“সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিলে না থাকিতে পারে কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন।”- ‘বিড়াল’ রচনায় এই মন্তব্যের আলোকে লেখকের সমাজ মনস্কতার পরিচয় দাও।

কমলাকান্তের দপ্তর বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন দর্শন কিংবা বলা যায় তাঁর আত্মদর্শন। যা আত্মকথনের ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয়েছে। সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনে একান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত বঙ্কিমচন্দ্র নিজের মধ্যে কোথায় যেন এক গভীর শূন্যতা ও নিঃসঙ্গতার বেদনায় আত্মশীল হয়ে পড়েছেন, তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারার মধ্যে নিজের উদ্ভাবনী শক্তিকে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সবসময় অনুসন্ধান করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে রক্ষণশীলতা ও প্রগতিশীলতার এক সার্থক সমন্বয় সাধন করেছে। ‘বিড়াল’ প্রবন্ধটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সমকালীন আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাম্যবোধের চেতনায় উনিশ শতকের মানবতাবাদী দর্শন ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, সমভোগবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, অর্থনীতির ক্ষেত্রে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, সমাজের ধনবৃদ্ধিতে মেহনতী মানুষের ভূমিকা, সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্ব কমলাকান্ত ও বিড়ালের বিতর্কের মধ্যে উত্থাপিত হয়েছে। নবজাগ্রত বোধে উদ্দীপ্ত বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন ভাবনার প্রতিফলন ‘বিড়াল’ শুধু কি তাই, আঙ্গিক রচনার যে উদ্ভাবনী শক্তি, কল্পনা বিস্তারে যে শিল্পচাতুরী প্রত্যুক্তির মধ্যে দিয়ে যে নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়েছে তা বিশেষ শিল্পসৃষ্টির গতি ত্বরান্বিত করেছে।

‘বিড়াল’ এক অসাধারণ মৌলিকতার নিজস্ব বক্তব্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। অনেকের ধারণা কুইন্সের ‘অপিয়াম এটার’ প্রভাব বিড়ালের মধ্যে দীক্ষিত হয়। তবে কমলাকান্তের দপ্তর, এর পশ্চাতে পাশ্চাত্য দার্শনিক রুশো, মিল, বেন্থামের দর্শন তত্ত্বের সুস্পষ্ট প্রভাব দৃষ্ট হয়। ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে বা বিপ্লবের কালে রুশো প্রমুখ সমাজ তাত্ত্বিকের প্রচারিত সমাজ অধিকারের আদর্শ ঊনবিংশ শতাব্দীর চিন্তানায়কদের প্রভাবিত করেছিল, কিংবা ১৮৪৩ খ্রিঃ মার্কস এঙ্গেলসের কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশিত হওয়ায়, এর সঙ্গে বঙ্কিমের সরাসরি যোগ না থাকলেও সমাজতন্ত্রবাদী ও সাম্যবাদী ভাবধারায় তিনি যে প্রভাবিত হয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। আসলে মানবপ্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রজ্ঞা ও মনীষার আলোকে এক গভীর রসদৃষ্টির সাহায্যে সমাজের খুঁটিনাটি অসাম্য বা বৈষম্যের চেহারা উন্মুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি হাকিম, বিচারক। সুতরাং বিড়ালকে যুক্তি-তর্কের বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থিত করে তার নৈতিক ও সামাজিক বক্তব্যকে একপ্রকার বাণীরূপ দিয়ে মূর্ত করে তুলেছিলেন। মূলত বিড়ালকে তিনি সামাজিক অন্যায়াচার ও অসাম্যের শিকার ও নিগৃহীত জনগণের প্রতিভূরূপে ব্যবহার করেছেন এবং তার উক্তির মধ্য দিয়ে ন্যায় বিচার সাম্য ও শোষণ বিরোধী আদর্শ প্রচার করেছেন। প্রচলিত সমাজ বিধান এবং সমাজ শাসকদের নির্লজ্জ ভণ্ডামীর মুখোশও খুলে দিয়েছেন।

