“কতকগুলি প্রবন্ধে প্রৌঢ়ত্বের মোহভঙ্গ রঙিন তীব্র অনুভূতিময় উপমার অজস্র প্রাচুর্য ও অপরূপ সুসঙ্গতি ও গভীর ভাবের সুর ঝংকারের সমন্বয়ে ইহারা পূর্ব স্মৃতির আলোচনা লঞ্চ শীর্ষস্থানীয় হইয়াছে।”- “একা-কে গায় ওই” প্রবন্ধে এর সত্যতা কতদূর নিহিত?

‘কমলাকান্ত’ বঙ্গসাহিত্য তথা সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে এক অনন্য সৃষ্টি এ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। অনেকেই ডি. কোয়েনসির-ওপিয়ান ইঁটার সঙ্গে এর সাধন নির্ণয় করতে সচেষ্ট হলেও নিখুঁত পর্যালোচনার দ্বারা উভয়ের বিস্তর পার্থক্য ধরা পড়ে। হয়তো ডি. কোয়েনসির বইটি বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে থাকবেন, নতুবা আফিংখোর, নেশায় বিভোর হয়ে থাকা চরিত্রটিকে নিয়ে প্রাবন্ধিক এত ফলাও করে লিখতেন কিনা সন্দেহ, তবে স্বভাবের দিক থেকে উভয়েই নেশাখোর হলেও কাজ কর্মের মধ্যে পার্থক্য ধরা পড়ে। ডি. কোয়েনসি যেখানে আফিং চড়িয়ে মাতলামোতে ক্ষান্ত থেকেছেন সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তকে দিয়ে নেশা করিয়ে অন্য উদ্দেশ্য সাধন করেছেন। সুস্থ মস্তিষ্কে আমরা যেমন কোনো কাজ করতে বা কারুর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মনে মনে সংকোচ অনুভব করি, সেখানে নেশার আধিক্যে অবলীলাক্রমে মুখে যা আসে তাই বলতে পারি সাধারণ মানুষ তাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে চলতে বাধ্য হবে মাতাল বলেই এমনটি চলছে না এমন অসঙ্গত কাজ ওকে দিয়ে সম্ভব হচ্ছে কিন্তু মাতালদের যে কাজটাকে আমরা অসঙ্গত অবিবেচ্য বলে মনে করছি বঙ্কিমচন্দ্র সেখানে অস্ত্র সায়েন করে অধৃত হয়ে উঠেছেন এবং বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থের অছিলায় সমাজ সভ্যতা, রাষ্ট্রের প্রতি দ্বিধাহীন চিত্তে বিদ্ধোঙ্গার করেছেন। তাঁর সৃষ্টি কমলাকান্তই এই প্রতিবাদের প্রধান পুরোহিত।

স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে আমাদের বাকি থাকে না, পত্রিকা সম্পাদকের কাজ কেবলমাত্র সাম্প্রতিককালের ঘটনাবলিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পত্রিকার পাতায় পাতায় সন্নিবেশিত করা নয়, সমাজের অসঙ্গত ভাবধারা মানবজীবনের অন্যায় কাজকর্ম, রাষ্ট্রের বিদ্বেষপূর্ণ নীতির বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে খবর হয়ে ওঠার মতো একটা বাড়তি দায়িত্ব পত্রিকা সম্পাদকের ওপর বর্তায়, তৎকালীন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজে বঙ্কিমচন্দ্র আত্মনিয়োগ করলে এমন একটা দায়িত্ব তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। প্রতি বারে পত্রিকার পাতায় পাতায় মানব সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গতিহীন চালচিত্রকে হৃদয়রসে জারিত করে। সর্ব সমক্ষে প্রকাশ করতেন। তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধের মধ্যে কমলাকান্তের দপ্তর এমন একটি প্রবন্ধ একজন পত্রিকা সম্পাদক হয়ে আমাদের উচ্চকোটী মানুষের অসঙ্গত জীবন যাপনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া মানেই চারিদিকে কুৎসারচনা, আর পত্রিকার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই বঙ্কিমচন্দ্র একপ্রকার ছদ্মনামেই বলা যায় ‘কমলাকান্তের’ নামে অন্তরের অভিলাসকে বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই সূত্রে বলা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র সম্পূর্ণ রূপে যে এই ছদ্মপথে পা বাড়িয়ে সার্থক হয়েছিলেন তা বিস্তারিত ভাবে বলার আবশ্যক নেই। কমলাকান্ত তাঁর দপ্তরে বসে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করে পত্রিকা সম্পাদক ভীষ্মদেব খাসনবীশের কাছে পাঠিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটা অন্যতম রচনা হল—’একা কে গায় ওই।’

