শুধু বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র গদ্য রচনাবলীর মধ্যেই নয়, বাংলা গদ্য সাহিত্যেও ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ তার অভিনব আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যে তুলনাহীন। সেই বিচিত্র আঙ্গিকের জন্যেই এই রচনায় একদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের দেশাত্মবোধ ও প্রীতি তত্ত্বের আত্মপ্রকাশ, অন্যদিকে খেয়ালি কল্পনার সঞ্চরণ লক্ষ্য করি, ঐকতান সংগীতের মতো তারা এক গূঢ় সুরসঙ্গতিতে সমন্বিত হয়েছে, রচনার সমগ্র বিন্যাসে কোনো ছন্দপতন ঘটায়নি, এটাও আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। কমলাকান্তের দপ্তরের এই আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সুন্দরভাবে নির্দেশ করেছেন; ‘গোধূলিসন্ধ্যার একখণ্ড ক্ষুদ্র মেঘ যেমন দেখিতে দেখিতে সমস্ত আকাশ পরিব্যাপ্ত করে, ইহার চারিদিকে যেমন বর্ণালী-মায়া অদৃশ্য চিত্রকরের সমাবেশ-সুষমার এবং স্বপ্নালোকের সুসম্বন্ধ চিত্ররূপে প্রতিভাত হয়, কমলাকান্তের প্রবন্ধগুলির মধ্যেও তেমনি ভাবোচ্ছ্বাসের একটি বিন্দু মনোলোকে ঘন হইয়া উঠে, নানা বর্ণের সংমিশ্রণে নানা সুরের সমবায়ে একটি অপরূপ সত্তা গ্রহণ করে। ও অন্তঃসঙ্গতি ও প্রাণলীলার স্পন্দনে একটি চিরন্তন অধ্যাত্ম সত্যরূপে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়। মনের একটি আকুতি, বেদনার একটি স্পন্দন, কল্পনার একটু উচ্ছ্বাস, জীবনানুভূতির একটি তরঙ্গলীলা বঙ্কিমের ভাবলোকে একটি সুষ্ঠু সুগঠিত অবয়বে সংহত হয়, একটি অলক্ষ্য যোগসূত্রের টানে নানা সমধর্মী চিন্তাভাবনাকে আকর্ষণ করিয়া নিজের অঙ্গীভূত করে ও পরিশেষে একটি নানা তন্ত্রীসমন্বিত স্বরসঙ্গতিতে (harmony) পরিণত হইয়া অন্তর-গভীরে একটি অপরূপ সঙ্গীতের অনুরণন তুলিতে থাকে। বঙ্কিমের রচনায় প্রসঙ্গ পরিবর্তন সাধিত হয়, কোন বহিরঙ্গমূলক যুক্তিপারম্পর্যের দ্বারা নহে একটি নিগূঢ় মর্মানুভূতির অনুসরণে, উহার অন্তর্নিহিত প্রাণলীলার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রসারণে। ……বঙ্কিমের সমস্ত মনন আসিয়াছে কমলাকান্তের আধপাগল জীবন রহস্যের মধ্যে গভীর নিমজ্জিত বিশেষ মনোভঙ্গীর তির্যক পথ বাহিয়া যুক্তিধর্মী আলোচনায় সকলের চলা রাজপথ দিয়া নহে।’
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর জীবনবোধের অবাধ, স্বচ্ছন্দ প্রকাশ এবং কল্পনার বাধাবন্ধনহীন মুক্ত লীলার রূপদানের জন্যই তার বাহন হিসেবে অর্ধোম্মাদ আফিমের নেশাখোর, সমাজ সংসারের বন্ধনবিহীন, নিজের খামখেয়াল অকুণ্ঠিত কমলাকান্তের বিচিত্র চরিত্রের পরিকল্পনা করেছেন। দেশাত্মবোধ এবং মানব প্রীতিই মনুষ্য জীবনের চরম সার্থকতা এই তত্ত্ব ভাবনা তাঁর জীবনবোধের প্রধানতম দুটি দিক। বঙ্কিমের দেশাত্মবোধের পরিচয় কিছুটা পরিমাণে ‘আমার মন’ প্রবন্ধে এবং ‘আমার দুর্গোৎসব’-এ পরিপূর্ণ ও উজ্জ্বলভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। ‘আমার মন’ রচনাটিতে বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের উক্তির মাধ্যমে তাঁদের স্বদেশের