সব যুগের মতো আর্থ সামাজিক সমস্যা বঙ্কিমের কালেও ছিল। সেই সমস্যা ও সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ যে সাম্যবাদের আদর্শ—সে কথাই এই প্রবন্ধে লেখক ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। বিড়াল ও কমলাকান্তের কাল্পনিক কথোপকথনের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র সেই সামাজিক ন্যায় ও সাম্যবাদের আদর্শকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, লেখক তাঁর কালে উপলব্ধি করেছিলেন পুঁজিবাদী শোষণের চিত্র। যার মূল বিষয় শ্রেণি বিদ্বেষ। বর্ণবৈষম্যই যে শ্রেণি বৈষম্যের কারণ তাও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। ধর্মের অসমবণ্টনকে রাষ্ট্রশক্তি যদি নিয়ন্ত্রিত করতে না পারে তাহলে শোষণের চেহারা কদাকার হয়ে ওঠে। ধনশক্তির জোরে সমস্ত ভোগ্য বস্তু মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কুক্ষিগত হওয়ার অপরের খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ধনী সম্প্রদায় যদি প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ নিজের ভাণ্ডারে আবদ্ধ না রেখে দরিদ্রের অভাব মোচনে ব্যয় করে তবে সমস্যা উৎকট হতে পারে না। ‘বিড়াল’ প্ৰবেন্ধ সেই ধনতান্ত্রিক সমাজে কীভাবে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে শ্রেণি- বৈষম্য বাড়ে এবং তার ফলে সৃষ্টি হয় সামাজিক অনর্থ, তেমনই চিত্র প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।

বঙ্কিমচন্দ্র এই সামাজিক সমস্যাকে অপূর্ব উদ্ভাবনী শক্তির বলে উপস্থাপিত করেছেন কৌতুক স্নিগ্ধ পরিবেশের মধ্য দিয়ে। আফিং সেবনে ঢুলু ঢুলু নেত্রে যখন কমলাকান্ত কল্পনারাজ্যে ওথাটালুর যুদ্ধে ব্যুহ রচনায় ব্যস্ত তখন একটি বিড়াল নিঃশব্দে তার গৃহে রাখা প্রসন্ন গোয়ালিনী প্রদত্ত একাবাটী খাঁটি দুধ পান করে তৃপ্তিসূচক ধ্বনি উচ্চারণ করেছে। ক্রুদ্ধ কমলাকান্ত যখন তাকে বিতাড়িত করতে গেছে তখন বিড়াল তাকে নিরস্ত করেছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সকলের অধিকারের কথা শুনিয়েছেন। বিড়াল তথা সাম্যবাদীদের মুক্তি এই যে, অনেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন সঞ্চয় করে রাখে, কিন্তু দরিদ্রদের দিকে ফিরেও তাকায় না। ফলে দরিদ্ররা অন্নাভাবে চুরি করে। সুতরাং চুরি করা রূপ অধর্মের জন্য চোরের চেয়ে কৃপণ ধনীই বেশি দোষী, কিন্তু কমলাকান্ত বিরুদ্ধ শক্তিবান আওড়েছেন—ধর্মীরা যদি যথেষ্টভাবে ধন সঞ্চয় করতে না পারে তাহলে সমাজের ধনবৃদ্ধি হবে না, আর সমাজের ধনবৃদ্ধি না হলে সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। উত্তরে বিড়াল যে বক্তব্য আওড়েছেন তা অতিবাস্তবসম্মত—‘আমি’ যদি খাইতে না পাইলাম, তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কী করিব? প্রত্যুত্তরে কমলাকান্ত বলেছেন—“সমাজের দরিদ্রদের প্রয়োজন না থাকিলে না থাকিতে পারে, কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন।”

বিড়াল শোষিত শ্রেণির প্রতিনিধি। কমলাকান্তের উক্তিকে খণ্ডন করতে তাই তার বেগ পেতে হয়না। সে নিৰ্ভীক চিত্তে বলে—“তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ, দরিদ্রের ক্ষুধা কেউ বোঝে না।” সমাজ নামক যন্ত্র ধর্মীয় মনোতুষ্টির জন্য অকারণ অপব্যয় করে। অথচ এই অপব্যয় বুকে দরিদ্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হলে তখন তো একটি বাঞ্ছিত প্রয়োজনীয় মানবিক মূল্যায়ন হিসাবে পরিগণিত হত। বিড়াল আসল খাদ্যবস্তু পায় না, সকলের পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে উদরসাৎ করাই তার জীবন ও জীবিকা। অর্থাৎ সাধারণ দীন দরিদ্র মানুষ ধনীদের উচ্ছিষ্ট বা কৃপাধন্য হয়ে জীবন কাটায়। তাদের জীবন ও জীবিকার মরণ বাঁচনের লড়াই যখন তুঙ্গে ধনী তখন বিলাস ব্যসনে দিন অতিবাহিত করে। অজস্র মানুষকে বঞ্চিত করে একক মানুষ আহার্য সংগ্রহ করে ধনাঢ্য ব্যক্তির শিরোনাম পাবেন এ কোনো সমাজ ব্যবস্থার রীতি হতে পারে ? না—“পাঁচশত দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া একমনে পাঁচশত লোকের আহার্য সংগ্রহ করিবে কেন ?” এই অভিযোগ ও ক্ষুদ্ধতা আপামর বঞ্চিত সাধারণ মানুষের। বঞ্চিত বা লাঞ্ছিত হবার জন্যে কেউ পৃথিবীতে আসেনি। অনাহারে মরবার অধিকার কারো জন্যে নির্দিষ্ট করা নেই। অতএব বেঁচে থাকতে সমাজের সকল বস্তুর ওপর সকলের সমান অধিকার থাকা আবশ্যক।

