প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ থেকেই কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় তার স্বাতন্ত্রের স্বাক্ষর রেখে জন- মানসে তথা কবিতা-প্রিয় মানুষের কাছে জনপ্রিয় কবি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। আধুনিক যুগের এক জটিল কবিব্যক্তিত্বের অধিকারী সুভাষ মুখােপাধ্যায় (জন্ম ১৯১৯)। যুগচেতনা প্রতিটি অনুভূতির স্পন্দন তাঁর কবি-মানসে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এই প্রথম আধুনিক কবিদের মধ্যে একজন কবি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে, সেই রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসাবে বাংলা কবিতা লিখলেন। নজরুল থেকে শুরু করে বিষ্ণু দে পর্যন্ত সাম্যবাদী চিন্তার সপক্ষে কবিতা লিখলেও মার্কসবাদী চিন্তা তাঁদের ক্ষেত্রে সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের মতাে এত স্পষ্ট নয়। পূর্ববর্তী কবিদের মধ্যে অনেকে মার্কসবাদে বিশ্বাসী হলেও তাদের কবিতায় ইউরোপীয় সাম্যবাদের প্রকোপ বেশী। সুভাষ মুখােপাধ্যায় সাম্যবাদী চিন্তা নিয়ে নেমে এলেন জনতার মিছিলে। তাই তিনি যথার্থ অর্থেই ‘পদাতিক’ কবি।
সুভাষ শুধু পদাতিক নন, তিনি চির চলিষ্ণু কবি। ভারত তথা বঙ্গদেশে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ প্রচারের প্রথম যুগেই তিনি মানবতাবাদী মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে কমিউনিজমে দীক্ষিত হন। সুকান্ত ভট্টাচার্য, দীনেশ দাস, অরুণ মিত্র ইত্যাদি তৎকালীন কবিবর্গ সকলেই কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্য রচনা করলেও যে দুজন কবি জনমনের নিকটবর্তী হতে পেরেছিলেন তাঁরা হলেন সুভাষ ও সুকান্ত। সুকান্ত দীর্ঘায়ু হতে পারেন নি। ফলে সংক্ষিপ্ত কবিজীবনে সুকান্তর কবিসত্তার বিবর্তন তেমন লক্ষ্যগােচর হয় না স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু সুভাষ সমগ্র শতাব্দীর চলমান ইতিহাসের প্রত্যক্ষদ্রষ্টা। স্বাধীনতার প্রহসন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের অবক্ষয় ও স্বপ্নভঙ্গ, দুর্নীতি, প্রগতি ও সাম্যবাদী উচ্চ-ভাষণের অন্তরালে কপটতা ও স্বার্থান্ধতা সুভাষের প্রত্যয় ও মতাদর্শে শেষ পর্যন্ত ফাটল ধরিয়ে দেয়। এবং এই যন্ত্রণার প্রতিক্রিয়ায় সাম্প্রতিক সুভাষ হয়ে ওঠেন প্রায় বিপরীত মার্গী। কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় আজও এক অক্লান্ত কবি। রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন ঘটে গেলেও জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আজও তার উত্তপ্ত সহানুভূতি ও বাস্তব সচেতনার পরিচয় মিলবে তার কবিতার সহজ উচ্চারণে।
