমাজপ্রচলিত -অভ্যাস, এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রশ্নাতীত ঔচিত্যের লঙ্ঘনকারীর উদ্ঘাটন আচরণ ও নীতির সংশোধন প্রভৃতিই ক্ল্যাসিকাল কমেডির লক্ষ্য। বিদ্রুপ পরিহাসই তার প্রকরণ এবং মানদণ্ড সমাজের সাধারণ বিচারবোধ। অন্যদিক কল্পনায় ও প্রসন্ন, নির্মল কৌতুকে দর্শকদের আনন্দে অভিষিক্ত করাই শেকসপীয়রীয় কমেডির লক্ষ্য।
Charlton তাঁর রোমান্টিক কমেডির স্বরূপবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন : “Shakespearean comedy is not finally satiric, it is poetic. It is not conservative, it is creative. The way of it is that of the imagination rather than of pure reason. It is an artist’s vision, not a critic’s exposition.” শেক্সপিয়ার তাঁর এই কমেডিগুলিতে রোমান্সের বর্ণাঢ্য ও মনোরম আবহ সৃষ্টি করেন। রোমান্টিক প্রেমই এই কমেডিগুলির প্রধান বিষয়বস্তু। কোনও কোনও নাটকে ছদ্মবেশ ধারণের মধ্য দিয়ে এই প্রেমচিত্র অত্যন্ত কৌতুকবহ ও আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধুসূদন, দীনবন্ধু প্রমুখ নাট্যকারেরা প্রহসন রচনায়ই উৎসাহী ছিলেন, কমেডি রচনায় নয়। প্রহসনের মধ্যে ব্যঙ্গবিদ্রুপই প্রাধান্য পায়, নির্মল, প্রসন্ন হাস্যরসই কমেডির প্রাণ। A. Nicoll এ সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন : “The purest of comedy, usually rules satire in any form out of its province. The appeal of this pure comedy is solely to the laughing force within us.” মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘোড়ে রোঁ’, ‘একেই কি বলে সভ্যতা এবং দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’, ‘জামাই বারিক’ প্রভৃতি নাটক প্রহসন। গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও পরবর্তী নাট্যকারেরা এই ধারাই অনুসরণ করেছিলেন।
অমৃতলাল বসু অনেকগুলি প্রহসন রচনা করেছিলেন, তাঁর ‘খাসদখল’ (১৯১২)ও ‘নবযৌবন’ (১৯১৪) যথার্থ হাসারসাত্মক কমেডি অ্যাথ্যা লাভের যোগ্য। ‘খাসদখল’-এ সামাজিক সমস্যা সম্বন্ধে ব্যঙ্গবিদ্রূপ এবং করুণরসের মিশ্রণ থাকলেও কাহিনীর চমৎকারিত্ব আমাদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আকৃষ্ট করে রাখে। ঘরের বৌ মোক্ষদার লেখাপড়া শিখে উদ্ভট রোমান্টিক নায়িকাসুলভ আচরণ যেমন, তেমনি গিরিবালার কাহিনীও আমাদের আনন্দ দেয়। বিধবা বিবাহ-সম্পর্কিত কটাক্ষ ও বিতর্কের যে অন্ধকার ‘মেঘ’ নাটকে দেখা দেয় কৌতুকহাস্যের বাতাসে তা উড়ে যায়, নাটককে ভারাক্রান্ত করে তোলে না। অমৃতলালের ‘নবযৌবন’ (১৯১৪) কৌতুকরসোচ্ছল প্রাণবন্ত উপভোগ্য কমেডি। প্রেম, বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস, কাহিনীর রহস্যময়তা প্রভৃতি উপাদানের সমবায়ে নাটকটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের আবিষ্ট করে রাখে।
কমেডি বা কৌতুকময় হাস্যরসপ্রধান নাটক রচনায় রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব প্রতিভার উজ্জ্বল পরিচয় রেখে গেছেন। তাঁর ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’য় সরল ও উদার-হৃদয় বৃদ্ধ বৈকুণ্ঠের সাহিত্যের দুরাকাঙ্খা এবং তার কাছে যে আসে তাকেই তার পান্ডুলিপি পড়ে শোনানোর দুর্দমনীয় বাতিক কৌতুকরসের সঙ্গে করুণরসও সৃষ্টি করেছে। ‘চিরকুমার সভা’য় (১৩৩২) তরুণদের চিরকুমার সভার কৌমার্যব্রত এবং তার বিরুদ্ধে বিবাহের ষড়যন্ত্র এবং অবশেষে কৌমার্যব্রত ভঙ্গ হওয়াকে কেন্দ্র করে কৌতুকরস সৃজিত হয়েছে।‘শেষরক্ষা’য় (১৩৩৫) চন্দ্র ও ক্ষান্তর দাম্পত্যপ্রেম, বিনোদ কমলের অর্থসমস্যাজনিত সাময়িক ভুলবোঝাবুঝি, গদাই ও ইন্দুর অনুরাগ—ঘটনাবিন্যাসের নৈপুণ্যে প্রেমের ত্রিমুখী ধারা সমন্বিত হয়ে অনাবিল কৌতুকরসে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। বাগ্বৈদগ্ধ্যপূর্ণ সংলাপও রবীন্দ্রনাথের এই কমেডিগুলির প্রধান আকর্ষণ।
ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের কমেডি সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন : “স্ফূর্তির হিল্লোলে ভরা, বাগবৈদগ্ধ্য মনোরম, নানা ভ্রাপ্তি, কৌতুককর ঘটনা ও খেয়ালী চরিত্রের সমাবেশে অফুরন্ত হাসির নির্ঝর এই নাটকগুলি আমাদের মনে একটি অবিমিশ্র হর্ষলোকের সৃষ্টি করে। কল্পনাগুণে কলিকাতা শহর যেন একটি প্রেম ও যৌবনোচ্ছ্বাসের মায়াপুরীতে রূপান্তরিত হইয়াছে। এখানে প্রেমিক যুবক পথে পথে প্রেমিকার অনুসন্ধান করিয়া ফেরে, নানা ভুলচুকের ও হাস্যকর অবস্থার ভিতর দিয়া তাহার সত্য পরিচয় লাভ করে ও গুরুজনের মনে নানা বিস্ময়কৌতুকের ও সময় সময় বিরাগের সৃষ্টি করিয়া শেষ পর্যন্ত তাহার সহিত মিলিত হয়। এখানে চিরকৌমার্যব্রতের অসম্ভব প্রতিজ্ঞায় দীক্ষিত দুইটি তরুণ বন্ধু একটি তরুণী শ্যালিকা-পরিবৃত পরিবারে আমন্ত্রিত হইয়া সঙ্গে সঙ্গে দুই তরুণীর প্রেমে পড়িয়া যায় ও তাহাদের সমস্ত কঠোর প্রতিজ্ঞার কথা সম্পূর্ণ ভুলিয়া রঙ্গীন যৌবন-স্বপ্নে, প্রেমের বিচিত্র কল্পনা-রোমন্থনে বিভোর হইয়া পড়ে। এখানে নারী পুরুষের ছদ্মবেশে দুশ্চর ব্রতে যোগ দিয়া পুরুষ ব্রতধারীদের সংকল্প শিথিল করে ও প্রেমের মধুর মায়ালোকে প্রবেশ ব্যাপারে তাহাদের পথ-প্রদর্শিকা হয়।”
বিধায়ক ভট্টাচার্যের হাস্যরসাত্মক কমেডি ‘তাই তো’র প্রধান গুণ সজীব ও কৌতুকরসোচ্ছল সংলাপ। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বন্ধু’ কৌতুক ও রোমান্সরসে উপভোগ্য কমেডি, কাহিনীও বৈচিত্র্যপূর্ণ। হেমন্ত ও অশনি এই দুই বন্ধু এবং একটি পরিবারের দুই বোনের প্রেমের কৌতুকপূর্ণ ভুলবোঝাবুঝি এবং আত্মভোলা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানাঞ্জনা, ফ্রয়েড-শিষ্য প্রেমকুমার প্রভৃতির বাতিকগ্রস্ত চরিত্রকে কেন্দ্র করে নাটকটিতে কৌতুকরস সৃষ্টি হয়েছে। ডিটেকটিভও নাটকটির মধ্যে ঘটনার অভিনবত্ব লক্ষ্য করা যায়। প্রমথনাথ বিশীর ‘ঋণং কৃত্বা’ ও ‘ঘৃতং পিবেৎ’ নাটকে হাস্যরসের উজ্জ্বলতার সঙ্গে রোমান্টিক প্রেমের সমন্বয়, হাস্যরস সৃষ্টির নৈপুণ্য, উদ্ভট অপ্রত্যাশিত ঘটনার জটিলতা উদ্ভাবনের দক্ষতা এবং শব্দ ও বাক্যপ্রয়োগের শাণিতদীপ্তি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রমথনাথের ‘মৌচাকে ঢিল’ ও ‘পরিহাসবিজল্পিতম’কে ক্ল্যাসিকাল কমেডির উদাহরণরূপে গ্রহণ করা যায়, কারণ তাদের মধ্যে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী সম্পর্কে নাট্যকারের পরিহাস ও তীব্র বিদ্রুপ অত্যন্ত স্পষ্ট। রোমান্টিক কমেডির প্রসন্নতা এখানে পাওয়া যায় না।
বীন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ বিশুদ্ধ হাস্যরসোজ্জ্বল, রসোত্তীর্ণ রোমান্টিক কমেডি। মানস ও নীহারিকা শুধু চাকরি পাবার জন্য স্বামী-স্ত্রী রূপে পরিচয় দিয়ে শিক্ষকতায় ব্রতী হয়। সকলের সামনে সেই ভূমিকায় অভিনয় করে অবশেষে সেই বন্ধনকে স্বীকার করে নেয়—এই চিত্রের কৌতুক ও রোমান্সরস অত্যন্ত উপভোগ্য—বর্তমান যুগে সমস্যাজটিল সামাজিক নাটকেরই প্রাধান্য, তবে নাট্যকারের কৌতুকরসোক্তি নাটককে একেবারে উপেক্ষা করে নি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভাড়াটে চাই’ ও ‘বারোভূতে, উমানাথ ভট্টাচার্যের ‘শেষ সংবাদ’, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মৌনমুখর’, বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘কান্নাহাসির পালা’ কিরণ মৈত্রেয় ‘যা হচ্ছে তাই’, মন্মথ রায়ের মরা হাতী লাখ টাকা’ প্রভৃতি হাস্যরসাত্মক প্রহসন ও কমেডি হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
Leave a comment