যদি সময়ের স্রোতে বা সমাজের স্রোতে গা ভাসিয়ে বসে থাকা যায় তাহলে হয়তো বহুর কর্ম কোলাহলের মধ্যে অংশগ্রহণ করা যায় কিন্তু কিছু দেখা হয় না, অর্থাৎ সকলের মধ্যে থেকেও যদি নিজেকে বিচ্ছিন্ন না করা যায় তাহলে আসল সত্যের মর্মভেদ করা বড়ো দুরূহ হয়ে পড়ে। তটস্থ বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের মধ্য দিয়ে সেই একাকীত্বের সাধনা করে মূল লক্ষ্যে এগিয়ে গিয়েছেন। একা সে মানুষ তাঁর দৃষ্টিতে মোহ নেই, কিন্তু ব্যথা আসে, সেই ব্যথার শিল্প—”একা কে গায় ওই ।” প্রাবন্ধিক প্রথম থেকেই আমাদের কাছে বিশেষ ভঙ্গিতে এর বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছেন—“বহুকাল বিস্তৃত সুখ স্বপ্নের স্মৃতির ন্যায় ওই মধুর গীতি কর্ণরন্দ্রে প্রবেশ করিল। এত মধুর লাগিল কেন ?” ওই সংগীতের মধ্যে এমন কী আছে যে লেখকের এত ভালো লাগল। এ কি সংগীত ? পথিক পথ দিয়ে আপন মনে গেয়ে চলেছে, আবাল বৃদ্ধ-বণিতা হাস্যোচ্ছ্বলে সেই সংগীতের সুর হৃদয়ঙ্গমে মুখর হয়ে ওঠার সাথে সাথে লেখকের হৃদয়ও আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। কিন্তু বড়ো দুর্ভাগ্যের বিষয় দ্রষ্টা এখানে একামাত্র। একা একা এই সুখ অনুভব করা বড়ো বিষাদের কারণ। তাই স্বগোক্তির ন্যায় তিনি আমাদের জানালেন—“যদি অন্য কেহ তোমার প্রণয় ভোগী না হইল, তবে তোমার মানুষ্যজন্ম বৃথা। “দিনের পর দিন শুধু নিজের কাজে মগ্ন থেকে একাকীত্বের পাষাণ ভার যেন চেপে বসেছে। তাই সুললিত সংগীত যেন একার শুনতে ভালো লাগছে না।”

কোনো ছদ্ম আবরণ নয় কিংবা দ্বিচারিত নয় একেবারে অন্তরের চরমতম সত্যকে উদ্ঘাটন করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক জানালেন পথিকের সংগীত শুনে ক্ষণিক আনন্দ উপভোগ করলেও পর মুহূর্তেই বিষাদের একটা কালো ধোঁয়া তাকে ঢেকে দিল। একদিন যৌবনে আকাশ বাতাস, মাটি, জল, পৃথিবী যারা সুন্দর বলে মনে হত, অনুভবে তিনি জানলেন—যৌবনে বোধহয় ও চোখে একপ্রকার রঙিন কাচ লাগানো থাকত, যার মধ্যে দিয়ে দেখলে সমস্ত সুন্দর বলে মনে হয়। কিন্তু প্রৌঢ়ে এসে সেই রঙিন কাচের আবরণটা ভেঙে পড়ে তাই সমস্তটা ভেঙে পড়ে। এই নিরন্তর জাগতিক চরম সত্যের মোকাবিলা করার জন্যে কয়েকটি সূত্রও বলে দিয়েছেন। যৌবনের স্বপ্নময় সৌন্দর্যকে ধরে রাখবার একমাত্র উপায় হল যদি পরের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করা যায় তাহলে আজীবন সুখী হওয়া সম্ভব। যে পথিকের গান শুনে বৃদ্ধ বয়সে যৌবনের রঙিন দিনগুলির স্বপ্ন একে একে ভেসে উঠেছিল ‘আবার পরক্ষণেই তা একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে। প্রথম থেকেই যদি—“পুষ্প আমাদের জন্যে ফুটে না। পরের জন্যে তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও” এই নীতিকে বলবৎ করা যায় তাহলে বোধ হয় সুখকে চিরদিনের জন্যে ধরে রাখা অসম্ভব হত না।

