“তাঁহার এই ক্ষুদ্র রসিকতাপূর্ণ প্রবন্ধটি তাঁহার শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধসমূহের অন্যতম। ইহাতে তিনি ফরাসি পণ্ডিত রুশোর সাম্যবাদের মূল সূত্রটি অবলম্বনে মানবসমাজের আর্থিক অসাম্যের প্রতি তীব্র কটাক্ষপাত করিয়াছেন।”—বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ অবলম্বন করে উপরোক্ত মন্তব্যটি আলোচনা করো।

‘বিড়াল প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজচেতনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করো।

বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন সমাজচেতন শিল্পী। অন্তরের সুগভীর দেশপ্রেম হতেই এই সমাজচেতনা জন্মেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজচিন্তা পশ্চাতে কোনোরূপ সস্তা আবেগ বা ভাবপ্রবণতা ছিল না। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সুগভীর সহানুভূতি সত্যদৃষ্টি তাঁকে প্রকৃত সমাজচেতনা শিল্পী করে তুলেছিল। অসাধারণ প্রজ্ঞাদৃষ্টি দ্বারা তিনি জগৎ ও জীবনের মৌল সমস্যাসমূহের অন্তঃস্বরূপ উদ্ঘাটন করে সেগুলির সহজ সমাধানের পথনির্দেশ করেছিলেন।

‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ কমলাকান্তরূপে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর গভীর অনুভূতির আলোকে জগৎ ও জীবনের মূল রূপ-রহস্য আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়েছেন। এই আবিষ্কারের পথে কত জাগতিক সমস্যা তাঁর চোখে পড়েছে। তিনি সেগুলি দর্শন করেই ক্ষান্ত হননি, আপন অসাধারণ মনীষা ও সত্যদৃষ্টির সহায়তায় সেগুলির সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। জগতের চিরন্তন সমস্যাবলি তাঁকে বার বার বিচলিত করেছে। ‘বিবিধ প্রবন্ধ’-নামক প্রবন্ধগ্রন্থের ‘সাম্য’, ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রভৃতি চিন্তাশীল প্রবন্ধ মারফৎ তিনি ওই সকল সমস্যা বিভিন্ন দিক হতে আলোচনা করেছেন। তবু যেন এতে তিনি তৃপ্তিলাভ করেননি। জগৎ ও জীবনের মূল সমস্যার উপর অভিনব চিন্তাধারায় আলোকপাত করবার জন্য কমলাকান্তের দপ্তরের অবতারণা করেছেন।

‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি কমলাকান্তের দপ্তরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের উপর আলোকপাত করেছেন। অন্তরের সুগভীর দেশাত্মবোধ ও ফরাসি দার্শনিক রুশোর রচনাবলির প্রেরণায় তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মূলতত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব বঙ্কিমের উপর গভীরভাবে পড়ে তাঁকে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণীপ্রচারে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ‘সাম্য’ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের এই সমাজতান্ত্রিক চেতনার সুন্দর পরিচয় ফুটে উঠেছে। ‘সাম্য’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্যই লঘুসুরে ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে পরিবেশিত হয়েছে। ড. অধীর দে বলেছেন, “কূট তর্কবহুল বিষয়ের বিচার মীমাংসা হাস্যরসিকতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করবার অনন্যসাধারণ ক্ষমতা বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল। ‘বিড়াল’ নামক রচনা হতে তা প্রমাণিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এই রূপকাত্মক রচনাচিত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রবাদ ও ধনতন্ত্রবাদ এই দুইটি পরস্পরবিরোধী মতবাদের বৈশিষ্ট্য যুক্তিতর্ক সহকারে বিবৃত করেছেন। চতুষ্পদ জন্তু বিড়াল সাম্যবাদী সমাজের প্রতিনিধি ও উকিল, এবং কমলাকান্ত পুঁজিবাদী ধনিক সম্প্রদায়ের প্রতিভূরূপে এতে চিত্রিত হয়েছেন। এই দুই বিপরীতমুখী মতাদর্শ অবলম্বন করে বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে বিশুদ্ধ একটি রাষ্ট্রনীতিমূলক বুদ্ধিনিষ্ঠ প্রবন্ধ রচনা করা সম্ভব হত ; কিন্তু এখানে নিছক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ রচনার মধ্যে দিয়ে মূল উদ্দেশ্য প্রকাশের অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। রাজনৈতিক জটিল মতবাদের অন্তঃগূঢ় তত্ত্ব শ্লেষাত্মক রেখাচিত্রের আবরণে বঙ্কিমচন্দ্র দুগ্ধাপহারক বিড়াল ও আফিমসেবী কমলাকান্তের সরস ইঙ্গিতপূর্ণ কথোপকথনের মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেছেন। ফলে বুদ্ধিগ্রাহ্য রাষ্ট্রীয় মতবাদ অপেক্ষাকৃত সহজ ও চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে। দরিদ্র সর্বহারা ব্যক্তিদিগের ব্যথা বেদনা এবং চুরি প্রবঞ্চনা প্রভৃতি সামাজিক দুর্নীতির মূল উৎস সন্ধানে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচনামধ্যে যে বাস্তব সত্যের আলোকপাত করেছেন, তা যেমন মর্মস্পর্শী, তেমনি তাঁর কৌতুকমিশ্র বিগন্ধ মনের দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়েছে।