সুভাষ মুখােপাধ্যায় ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দে পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যজগতে পদার্পণ করেন। তার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থসমূহ— ‘অগ্নিকোণ’ (১৯৪৮), ‘চিরকুট’ (১৯৫০), ‘ফুল ফুটুক’ (১৯৫৭), ‘যত দূরেই যাই’ (১৯৬২), ‘কাল মধুমাস’ (১৯৬৬), ‘এই ভাই’ (১৯৭১), ছেলে গেছে বনে (১৯৭২), ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’ (১৯৭৯), জল সইতে’, ‘যা রে কাগজের নৌকা’, ‘দিন আসবে’, ‘রােদ উঠেছে চলে যাই’, ‘চই চই চই চই’ ইত্যাদি। ‘হাফিজের কবিতা’ ও ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’ নামে অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ দুটিও তার অসাধারণ কাব্যকুশলতার পরিচয় দেয়।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক-এ সুভাষ মুখােপাধ্যায় তার স্বাতন্ত্রের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সেই স্বাতন্ত্রচিহ্নের মধ্যে উল্লেখযােগ্য বস্তুনিষ্ঠা, রােমান্টিকতার বিরােধিতা, প্রেমের প্রতি অনাগ্রহ, ব্যঙ্গপ্রবণতা, বিক্ষোভ বা বিদ্রোহ এবং ঋজু সহজ প্রকাশভঙ্গি। পদাতিক-এর প্রথম কবিতাতেই রােমাণ্টিকতাকে আক্রমণ করে তিনি পাঠককে সময় সচেতন হয়ে ওঠার আহ্বান জানান অতির্যক ভঙ্গিতে—
‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখােমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রােদ সেঁকে চামড়া।’
শুধু সময়-সচেতন করেই সুভাষ ক্ষান্ত হন না। তিনি স্পষ্টত সংগ্রামের ডাক দেন এই প্রথম কবিতাতেই—
‘শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিশ্বাসে আনে লজ্জা,
মৃত্যুর ভয়ে ভীত বসে থাকা আর না
পরাে পরাে যুদ্ধের সজ্জা।’
‘পদাতিক’-এর কবিতাগুলির বৈশিষ্ট্য ছিল তীব্র শাণিত ব্যঙ্গপ্রবণতা ও যৌবনের প্রবল উদ্দীপনা। বধূ কবিতায় তির্যক ব্যঙ্গ দেখি রবীন্দ্রনাথের বধূর প্রতি—
‘পাষাণ-কায়া, হায় রে, রাজধানী!
মাশুল বিনা স্বদেশে দাও ছেড়ে;
তজারতির মতন কিছু পুঁজি
সঙ্গে দাও, পাবে দ্বিগুণ ফিরে।’
কিংবা চাদের রােমান্টিক ভাবমূর্তিকে ভেঙে দিতে সুভাষ উচ্চারণ করেন— ‘বিকৃত মস্তিষ্ক চাদ’, ‘চাদের চোখেতে পড়ুক অন্ধ ছানি’, ইত্যাদি বাক্য বা বাক্যাংশ।
‘পদাতিক’ থেকে ‘চিরকুট’-এ এসে স্যাটায়ারের প্রবণতা কমে এল। যৌবনের উদ্দাম উদ্দীপনাও যেন কিছুটা স্থিত হয়েছে এখানে শিল্পরূপের প্রতি মনােযােগী হতে গিয়ে। এবং এর ফলে ‘পদাতিক’ যেভাবে পাঠককে মুগ্ধ ও আকর্ষণ করে, ‘চিরকূটে’র কবিতাগুলি সেভাবে করে না। ‘চিরকূটে’র অধিকাংশ কবিতায় রাজনৈতিক দলের নির্দেশপত্রের মতাে পথ বলে দেবার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়—
‘শৃংখলিত সেনাপতি,
তাই বলে আমাদের শূন্য নয় তৃণ।’
অথবা-
‘হতাশার কালাে চক্রান্তকে ব্যর্থ করার
শপথ আমার; মৃত্যুর সাথে একটি কড়ার-
আত্মদানের; স্বপ্ন একটা পৃথিবী গড়ার।’