প্রবন্ধের শেষে লেখক জানালেন—“প্রীতিই সংসারে সর্বব্যাপিনী—ঈশ্বরই প্রীতি। মানুষকে সেবা এবং ভালোবাসার দ্বারা সম্ভব মনের প্রশান্তিকে চিরস্থায়ী করার। তাই—“মনুষ্যজাতীর ওপর আমার প্রীতি থাকে তবে আমি অন্য সুখ চাই না।” যে স্থূল মুখ ক্ষণিক মাত্র তার দ্বারা জীবনকে ভরানো অসম্ভব। চিরস্থায়ী হওয়ার একমাত্র পথ মানুষকে সেবা করা। প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করে যে ক্ষোভ, যে দুঃখ, না পাওয়ার বেদনায় অন্তর বারে বারে কেঁদে কেঁদে ওঠে সেটার হাত থেকে চিরতরে নিস্তার সম্ভব, একমাত্র পরস্পরের মধ্যে প্রেমপ্রীতি ভালোবাসার দ্বারা বন্ধন দৃঢ় করা। ‘একা—কে গায় ওই’ এ আর কেউ নয় আমাদের মধ্যেকার অন্তর পুরুষ। সংসারের জালে আবদ্ধ হয়ে মাঝে মাঝে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করলেও পরে তা গভীর দুঃখে নিমগ্ন হয়ে যায় সব হারানোর ব্যথায়। কমলাকান্তের ওই ব্যথা হয়তো অকারণ। কিন্তু তাতে ফাঁক তা হয়তো মর্মবিদারী, কিন্তু অন্তঃসার শূন্য। ধন চাই, মান চাই—একথা ভাবার মধ্যে তীব্র বাস্তবতা থাকলেও এটাই চরম সত্য নয়। তবে কমলাকান্তের দুঃখ বস্তুভোগের অভাবে নয়, অমৃতের তৃষ্ণাও নয়। এক জাগতিক চির সত্যকে উপলব্ধির দুঃখ। আর এটা তিনি উপলব্ধি করে দেন যৌবনের আরক্তিম দিনগুলিতে নয় প্রৌঢ়ত্বে মৃয়মান আলো-আঁধারে অবস্থান করে। কারণ সমাজ সংসার জীবন সম্বন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা শীর্ষদেশ স্পর্শ করেছে। কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক তা বিচার করার সুবর্ণ সময়।

রবীন্দ্রনাথ একদা বলেছিলেন—“আমি কোথা হইতে আসিলাম কোথায় যাইব, একথা যতক্ষণ না স্থির হইবে ততক্ষণ আমি…কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া ধ্যান করিতে থাকিব। আমি আছি অথবা আমি নাই, অথবা আমি আছিও বটে নাইও বটে, এ প্রশ্নের যতক্ষণ মীমাংসা না হয় ততক্ষণ আমার জীবনে কোনো সুখ নাই।” সুখ কী জিনিস তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে যুগে যুগে কালে কালে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন ভাবে ব্যক্ত করেছেন, সবার মূলেই যে ‘মনুষ্যপ্রীতি’ এবং এর দ্বারা চিরসুখী হওয়া সম্ভব। তাইতো কমলাকান্ত অকপটে স্বীকার করেছেন প্রথম থেকে যা জেনেছি ভুল, যা উপভোগ করেছি অসার মাত্র, যাতে আনন্দ পেয়েছে তা ব্যঙ্গ মাত্র কারণ, “কুসুমে কীট আছে, কোমল পল্লবে কণ্টক আছে, আকাশে মেঘ আছে, নির্মলা নদীতে আবর্ত আছে, ফলে বিষ আছে, উদ্যানে সৰ্প আছে, মনুষ্য হৃদয়ে কেবল আত্মাদর আছে।” এর মধ্যে কোনো উপায়ে নিজেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। হতাশার গভীর অন্ধকার ধীরে ধীরে ঢেকে দেবে। তাই বঙ্কিম প্রীতির মন্ত্রে সমস্ত বিচ্ছিন্নতা এক সূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন।

প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে আকস্মিক ভাবে যে মোহভঙ্গ জমি বেদনার সঞ্চার ঘটেছে তা কমলাকান্তের সামাজিক কিংবা ঐতিহাসিক সম্ভব নয়। তার অনেকটাই একান্ত আত্মগত, অন্যের ক্ষেত্রে তা একেবারে অকারণ হতে পারে, কিন্তু সে সত্যটি প্রকাশ পেয়েছে তা ড. ক্ষেত্রগুপ্তের ভাষায়—‘বন্ধনোত্তীর্ণ মানব হৃদয়ের শাশ্বত আত্মজিজ্ঞাসা।” এই জিজ্ঞাসা যার দুঃখের অধিকাংশ তার ওপরে বর্তালে জয়ের টিকা মাত্র, কারণ বাসনার অচরিতার্থতায় এই জন্ম নয়, বাসনাজয়ী মনুষ্যত্বের আত্মানুসন্ধানেই এর ফল নির্হিত। তাই কমলাকান্ত মানবপ্রীতির ভেলায় চড়ে এই দুঃসাগর অতিক্রম করতে চায়, প্রীতির মন্ত্রই মনুষ্য সংসারের চরমতম সার্থকতা তা তিনি এই প্রবন্ধের মাঝে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন।