অসঙ্গতিই হল হাসির মূল কারণ। মানুষের আলাপ আচারণে যখন অপ্রত্যাশিত কিছু লক্ষ্য করা যায় তখনই মানুষ হাসে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “প্রভাতে শ্রীকৃষ্ণ হুঁকা হস্তে কিঞ্চিৎ অঙ্গারের প্রার্থনায় রাধার কুটিরে আগমন করিলেন।” কৃষ্ণের এই ব্যবহারে আছে অসঙ্গতি। এই অসঙ্গতির জন্যেই হাসির উদ্রেক করে। সংস্কৃতে আলংকারিকগণ হাস্যরসের স্থায়ীভাব রূপে ‘হাস’কে নির্দেশ করেছেন। ‘সাহিত্য দর্পণ’কার বিশ্বনাথ কবিরাজ দু’প্রকার হাসির কথা উল্লেখ করেছেন—(স্মিত, হসিত, বিহসিত, অবহসিত, অপহসিত, এবং অতিহসিত)। সেগুলি মূলত কোনো চরিত্র বা ঘটনাকে অবলম্বন করেই কেন্দ্রীভূত হয়েছে। কোনো অদ্ভুত চরিত্র, তার আচার-আচরণ, চলন বলন যেমন হাসির সৃষ্টি করবে, তেমনি অসঙ্গত, বিসদৃশ বা অপ্রত্যাশিত ঘটনাও মানুষকে হাসায়। মূল কথা, অন্যের বিকৃতি ভুল ত্রুটি এবং দোষেও আমাদের হাসি পায়। কারণ আমরা নিজেদের ওই সকল ব্যক্তি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। তবে সাধারণ ভুল বা অন্যমনস্কতা হাস্যরস সৃষ্টির মূল সম্পদ। প্রসঙ্গক্রমে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, “অসঙ্গতি যখন আমাদের মনের অনতি গভীর স্তরে আঘাত করে তখনই আমাদের কৌতুক বোধ হয়।” ‘কমলাকান্তের’ দপ্তর তারই প্রতিভূ।
ইংরেজি সাহিত্যে হাস্যরসকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা—Humur, wit. Satire এবং Fun. সমালোচক ড. অজিত ঘোষ Humour-এর স্বভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন “হিউমারের হাসি প্রবল ও উতরোল নহে, ইহা মৃদু এবং অসুচ্চ।” Humourist জীবনকে দূরবিন দিয়ে দেখেন না, দেখেন মুক্ত ও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে, এখানে সংস্কার বা শোষণের কোনো স্পৃহা নেই, বিদ্রুপের কণ্টক জ্বালা নেই। বুদ্ধি প্রসূত বা মস্তিষ্কজাত যে হাস্যরস তারই নাম wit Wit মূলত বাক চাতুর্যের ওপর নির্ভর করে। এখানে অপরকে আঘাত করার একটা গোপন স্পৃহা থাকে। এর আবেদন কেবলমাত্র বিদগ্ধ শ্রোতার নিকট। পর পীড়নেচ্ছু মনোভাব থেকে যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয় তারই নাম Satire বা ব্যঙ্গরস। অর্থাৎ—“যে হাসি আমাদের মুখকে প্রসন্ন না করিয়া বিষণ্ণ করিয়া তোলে, যাহা আমাদের মন আমোদে উজ্জ্বল না করিয়া আঘাতে দীর্ঘ করিয়া ফেলে তাহা ব্যঙ্গের হাসি।” Satirist কেবল নির্দয় নন, নির্মমও বটে। মানুষের দোষ ত্রুটি তাঁর লেখনীকে শানিত করে তোলে। লঘু কৌতুক হাসির নাম Fun যেখানে মানুষের স্বাভাবিক স্ফূর্ত প্রবণতা বা আমোদপ্রিয়তা প্রাধান্য পায়। এছাড়া আরও দুটি হাসির সন্ধান মেলে— Irony যা বুদ্ধিনির্ভর, অপরটি Sarcasm যাকে বক্রোক্তি হিসাবেই চিহ্নিত করা যেতে পারে।