যুদ্ধ এবং মন্বন্তর নিয়ে সার্থক ছােটগল্প বাংলা সাহিত্যে অনেকগুলি রচিত হলেও সার্থক বাংলা কবিতার অভাব ছিল। সুভাষ কয়েকটি আশ্চর্য কবিতায় সে অভাব পূরণ করলেন। চিরকূট গ্রন্থের নাম কবিতায় শােনা গেল ক্ষুধার্ত মানুষের সিংহগর্জন—
‘পেট জ্বলছে, ক্ষেত জ্বলছে।
হুজুর জেনে রাখুন
খাজনা এবার মাপ না হলে
জ্বলে উঠবে আগুন।’
এই পরিস্থিতিতে অধিকাংশ আধুনিক কবি যখন অবক্ষ ও নৈরাশ্যের চিত্রাঙ্কণে ব্যস্ত, তখন সুভাষ শােনালেন ‘দীক্ষিতের গান’—
‘পালাবার পথে ধুলাে ওড়ানাের দঙ্গলে,
ভাই আমিও ছিলাম একজন,
আজ প্রাণপণে তাই
ভীরুতার মুখে লাথি মেরে লালঝাণ্ডা ওঠাই।’
‘অগ্নিকোণ’ কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গণ-অভ্যুত্থানকে কাব্যরূপ দিলেন কবি অসাধারণ গতিময় ছন্দোবন্ধে। রাজনৈতিক উত্তাপ এই বইয়ে সর্বাধিক। ‘চিরকৃটে র ‘স্ট্রাইক স্ট্রাইক’ ইত্যাদি কবিতায় যে রাজনৈতিক উত্তাপ দেখা দিয়েছিল, অগ্নিকোণ-এর কবিতাগুলিতে তারই উর্ধগামিতা লক্ষ্য করা যাবে—
‘দিন এসে গেছে ভাইরে
রক্তের দামে রক্তের ধার শুধবার।
দিন এসে গেছে, ভাইরে
বিদেশীরাজের প্রাণভােমরাকে নখে নখে টিপে মারবার।’
‘অগ্নিকোণ’ কাব্যগ্রন্থেই প্রকাশিত হল সুভাষের স্বতন্ত্র প্রেমচেতনা। আধুনিক কবিরা বাস্তবকে স্বীকার করে নিলেও প্রেমকে কখনাে অস্বীকার করেন নি। বরং রাবীন্দ্রিক প্রেমচেতনাকে অতিক্রম করার প্রলােভনে অনেকেই দেহকেন্দ্রিক জৈব প্রেমের কথা উচ্চকণ্ঠে ঘােষণা করেছেন। কিন্তু প্রথমাবধি সুভাষ মুখােপাধ্যায় তথাকথিত প্রেমের প্রতি কোনাে আগ্রহ বা দুর্বলতা দেখাননি। ফলে তাকে প্রেমহীনতার কবি বলেও উল্লেখ করেন কেউ কেউ। কিন্তু ‘অগ্নিকোণ’ ও পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতে সুভাষ যে প্রেমচেতনার প্রকাশ ঘটালেন, সেই প্রেমও রাজনৈতিক প্রত্যয়ের সঙ্গে অম্বিত। ‘মিছিলের মুখ’ কবিতায় যে প্রেমের উদ্ভাস দেখা দিল, তার উৎস দৈহিক আকর্ষণ নয়, কোনাে হৃদয়গত মােহও নয়; এই প্রেম সংগ্রামী জীবনের প্রেরণাদাত্রী, এ নারী বস্তুত একই কণ্টকাকীর্ণ পথে নায়কের সহযােদ্ধা—
‘মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ,
মুষ্ঠিবদ্ধ একটি শাণিত হাত,
আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত’,
এরপর সেই মুখ দেহ পায় সংগ্রামের পথে ভালােবাসাময় পৃথিবীর উজ্জীবনের সঙ্গে সঙ্গে—
‘অন্ধকারে হাতে হাতে তাই গুঁজে দিই আমি
নিষিদ্ধ এক ইস্তাহার
জরাজীর্ণ ইমারতের ভিৎ ধসিয়ে দিতে
ডাক দিই
যাতে উদ্বেলিত মিছিলে একটি মুখ দেহ পায়
আর সমস্ত পৃথিবীর শৃঙ্খলমুক্ত ভালবাসা