সৃষ্টির আদিতে ধনী-দরিদ্রে কোনো ভেদ ছিল না। সভ্যতাবিকাশের সঙ্গে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে মানব-মূল্যায়ন শুরু হল। এর পরই ধনী-দরিদ্রে বিরাট সামাজিক অসাম্য দেখা দিল। জগতের যাবতীয় ভোগ্যবস্তুর উপর ধনীর একচেটিয়া অধিকার জন্মে। প্রবঞ্চিত দরিদ্র সম্প্রদায়ের অভাবে স্বভাব নষ্ট ছিল। তারা বাধ্য হয়ে চুরি ডাকাতি শুরু করল। কমলাকান্ত ও বিড়ালের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এই তত্ত্বটি সুন্দররূপে প্রকাশিত হয়েছে।

রাত্রের আহারের বিলম্ব আছে। কমলাকান্ত হুঁকাহাতে অর্ধসুপ্ত অবস্থায় চারপায়ীর উপর শুয়ে উদ্ভট চিন্তা করছিলেন। ইতিমধ্যে হঠাৎ একটি ক্ষুদ্র বিড়াল তাঁর জন্য রক্ষিত দুধ খেয়ে ফেলল। কমলাকান্ত লাঠি নিয়ে তাকে মারিতে যেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলে আফিমের প্রভাবে দিব্যকর্ণ পেয়ে বিড়ালের কথা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন।

বিড়ালের বক্তব্য হল যে, এ সংসারের ক্ষীর, ননী, ছানা প্রভৃতি ভালো ভালো ভোগ্যবস্তুর ওপর মানুষ ও বিড়ালের সমান অধিকার আছে। অথচ মানুষ বিড়ালকে বঞ্চিত করে একাকী ওই সমস্ত ভোগ করে। এটা অত্যন্ত অন্যায়। কিছু না খেতে পেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে সে চুরি করে। বিড়াল কমলাকান্তকে বলেছে “দেখ, আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কি সাধ করে চোর হয়েছি ? খেতে পেলে কে চোর হয় ? দেখ যারা বড়ো বড়ো সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠে, তাঁরা অনেক চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তাঁদের চুরি করবার প্রয়োজন নেই বলে চুরি করে না। কিন্তু তাঁদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকতেও চোরের প্রতি যে মুখ তুলে চাহে না, এতে চোর চুরি করে। অধর্ম চোরের নয়—চোরে যে চুরি করে, সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শত গুণে দোষী। চোরের দণ্ড হয়; কিন্তু চুরির মূল যে কৃপণ, তার দণ্ড হয় না কেন?” দরিদ্রের চুরির মূল কারণ ধনীর ‘অপরীসীম ধনসঞ্চয়-প্রবণতা। মানুষের স্বভাব ধনীকে সাহায্য করা। দরিদ্রের ব্যথায় কেউই কর্ণপাত করতে চায় না। সংসারের দৈনন্দিন যাত্রাপথে প্রতিদিন অসংখ্য দরিদ্রকে কাতর কণ্ঠে ভিক্ষারত দেখা যায়। তাদের আর্তনাদে সহানুভূতিশীল হয়ে খুব কম লোকই তাদের সাহায্যার্থে অগ্রসর হয়। অথচ কোনো বড়োলোকের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটলে অন্য অবস্থা। সকলেই বড়োলোকের দুঃখে কাতর হয়ে হায় হায় করে। বিড়ালের কণ্ঠে মানবের এই বিচিত্র সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রূপাত্মক প্রতিবাদ ধ্বনিত—“তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ—দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বুঝে না! যে খাইতে বললে বিরক্ত হয়, তার জন্য ভোজের আয়োজন করো—আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহ্বানেই তোমার অন্ন খেয়ে ফেলে, চোর বলে তার দণ্ড করো—ছি! ছি!”