কমলাকান্তের দপ্তরে Humour. wit-এর পরিচয় মিললেও Satire-এর প্রকাশ সবচেয়ে বেশি লক্ষিত হয়। তবু গ্রন্থে জীবনের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে ও সমালোচনার বিশিষ্ট ভঙ্গিতে বিশুদ্ধ স্যাটায়ারের উদ্ভব হয়েছে। তবে এখানে হাস্যরসের সঙ্গে সোনালি কল্পনা যুক্ত হয়ে তা বিশেষভাবে আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে। তাই হাস্যরস কোথাও অতি সংযত কোথাও বা ঈষৎ বক্র কটাক্ষযুক্ত। কমলাকান্তের দপ্তর একটি তানলয় বিশুদ্ধ সংগীতের মতো আমাদের রসবোধকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দান করে। কমলাকান্তের দপ্তরের একা, আমার মন, মনুষ্যফল, পতঙ্গ বিড়াল, ঢেঁকি, কমলাকান্তের জোবানবন্দি, প্রভৃতি প্রবন্ধে হাস্যরসের নিদর্শন পাওয়া যায়। সমালোচকের ভাষায় : মানুষের জীবনে—“হাসি যেন কান্নার সরোবরে আলোর ফুটন্ত কমল, সেই হাসিই ফুটিয়াছে কমলাকান্তের দপ্তরে। কমলাকান্তের অনুভূতি জীবনের গভীরতম স্তর স্পর্শ করিয়াছে, সেই স্তরে হাসি ও কান্না বিধর্মী নহে, সমধর্মী। একা, আমার দুর্গোৎসব, একটি গীতি ইত্যাদি প্রবন্ধে হাসির বীণা অপেক্ষা কান্নার বাঁশিই বাজিয়াছে।….কমলাকান্তের কান্না মানুষের চিরন্তন দুঃখের জন্য একাকিত্ব, পরাধীনতা, বার্ধক্য প্রভৃতি অনিবার্য ও অপরিমেয় বেদনার জন্য।”
‘আমার মন’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র তত্ত্ব ও রসকে একত্রে স্থাপন করায় প্রবন্ধের উপভোগ্যতা বেড়েছে। প্রীতিতত্ত্বের কথা বলতে গিয়ে তিনি রচনাটির মধ্যে যে ভাবের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তা এককথায় অনবদ্য। কমলাকান্তের রসিকতার মাধ্যমে হারানো মনের সন্ধান করেছেন। সাত পৃথিবী খুঁজেছে তার মনোভাবের সন্ধান না পেয়ে রান্নাঘরে পোলাও, কাবাব, কোফতার সুগন্ধের মধ্যে মনের সন্ধান করায় বিশুদ্ধ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। লুচির সঙ্গে অখণ্ড মণ্ডলাকারের এবং সন্দেশের সঙ্গে শালগ্রাম শিলার তুলনা বঙ্কিমের হাস্যরসিক মনের পরিচায়ক। প্রসন্নের সঙ্গে কমলাকান্তের সম্পর্কের ব্যাখ্যায় বঙ্কিমের সরস মন্তব্য : “প্রসন্নের জন্য আমি দুঃখিত। কেননা প্রসন্ন সতী, সাধ্বী, প্রতিব্রতা। এ কথাও আমি মুখ ফুটিয়ে বলিতে পাই না। বলিয়াছিলাম বলিয়া পাড়ার একটি নষ্ট বুদ্ধি ছেলে ইহার বিপরীত অর্থ করিয়াছিল।” এমনকি কমলাকান্তের নিজের মনের সন্ধানে এক যুবতীর পিছু নেওয়ায় যুবতীর প্রশ্ন : “ও কীও ? সঙ্গ নিয়েছ কেন ?” এখানেই উভয়ের উক্তি প্রত্যুক্তির মধ্যে যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে তা বড়ই অভিনব। এই প্রবন্ধের অন্তিম লগ্নে টাকাকে নিয়ে যে ব্যঙ্গ ও খেয়ালি কল্পনার সৃষ্টি হয়ে তার কৌতুকরস এক কথায় অবর্ণনীয়। “মন আমার কি ? টাকা ছাড়া মন কি ? টাকা ছাড়া আম মন নাই ; টাকশা আমাদের মন ভাঙে গড়ে।”
‘বিড়াল’ প্রবন্ধটিও বঙ্কিমচন্দ্রের শুভ্র হাস্যরসিক মনের পরিচায়ক, এই প্রবন্ধে স্যাটায়ারের সমুজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের সচকিত করে। তত্ত্বের সঙ্গে হাস্যের এমন মেলবন্ধন বাংলা প্রবন্ধে খুব কম লক্ষ্য করা যায়। কমলাকান্তের রাখা দুধ বিড়াল খেয়ে যাওয়ার পর কমলাকান্তের যে দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে রয়েছে সরসতা। যেমন—“এক্ষণে মাজ্জার সুন্দরী, নির্জ্জল দুগ্ধপানে পরিতৃপ্ত হইয়া আপন মনের সুখ এ জগতে প্রকটিত করিবার অভিপ্রায়ে, অতি মধুর স্বরে বলিতেছেন, ‘মেও’।” যেহেতু দুধ কমলাকান্তের বাপের নয়। দুধ মঙ্গলার, দুইয়েছে প্রসন্ন। অতএব সে দুধে বিড়ালেরও