কল্যাণ চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ভারতবর্ষের মহান লোকশিক্ষকদের জীবনের চরম সার্থকতা কি সেই সম্পর্কিত শিক্ষা বিস্মৃত হয়ে এদেশের ইংরেজি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা ইংরেজ প্রভুদের বাহাসম্পদের আরাধনার প্রভাবে যেভাবে মানব ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে, তার জন্য গভীর বেদনা ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরসুখবর্ধন ছাড়া মানুষের স্থায়ী সুখের আর কোনো ভিত্তি নেই, কথাটি প্রাচীন। আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধদেব এই কথা কতভাবে বলে গেছেন, তারপর শত সহস্র লোকশিক্ষক শত সহস্র বার এই শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ কিছুতেই আত্মকেন্দ্রিকতার মায়াজাল ছিন্ন করতে পারে না। তার ওপর আমাদের দেশ ইংরেজ শাসনাধীন হবার পর ইংরেজ শাসন, ইংরেজি সভ্যতা ও ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বাহাসম্পদের প্রতি অনুরাগ এসে এ দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাহাসম্পদ ইংরেজ জাতির বড়ো প্রিয় এটাই ইংরেজি সভ্যতার প্রধান লক্ষণ, বাণিজ্য বৃদ্ধিতে রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতির স্থাপনে ইংরেজদের ভারতবর্ষের বাহাসম্পদ বৃদ্ধির পরিচয় জাজ্বল্যমান। এদের ইংরেজি শিক্ষাভিমানী ব্যক্তিরা তাতেই আকৃষ্ট হয়ে বাহাসম্পদকে ভালোবেসেছে, তার আরাধনায় ভারতবর্ষের প্রাচীন আদর্শগুলিকে বিসর্জন দিয়েছে। কমলাকান্তের মাধ্যমে স্বদেশের কল্যাণের জন্য উৎকণ্ঠিত বঙ্কিম তাঁদের দেশবাসীর সামনে এই প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। এই রেলওয়ে টেলিগ্রাফে মানুষের মনের সুখ কতটুকু বাড়বে, তার নিরাশ্রয়, শূন্যতায় ক্লিষ্ট মনকে এই বাহ্যসম্পদ আশ্রয় দিতে, আশ্বস্ত করতে পারবে, কারো মনের অশান্তির আগুন নির্বাপিত করতে পারবে?’ এদেশের ইংরেজি, বাংলা সংবাদপত্র, সাময়িক পত্র, বক্তৃতা, বিতর্ক সব কিছুতেই এই বাহ্যসম্পদের প্রশস্তি শোনা যায়। অ্যাডাম স্মিথ, জেমস্ মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রভৃতি ইংরেজ উপযোগবাদের প্রবক্তাদের মানব সভ্যতার মূল ভিত্তিরূপে বাহাসম্পদ বৃদ্ধির তত্ত্ব থেকে এই ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তার পূজার মন্ত্রকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই বৈষয়িক সম্পদে ক’জন অভদ্ৰ ভদ্ৰ হয়েছে, ক’জন অশিষ্ট শিষ্ট, ক’জন অধার্মিক ধার্মিক, ক’জন অপবিত্র পবিত্র হয়েছে? বাহ্যসম্পদের পূজারীরা বলবে, এই উদর পূর্ণ তথা তার ক্ষুধা প্রতিদিন দূর করা চাই, যাতে সকলেরই উদর ভালো করে পূর্ণ হয়, তারা তারই জন্য সচেষ্ট। কিন্তু সেই কাজে তারা এত ব্যস্ত যে অন্য সব কথা ভুলে গেছে, মনের সুখ বৃদ্ধি তার থেকে স্বতন্ত্র, মানুষে মানুষে প্রীতি বৃদ্ধির কথা ভাবতে হবে।