দরিদ্র সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিস্বরূপ বিড়াল আরও জানিয়েছে যে, ধনিক সম্প্রদায় খাদ্যদ্রব্য ফেলে দেয়, নষ্ট করে, তথাপি দরিদ্রকে দেয় না। দরিদ্রের প্রতি তাদের সামান্যতম সহানুভূতিও নেই। তারা ভাবে তাদের করুণ আর্তনাদ চতুর্দিকে ধ্বনিত হয়, তথাপি ধনিক সম্প্রদায় ভ্রুক্ষেপ করে না। উপরন্তু দরিদ্রের প্রতি আছে তাদের অপরিসীম ঘৃণা। দরিদ্র সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরূপে বিড়াল যে প্রশ্ন করেছে, তার মাধ্যমে সমাজসমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়—“চোরের দণ্ড আছে, নির্দয়তার কি দণ্ড নাই ? দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দণ্ড আছে, ধনীর কার্পণের দণ্ড নেই কেন ? যদি করল, তবে সে তার খেয়ে যা বেয়ে পড়ে, তা দরিদ্রকে দিবে না কেন ? যদি না দেয়, তবে দরিদ্র অবশ্য তার নিকট চুরি করে; কেন ? না, অনাহারে মরিয়া যাবার জন্য এ পৃথিবীতে কেই আসেনি।”

বিড়ালের মুখ দিয়ে ধনিক সম্প্রদায়ের প্রতি দরিদ্রের চিরন্তন প্রশ্নগুলি উচ্চারিত। ধনিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরূপে কমলাকান্তের নিকট বিড়ালের বক্তব্য “সমাজতান্ত্রিক” মনে হয়েছে। তাঁর মতে ধনী যদি ইচ্ছানুসারে ধনসঞ্চয় করে চোরের জ্বালায় নির্বিঘ্নে ভোগ না করতে পারে, তবে ধনী ধনসঞ্জয় করবে না। ফলে সমাজের ধনবৃদ্ধি হবে না। বিড়ালের বক্তব্য “সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধনবৃদ্ধি। ধনীর ধনবৃদ্ধি না হলে দরিদ্রের কি ক্ষতি ?” ধনতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী কমলাকান্ত বুঝাতে চেয়েছেন, সামাজিক ধনবৃদ্ধি ছাড়া সমাজের উন্নতি নেই। বিড়াল এই ফাঁকা কথার মধ্যে না গিয়ে বলল যে দরিদ্র যদি না খেয়ে মরে, তবে সমাজের উন্নতিতে তার কি আসে যায়। কমলাকান্তের বলবার মতো কিছু ছিল না। তিনি বিড়ালকে এসব চিন্তা না করে ধর্মচিন্তায় মন দিতে বলেছেন।

এইরূপে ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে বিড়াল ও কমলাকান্তের কথোপকথনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্যজনিত ধনী-দরিদ্রের সামাজিক অসাম্যের একটি সুন্দর চিত্র পরিস্ফুট। বস্তুত পৃথিবীর এই প্রধান সমাজসমস্যাকে বঙ্কিমচন্দ্র যেভাবে সামান্য একটি বিড়ালের বক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থিত করেছেন, তাতে একেধারে তাঁর প্রতিভা ও অন্যধারে গভীর সমাজচেতনার পরিচয় পরিস্ফুট। কোনোরূপ জটিল তত্ত্ব বা বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে না যেয়ে শুধুমাত্র লঘু কৌতুকরসকে অবলম্বন করে তিনি যেভাবে এই সমাজসমস্যা ও এর মূল কারণের উপর আলোকপাত করেছেন, তা বাস্তবিকই প্রশংসনীয়।