দুটি হৃদয়ের সেতুপথে পারাপার করতে পারে।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর দিনগুলিতে অসফল প্রেমের দীর্ঘশ্বাসও ফুটিয়ে তুলেছেন সুভাষ তার ‘ফুল ফুটুক’ কাব্যগ্রন্থের ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ কবিতায়। কাহিনীধর্মী এই কবিতার বিষয় এক কালাে আইবুড়াে মেয়ের জীবনকথা। কবিতার প্রেক্ষাপটে রয়েছে ব্ল্যাক-আউট, দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের শহরের পথে মৃত্যুর করুণ বাস্তব দৃশ্যাবলী। ‘গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেল’, ‘লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠি’ র মতাে আকাশ ইত্যাদি চিত্রকল্পে স্বপ্নের আবেশ আসে! কিস্তু যন্ত্রণার্ত সময় সেই স্বপ্নকে নিষ্ফল করে দেয়, যার প্রকাশ ঘটে প্রজাপতির প্রতি ‘আ মরণ’ উচ্চারণে।
সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের কবিতার প্রধান গুণ সহজ অথচ অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গি। সুধীন্দ্রনাথের মতাে আভিধানিক শব্দের ব্যবহার বা বিষ্ণু দের প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্য পুরাণের ব্যবহার ও মনন-সর্বস্বতা সুভাষের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে গেল। চলিত ভাষার শব্দ ও বাগবিধি, প্রচলিত ভাষার ও পরিচিত চিত্রকল্পের ব্যবহার তার কবিতাকে সাধারণ পাঠকের কাছে আয়ত্তগম্য করেছে এবং এটিই তাঁর প্রধানতম গুণ। যত দূরেই যাই কাব্যগ্রন্থের মেজাজে কবিতার গল্পের ভঙ্গি পাঠককে অসীম কৌতুহলে টেনে রাখে। বধূর অকস্মাৎ ঔদ্ধত্যে শাশুড়ির মনােভাবটি নিখুঁতভাবে অঙ্কিত। কালাে বধূটির প্রতি শাশুড়ির বিদ্বেষের চূড়ান্ততম মুহূর্তে আমরা জানতে পারি তার ঔদ্ধত্যের অপ্রত্যাশিত সেই কারণটি—
‘বউয়ের গলা; মা কান খাড়া করলেন।
বলছে, দেখাে, ঠিক আমার মত কালাে হবে।
এরপর একটা ঠাস করে শব্দ হওয়া উচিত।
ওমা, বউমা বেশ ডগমগ হয়ে বলছেঃ
কী নাম দেব, জানাে?
আফ্রিকা।
কালাে মানুষেরা কী কাণ্ডই না করছে সেখানে।’
স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রশাসনের দুর্বলতা ও অবক্ষয় কবিকে ব্যথিত করে। ‘কাল মধুমাস’ গ্রন্থে সেই ছায়া পড়তে থাকে। ‘এই ভাই’ কাব্যগ্রন্থ থেকেই দেখা গেল সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তনশীলতা। সাতের দশকে ক্রুদ্ধ একদল যুবকের সবকিছু ওলােটপালট করে দেবার ব্রত কবির চেতনাকে নাড়া দেয়। নকশালপন্থাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ না করলেও তাদের রাজনৈতিক পন্থার পিছনে পূর্বপক্ষীয়দের দায়িত্বটিকে বক্রদৃষ্টিতে দেখলেন ‘পূর্বপক্ষ’ কবিতায়। পূর্বপক্ষীয়দের বক্তব্য হল—
‘বাবাজীবনেরা, ঘরে শান্ত হয়ে বসাে
সাপ আছে, শাঁকচুন্নি আছে।
অন্ধকারে যেতে নেই।’
পচন আর অবক্ষয়ই তবু সুভাষের কাছে শেষ কথা নয়। একটু পা চালিয়ে ভাই’ গ্রন্থের নাম কবিতায় তিনি বললেন— ‘সব আরম্ভেরই একটা শেষ আছে, সব শেষেরই একটা আরম্ভ।’ তাই কবি শুনতে পান ক্লান্ত লেনিন যেন আবার যুগান্তরের ডাক দিচ্ছেন মানুষকে—
‘শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে
একটু পা চালিয়ে ভাই, একটু পা চালিয়ে।’
Leave a comment