‘আমার দুর্গোৎসবে’ কমলাকান্তের মধ্যে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের দেশাত্মবোধের ঐকান্তিক আবেগ প্রত্যক্ষভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। কমলাকান্ত যে অন্ধকার কালস্রোতে দেশজননীর দশভুজা দেবী মূর্তিতে উদ্ভাসিত হতে দেখেছে, তার এই বর্ণনা দিয়েছে। ‘দেখিলাম—অনন্ত অকুল, অন্ধকারে বাত্যাবিক্ষুব্ধ তরঙ্গসঙ্কুল সেই স্রোতে মধ্যে মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রগণ উদয় হইতেছে, নিভিতেছে আবার উঠিতেছে। আমি নিতান্ত একা একা বলিয়া ভয় করিতে লাগিল—নিতান্ত একা—মাতৃহীন।—মা! মা! করিয়া ডাকিতেছি। আমি এই কাল সমুদ্রে মাতৃসন্ধানে আসিয়াছি। কোথা যা। কই ‘আমার মা’? এই কালস্রোত যে পরাধীনতার অন্ধকার আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারি, এই অন্ধকারে আকুল বেদনায় দেশজননীর সন্ধানের এই বর্ণনায় আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের দেশাত্মবোধের আবেগকে, সেই আবেগে কম্পমান তাঁর হৃদয়ের কণ্ঠস্বরটিকে অভ্রান্তভাবেই শুনতে পাই। সেই কালসমুদ্রের কমলাকান্তের দেশজননীর এই দুর্গা-রূপের বর্ণনায় তার স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র পরাধীনতার গভীর বেদনায় যেভাবে নিজের সমস্ত হৃদয় দিয়ে দেশজননীর কাঙ্ক্ষিত মূর্তি ধ্যান করেছিলেন তার অভ্রান্ত পরিচয় মেলে। চিনিলাম, এই আমার জননী জন্মভূমি—এই মৃন্ময়ী মৃত্তিকারূপিণী-অনন্তরত্নভূষিতা—এক্ষণে কালগর্ভে নিহিতা। রত্নমণ্ডিত দশভুজা দশদিক্-দশদিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা আয়ুধরূপী নাশশক্তি শোভিত। পদতলে শত্রু-বিমর্ষিত বীরজন কেশরী শত্রু-নিপীড়নে নিযুক্ত। এ মূর্তি এখন দেখিব না, কাল দেখিব না— কালস্রোতে পার না হইলে দেখিব না—কিন্তু একদিন দেখিব—দিগভুজা নানা গ্রহণ প্রহারিণী শত্রুমর্দিনী, বীরেন্দ্রপৃষ্ঠবিহারিণী–দক্ষিণে লক্ষ্মীভাগ্যরূপিণী, বামে বিদ্যাবিজ্ঞানমূর্তিময়ী, সঙ্গে বলরূপী কার্যসিদ্ধিরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোতোমধ্যে দেখিলাম, এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা। পরাধীনতার অন্ধকারে দেশজননীর এই মূর্তি এখন দেখা যাবে না, কিন্তু একদিন তাঁকে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হবে—বঙ্গিমচন্দ্র এই বর্ণনার মধ্য দিয়ে দেশচেতনার সেই দুর্মর স্বপ্ন, জাতীয় জীবনের পুনরুজ্জীবনের সেই অভীষ্মা তাঁর দেশবাসীদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের মানবপ্রীতি তত্ত্বের আত্মপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় ‘একা-কে গায় ঐ’ এই প্রবন্ধ দুটিতে। একায় কমলাকান্তের প্রৌঢ় বয়সের আশাভঙ্গ ও নিঃসঙ্গতার বেদনার পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর মানব প্রীতির তত্ত্ব ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রির সৌন্দর্য দর্শনে উৎফুল্ল একজন পথিক তার মধুর কণ্ঠের গানের মধ্যে মনের সুখের মাধুর্য বিকীর্ণ করে যাওয়ার সময় বহুকাল বিস্মৃত সুখ স্বপ্নের স্মৃতির মতো ওই সুন্দর সংগীত কমলাকান্তের কানে প্রবেশ করে, সেই সংগীত কেন তার হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে সে তার কারণ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়। রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী নদী তীরে চাঁদের কিরণের হাসি, অর্ধাবৃতা সুন্দরীর নীল বসনের মতো শীর্ণশরীরা নীল সলিলা তরঙ্গিণী রাজপথে বালক-বালিকা, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়া বৃদ্ধা চাঁদের কিরণে স্নাত হয়ে আনন্দিত। শুধু কমলাকান্তই আনন্দহীন, কারণ সে একা, নিঃসঙ্গ, তাই ওই সংগীতে তার হৃদয় যন্ত্র বেজে ওঠে। পথচারীর সেই সংগীত একবার শোনা মাত্রই তার কেন যে এত ভালো লাগল, সে সম্পর্কে কমলাকান্ত বলেছে, প্রথম যৌবনে চিত্তের প্রফুল্লতার জন্যই সে জগৎ ও জীবনের সমস্ত কিছুতেই সৌন্দর্য দেখতে পেত এবং আনন্দ অনুভব করত, তখন সংগীত শুনে তার আনন্দ হত। এই প্রৌঢ় বয়সে চিত্তের সেই প্রফুল্লতা তিরোহিত হয়েছে বলেই সংগীত তার এখন ভালো লাগে না। কমলাকান্ত বনের ভেতর মন লুকিয়ে সেই বিগত যৌবনের সুখচিন্তা করছিল সেই সময় এই পূর্ব স্মৃতিসূচক সংগীত তার কানে প্রবেশ করে, তাই তা তার কাছে এত মধুর লাগে।
মানুষ জীবনের পথ যতই অতিবাহিত করে ততই সুখকর সামগ্রী সঞ্চয় করে চলে, এই প্রৌঢ়ত্বে কমলাকান্তের সুখের অর্জন অনেক। কিন্তু চিত্তের সেই প্রফুল্লতা, সেই সুখ আর নেই, তার একমাত্র কারণ, যৌবনের সব থেকে বড়ো সম্বল আশারূপ রঙিন কাচ মানুষ হারিয়ে ‘বসে’। যৌবনে অর্জিত সুখ সামান্য, কিন্তু সুখের আশা পরিমিত। এই প্রৌঢ়ত্বে কমলাকান্তের সুখের অর্জন অনেক, কিন্তু সেই বিশ্ব বিস্তীর্ণ আশা কোথায়। প্রৌঢ় বয়সের অভিজ্ঞতায় তাপদগ্ধ কমলাকান্ত এখন বুঝেছে, সংসার-সমুদ্রে সাঁতার দিতে আরম্ভ করলে তরঙ্গে তরঙ্গে প্রহত করে তাকে আবার তীরে ফেলে রেখে যাবে; প্রাপ্তি, আশা-স্বপ্ন সাধের পূর্ণতা নয়, আঘাত-বঞ্চনা-নৈরাশ্য নিষ্ফলতাই জীবনের বাস্তব অমোঘ সত্য। এখন সে বুঝেছে, কুসুমে কীট আছে, কোমল পল্লবে কণ্টক আছে, আকাশে মেঘ আছে। কিন্তু সেই সংসারে সংগীতের পরিবর্তে কমলাকান্ত এখন যা শুনছে তা অধিকতর প্রীতিকর : ‘প্রীতি সংসার সর্বব্যাপিনি—ঈশ্বরই প্রীতি। প্রীতি আমার কর্ণে এক্ষণকার সংসার-সংগীত। অনন্তকাল সেই মহাসংগীতের সহিত মনুষ্য-হৃদয়তন্ত্রী বাজিতে থাকুক। মনুষ্য জাতির উপর যদি আমার প্রীতি থাকে তবে আমি অন্য সুখ চাই না।’
কমলাকান্তের দপ্তর-এর ‘আমার মন’-এ ভিন্নরূপে ও ভঙ্গিতে বঙ্কিমচন্দ্রের মানবপ্রীতি তত্ত্বের আত্মপ্রকাশ লক্ষণীয়। ভোজন রসিক কমলাকান্ত প্রথমে পানশালায় নানা সুখাদ্য বস্তুতে, পরে পথে কলসী কাঁখে রূপলাবণ্যের তরঙ্গে উচ্ছ্বলিত এক যুবতীর কাছে নিজের হারানো মনকে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়। সে অনেক অনুসন্ধান করে দেখেছে পরের জন্য আত্মবিসর্জন ছাড়া পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল বা ভিত্তি নেই। অর্থ, খ্যাতি ইত্যাদি ইন্দ্ৰিয়াদিলব্ধ সুখ স্থায়ী হয় না। এগুলি প্রথমবারে যে পরিমাণে সুখদায়ক হয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারে সেই সুখের পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পায়। অভ্যাসের সুখ আর থাকে না। সুখ না থাকুক, তাদের অভাবে গুরুতর অতৃপ্তি দেখা