অধিকার আছে, তাই কমলাকান্ত রাগ করতে পারে না। তবে চিরায়ত একটা প্রথা আছে—বিড়াল দুধ খেয়ে গেলে তাকে তেড়ে মারতে হয়। তাই কমলাকান্ত সেই প্রথার অবমাননা করতে পারল না। কারণ সে মনুষ্য সমাজে কুলাঙ্গার হতে চায় না। এ কাব্যে কি হাসির ফোয়ারা ছুটতে কোনো অবকাশ রাখে ? এছাড়া কমলাকান্ত স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে যখন বলেনঃ “বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষালাভ ব্যতীত তোমাদের জ্ঞানোন্নতির উপায়ান্তর দেখি না।” কিংবা “তবে ছোটোলোকের দুঃখে কাতর! ছি! কে হইবে ?” অথবা, গৃহমার্জ্জার হইয়া বৃদ্ধের নিকট যুবতী সহোদর বা মূর্খ ধনীর কাছে শতরঞ্জ খেলোয়াড়ের স্থানীয় হইয়া থাকিতে পারিলে তবেই তাহার পুষ্টি।”
এছাড়া কমলাকান্তের দপ্তরের অন্যান্য প্রবন্ধ হাস্যরস সৃষ্টিতে প্রতিনিধি স্থানীয়। যেমন—‘ঢেঁকি’ প্রবন্ধটি হাস্যরসের উৎসার। “যখনই পিছে রমণী পাদপদ্ম ওরফে মেয়ে লাথি পড়ে, তখনই তোমরা ধান ভান।” ‘মনুষ্যফল’ নামক প্রবন্ধে নারিকেলের জলের সঙ্গে নারীর স্নেহের তুলনা করতে গিয়ে কমলাকান্তের সরস মন্তব্য : “তবে ঝুনো হইলে জল একটু কালো হইয়া যায়। রামার মা ঝুনো হইলে পর, রামার বাপ ঝালের চোটে ‘বাড়ি ছাড়িয়াছিল। এই জন্যেই নারিকেলের মধ্যে ডাবেরই আদর।” কিংবা, ‘বসন্তের কোকিল’ প্রবন্ধেও রয়েছে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গরস। যখন নসীবাবুর তালুকের খাজনা আসে, তখনই মানুষ কোকিলে তাঁহার গৃহকুঞ্জ ভরে যায়। কিন্তু যখন নসীবাবুর পুত্রটির অকাল মৃত্যু হল সেদিন নানা অছিলায় কেউ আসেনি। সে সম্পর্কে সরস মন্তব্য “আসল কথা, সেদিন বর্ষা, বসন্ত নহে, বসন্তের কোকিল সেদিন কেন আসিবে ?” এ সমস্তই বিচার করে বঙ্কিমচন্দ্রের হাস্যরস সম্পর্কে একদা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন ‘নির্মল শুভ্র সংযত হাস্য বঙ্কিমই সর্বপ্রথমে বঙ্গসাহিত্যে আনয়ন করেন।” বঙ্কিমচন্দ্র সমকালীন জীবনে সে অসঙ্গতিকে লক্ষ্য করেছেন তাই তার হাস্যরসের প্রকৃতিকে নির্ধারণ করেছে।
সর্বোপরি, বলতে হয়, কমলাকান্ত বঙ্কিমেরই ছদ্মবেশ। সারাজীবন ধরে শুধু উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনা নয়, জীবনের স্বরূপ সম্বন্ধে যা তিনি উপলব্ধি করেছেন, দেশ সমাজ ও ব্যক্তি সম্বন্ধে যা চিন্তা করেছেন, জীবনের নানা জিজ্ঞাসা ও সমস্যা সম্পর্কে যেভাবে চেতনার গভীরে দূর সন্ধানীর আলো নিক্ষেপ করেছেন তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। কমলাকান্ত চিন্তাশীল, কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, স্বদেশপ্রেমিক সবচেয়ে তার আরও একটা বড়ো পরিচয় তিনি মানবপ্রেমিক। তিনি নিস্পৃহভাবে জীবন সমুদ্রে ভাসমান হয়ে সত্য সন্ধান করেছেন। সরস কৌতুক তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, গভীর মানবপ্রীতি এবং নিঃসঙ্গতার জন্য নীরব অশ্রুপাত কেবলই মাত্র কমলাকান্তের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই কৌতুকপূর্ণ বাক্যবাণে সমগ্র মানবসমাজকে বিশ্ব করতে তার চেয়ে বড়ো প্রতিভাধর লেখককে থাকতে পারেন? তাই সমগ্র বঙ্গ সাহিত্যাকাশে তিনি সব্যসাচী।
Leave a comment