বঙ্কিমচন্দ্র অবশ্য বিড়ালের নিষ্করুণ মন্তব্যকে একতরফা ভাবে গ্রহণ করেননি। কিংবা একপেশে বৈচিত্র্যহীন লম্বা বক্তৃতার দ্বারা আপন দার্শনিক ভাবনা জ্ঞাপন করেননি। তিনি নানা প্রশ্ন তর্ক বিতর্কের কূটজাল উপস্থাপিত করে রচনাটির মধ্যে একটি দুর্বার নাটকীয় মুহূর্ত দান করেছেন। ফলে দুই নাছোড়বান্দা ব্যক্তিত্বের লড়াইকে বেশ উপভোগ্য করে পরিবেশনের দ্বারা পাঠকের মানসিকতাকে ক্ষণে ক্ষণে ঝালিয়ে নিয়েছেন, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা কমলাকান্তের বাহ্যিক দৃষ্টিতে যেন মানতে চাননি বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে এই প্রসঙ্গ তুলে তিনি বিড়ালের বক্তব্যকে আমাদের কাছে তুলে ধরে পরোক্ষভাবে তাকে সমর্থন করেছেন। সামান্য ছোটো ঘটনা দিয়ে যা মজলিসি ঢঙে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ধীরে ধীরে তা আমাদের চিন্তা ও চেতনার মধ্যে এক বিস্ফোরক ভাবনার বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। বিচারব্যবস্থা, সমাজের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলাকে সর্বজনগ্রাহ্য ও অনুকূল হিসাবে গ্রহণ করবার একটি বিধান হিসাবে গৃহীত হয়েছে। সুতরাং নিরপেক্ষতা বিচারব্যবস্থার কাম্য। তাই বিড়াল প্রশ্ন তোলে—“যে বিচারক চোরকে সাজা দেবেন তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন। তাহাতে যদি তাঁহার চুরি করিয়া খাইতে ইচ্ছা না করে তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন।” এই কথা কয়টির মধ্যে বিচার ব্যবস্থাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিচারক বঙ্কিম যেন নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, বিচারব্যবস্থা যেখানে প্রহসন সমাজের বিবেক ও নীতি যেখানে যেখানে অবহেলিত সেখানে বিড়ালের এই আমোঘ যুক্তি আমাদের কাছে একশোভাগ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।

তাইতো বলতে হয় – বঙ্কিমচন্দ্র পাশ্চাত্য মানবতাবাদীদের আদর্শে মানবকল্যাণ সাধনকে মানবজীবনের এক সুমহৎ ব্রত বলেই গ্রহণ করেছিলেন। জীবন বিমুখ অধ্যাত্ম সাধনা তাঁর ব্রত ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী—’জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। বঙ্কিমচন্দ্র একে মেনে নিয়েছিলেন, আর সেই কথাই প্রকাশ করেছেন ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে। তিনি যে সামাজিক সাম্যের কথা প্রকাশ করেছেন তা মূলত তার উদার মানবপ্রীতি বশত কারণ ধনবৈষম্যের কারণ ও প্রতিকারের উপায় তিনি বের করেননি। তাঁর আলোচনার কেন্দ্রীভূত হয়েছে এক পক্ষের শোষণ ও অন্যপক্ষের কল্পনার মধ্যে, সমাজে ধনী দরিদ্র থাকুক এতে বঙ্কিমের কোনো আপত্তি নেই, তবে এই ধনীক শ্রেণি যদি তাঁদের স্বার্থ কিছুটা ত্যাগ করত, তাদের সংকীর্ণ চিত্তকে কিছু পরিমাণে দূরে সরিয়ে রাখতো তাহলে এই বৈষম্যজনিত সমস্যা বহুলাংশে নিবারিত হত এবং একটা সামাজিক ন্যায় ও সাম্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হত, এটাই ছিল বঙ্কিমের ধারণা। এই মনুষ্যত্ববোধই বিড়াল প্রবন্ধে সাবলীল ভঙ্গিতে রূপায়িত হয়েছে।