দেয় এবং তৃপ্তিহীন আকাঙ্ক্ষায় যন্ত্রণা বৃদ্ধি হয়। পৃথিবীর যে সমস্ত বস্তু কাম্য বলে আবহমানকাল পরিচিত, তারা সবই অতৃপ্তিকর ও দুঃখের উৎস। খ্যাতির সঙ্গে নিন্দা, ইন্দ্রিয় সুখের জন্য ব্যাধি, ঐশ্বর্যের সঙ্গে খ্যাতি ও মনোকষ্ট—প্রতিটি কাম্যবস্তুর সঙ্গেই অতৃপ্তি ও দুঃখ জড়িত। বিদ্যা তৃপ্তিদায়ক নয়, শুধু অন্ধকার থেকে গাঢ়তর অন্ধকারে মানুষকে নিয়ে যায়। অর্থ বা খ্যাতি অর্জন করে সুখী হয়েছে, একথা কারো মুখে শোনা যায় না। তার থেকে ঐশ্বর্য সম্মান ইত্যাদির নিষ্ফলতার গুরুতর প্রমাণ আর কি হতে পারে। তবু যে মানুষ মাত্রই ধনমানাদির জন্যে লালায়িত হয়ে তাদের জন্য প্রাণপাত করে, তা শুধু কুশিক্ষার প্রভাবে। বিদ্বান, বুদ্ধিমান, দার্শনিক, সংসার তত্ত্ববিদ প্রভৃতি নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধি নিয়ে আস্ফালন করতে পারে, কিন্তু তাদের স্বীকার করতেই হবে যে পরসুখবর্ধন ছাড়া মানুষের অন্য সুখের ভিত্তি নেই। কমলাকান্ত মরে ছাই হবে, তার নাম পর্যন্ত বিলুপ্ত হবে, কিন্তু সে মুক্ত কণ্ঠে বলছে, একদিন মানুষ মাত্রই তার এই কথা বুঝবে যে মানুষের স্থায়ী সুখের আর কোন ভিত্তি নেই। আমরা কমলাকান্তের এই উক্তিতে বঙ্কিমচন্দ্রের মানব প্রীতির আবেগদীপ্ত আত্মপ্রকাশই লক্ষ্য করি।
বঙ্কিমচন্দ্রের খেয়ালি কল্পনার সঞ্চরণে পাঠ্য প্রবন্ধগুলির মধ্যে সবথেকে প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বলভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে ‘আমার মন’ ও ‘বিড়ালে’। ‘আমার মন’ রচনাটির প্রথমেই তাঁর মন কোথায় গেল, কে চুরি করে নিল এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে একজন বন্ধুর পরামর্শ মতো ভোজনপ্রিয় কমলাকান্ত পাকশালায় তার হারানো মনকে সন্ধান করেছে। এই অংশে আমরা কয়েকটি বিচিত্র খেয়ালি কল্পনায় নিজের উদারতা নিয়ে কমলাকান্তকে পরিহাস করতে দেখি, যেমন যেখানে পোলাও, কাবাব, কোতার সুগন্ধ, যেখানে ডেকচী সমারূঢ়া অন্নপূর্ণার মৃদু মৃদু ফুটফুট বুটবুট-টকবকো ধ্বনি সেইখানে আমার মন পড়িয়া থাকিত—কিংবা “যেখানে ছাগ নন্দন, দ্বিতীয় দধীচির ন্যায় পরোপকারার্থে আপনি অস্থি সমর্পণ করেন, সেখানে মাংসযুক্ত সেই অস্থিতে কোরমারূপ বজ্র নির্মিত হইয়া, ক্ষুধারূপ বৃত্রাসুর বধের জন্য প্রস্তুত থাকে আমার মন সেইখানেই ইন্দ্ৰত্ব লাভের জন্য বসিয়া থাকে।” পুরাণের অনুষঙ্গে বিচিত্র কল্পনায় নিজের ভোজনপ্রিয়তার এই সমস্ত বর্ণনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কৌতুকাবহ।
তারপরেই কমলাকান্ত তার খেয়ালি কল্পনার সঞ্চরণে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে উপস্থিত হয়েছে। পাকশালায়ও কমলাকান্ত তার হারানো মনকে খুঁজে পায় না। তার বন্ধু তাকে প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছে তার হারানো মনকে সন্ধান করে দেখতে বলে। সেই সূত্রে সে প্রসন্নর সঙ্গে তার গব্যরসাত্মক প্রণয়ের বর্ণনা দিয়েছে। মোটাসোটা গোলগাল অনুর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়স্কা দাঁতে মিসি, হাসিভরা মুখ, টিপের মতো কপালে একটি ছোটো উলকি এই প্রসন্ন যখন পথে রসের হাসি ছড়াতে ছড়াতে যেত, তখন কমলাকান্ত তা উপভোগ করত। এইজন্য লোকে নিন্দা করত। সেই সম্পর্কে কমলাকান্তের এই আক্ষেপ কৌতুকাবহ : “পূজারি বামনের জ্বালায় বাগানে ফুল ফুটিতে পায় না—আর নিন্দুকের জ্বালায় প্রসন্নর কাছে আমার মুখ ফুটিতে পায় না।” প্রসন্নর প্রতি তার অনুরাগের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে কমলাকান্ত বলেছে, প্রসন্ন তাকে সস্তায় জলহীন দুধ এবং কখনও ক্ষীর, সর ও ননী বিনামূল্যে দেয়, সে তার দপ্তরের কয়েকটি প্রবন্ধ আগ্রহের সঙ্গে শুনেছিল শুধু তাই নয়, তার অনুরোধে আফিম পর্যন্ত ধরেছিল। প্রসন্ন ও তার মঙ্গলা গাইয়ের প্রতি কমলাকান্তের অনুরাগের পৌরাণিক কল্পনাশ্রয়ী এই উক্তি তার স্রষ্টার খেয়ালি কল্পনার সঞ্চরণে এক বিচিত্র ঐশ্বর্য আমাদের সামনে তুলে ধরে : ‘গঙ্গাবিষ্ণুপদ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বটে, কিন্তু ভগীরথ তাঁহাকে আনিয়াছেন; মঙ্গলা আমার বিষ্ণুপদ; প্রসন্ন আমার ভগীরথ; আমি দুজনকেই সমান ভালবাসি। প্রসন্ন এবং তাহার গাই উভয়েই সুন্দরী; উভয়েই স্থূলাঙ্গী, লাবণ্যময়ী এবং ঘটোরী। একজন গব্যরস সৃজন করেন, আর একজন হাস্যরস সৃজন করেন। আমি উভয়েরই নিকট বিনামূল্যে বিক্রীত।’
‘বিড়াল’ আরম্ভ হয়েছে কমলাকান্তের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার এই দৃশ্যে: কমলাকান্ত তার শয়নকক্ষে চারপাই-এ বসে হুঁকো হাতে ঝিমোচ্ছে, অর্থাৎ আফিমের নেশায় তন্দ্রাচ্ছন্ন, একটু মিট মিট করে প্রদীপের ক্ষুদ্র আলো জ্বলছে, দেওয়ালের ওপর তার চঞ্চল ছায়া প্রেতবৎ নৃত্যরত। তারপরেই আমরা পাই তার একটি বিচিত্র ও উদ্ভট কল্পনা, আহার প্রস্তুত হয়নি, সেইজন্য সে হুঁকো হাতে নির্মীলিতনেত্রে ভাবছিল, সে যদি নেপোলিয়ন হত তবে ওয়াটার্লর যুদ্ধে জয়ী হতে পারত কিনা, কমলাকান্তের মতে নসীরাম বাবুর আশ্রয়জীবী একজন নিরীহ বাঙালি ব্রাহ্মণ সন্তানের প্রদীপের স্বল্প আলোয় আলোকিত গৃহকোণে খাটিয়ার ওপর উপবিষ্ট হয়ে হুঁকো হাতে বিশ্ববিখ্যাত বীর নেপোলিয়নের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ওয়াটার্ল যুদ্ধ জয়ের কল্পনার মধ্যে এমন একটা উদ্ভট অসংগতি আছে যে আমাদের হাস্যবেগ অসংবরণীয় হয়ে ওঠে। আফিমের নেশাখোর কমলাকান্তের মাধ্যমে বঙ্কিম এই খেয়ালি-কল্পনার চিত্র উপস্থাপিত করেছেন বলেই তা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। তারপরের কল্পনাটি আরো খেয়ালি ও হাস্যকর এই সময় হঠাৎ মেও করে একটি শব্দ হতেই কমলাকান্তের মনে হল, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্বপ্রাপ্ত হয়ে তার কাছে আফিম ভিক্ষা করতে এসেছে–প্রথম উদ্যমে, পাষাণবৎ কঠিন হইয়া বলিব মনে করিলাম যে, ডিউক মহাশয়কে ইতিপূর্বে যথোচিত পুরস্কার দেওয়া গিয়াছে, এক্ষণে আর অতিরিক্ত পুরস্কার দেওয়া যাইতে পারে না। বিশেষত অপরিমিত, লোভ ভাল নয়। ডিউক বলিল মেও। এভাবেই আমরা কমলাকান্তের দপ্তরে একদিকে বঙ্কিম মানসের দেশাত্মবোধ ও প্রীতিতত্ত্বের আত্মপ্রকাশ, অন্যদিকে খেয়ালি কল্পনার সঞ্চরণ লক্ষ্য করি।
Leave a comment