ভূমিকা: সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট। তাঁর পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ায়। তাঁর পিতার নাম নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য, মায়ের নাম সুনীতি দেবী। ছোটোবেলা থেকেই সুকান্ত ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতি-সচেতন। তিনি ‘দৈনিক স্বাধীনতা’র কিশোরসভা অংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সুকান্ত তাঁর কাব্যে অন্যায়-অবিচার শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিপ্লব ও মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে তাঁর কবিতা মুক্তিকামী বাঙালির মনে বিশেষ শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। ‘ছাড়পত্র’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ: ‘ঘুম নেই’, ‘পূর্বাভাস’। অন্যান্য রচনা: ‘মিঠেকড়া’, ‘অভিযান’, ‘হরতাল’ ইত্যাদি। তিনি ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের পক্ষে ‘আকাল’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মে মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রতিভাবান এ কবির অকাল মৃত্যু হয়।

সুকান্তের কাব্য চর্চা শুরু ১৯৪০-এর দিকে, যখন তাঁর বয়স চৌদ্দ বছর। সারা ভারতবর্ষে বিশেষত বাংলাদেশে রাজনীতি ক্ষেত্রে কংগ্রেস লীগের আধিপত্য সত্ত্বেও এই পর্যায়ে শ্রমিক-কৃষকেরাও একটা স্বাধীন সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষক সভার মাধ্যমে তারা ব্যাপকভাবে শুরু করে নিজেদেরকে সংগঠিত করার কাজে। তাদের মধ্যে দেখা দেয় এক নতুন জীবন-চেতনা ও প্রাণের এক নতুন স্পন্দন। চল্লিশের দশকের এই রাজনৈতিক অবস্থাকে সুকান্ত তাঁর কাব্য-কবিতায় তুলে ধরেছেন।

বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে সুকান্ত একটা নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর প্রতিভার বিশেষত্ব হলো তিনি অল্প বয়সেই যুগের ব্যথা-বেদনাকে বুঝতে পেরে, দুঃখী মানুষের সেবায় এবং জনযুদ্ধের আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য, মানুষকে নিজ অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রথম নির্দ্বিধায় মানুষের কথা বলেছিলেন। যদিও বাঙালি কবিদের মধ্যে অনেকেই সাম্যবাদী চেতনার তথ্য, সাধারণ মানুষের দুঃখের কথা, সে কথার কাব্যরূপ, শ্রমিক ধর্মঘটের কথা কাব্যের পঙক্তিতে তুলে ধরে তার নিরসনের উদ্দেশ্যে হয়তো আহবানও জানিয়েছেন। তবু তাঁদের সেই সামগ্রিক কাব্য সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অতি সামান্য স্থানই অধিকার করে থেকেছে। কিন্তু সুকান্ত সেদিক থেকে স্বতন্ত্র। তাঁর কৃতিত্ব এখানে যে তিনি রাজনৈতিক জীবনে যেমন, তেমনি কাব্য চর্চার ক্ষেত্রেও ছিলেন অনমনীয়। সুকান্তের কবিতার মতো রাজনীতি ও কবিতার দ্বন্দ্বের সহজ সমাধান- তখন পর্যন্ত তাঁরা করে উঠতে পারেননি। তাছাড়া সুকান্তের মধ্যে শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণি সংগ্রামের ক্ষেত্রে কোন অস্পষ্টতা বা গড়িমসি নেই। জনতার সংগ্রামকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে। এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুকান্ত ভট্টাচার্য কোন আপস চিন্তা-চেতনার অনুসরণ করেননি- এখানেই সুকান্ত স্বতন্ত্র।

রবীন্দ্র-নজরুল-উত্তর বাংলা কবিতার ইতিহাসে যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন অন্যায়-অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর সংগ্রামী সততা নিয়ে তিনি হলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য; যে কবি খুবই অল্প সময়ে জনগণের ও জনমনের অনেক কাছাকাছি পৌছাতে পেরেছিলেন। শোষিত মানুষের জীবন যন্ত্রণা, বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের হুঙ্কারে তাঁর কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন মূলত নতুন যুগ-চেতনার প্রতিনিধি। তিনি বাংলা কাব্যের বা কবিতার ধারায় একটা নির্দিষ্ট দিকনির্দেশ করেছিলেন।

সুকান্ত ভট্টাচার্য আসলে তাঁর বয়স থেকেও বেশি পরিণত ছিলেন। তাঁর মুখের কথা এবং বুকের কথা এক- তার বুকের কথাই মুখে এসে কলমে ভাষা পেতো। বয়সের থেকেও তিনি ছিলেন পরিণত; বোধের জায়গায়ও তিনি ছিলেন অসাধারণ। সমকালীন প্রেক্ষাপটে নজরুল যখন লিখছেন ‘চাঁদ যেন আমার প্রিয়ার নাকের নোলক’- সুকান্ত সেখানে লিখছেন ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’।

কবি সুকান্তের বাল্য, কৈশোর ও তারুণ্য কেটেছে এক রাজনৈতিক অস্থিরতার কালপর্বে। জন্ম মাত্রই কবি স্বদেশকে পরাধীন দেখেছেন। নিজ রচনায় কবির ক্রোধ তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর এই ক্রোধ উৎসারিত হয়েছে সাধারণ বঞ্চিত, শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি স্বতঃপ্রণোদিত ভালোবাসার থেকে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন সুকান্ত। কবিতার আঙ্গিক অনেকটা নজরুলের মতো। বিপ্লবী কবি তাঁর কবিতায় পৃথিবীকে সম্বোধন করে উচ্চারণ করে গণমুখী বাণী,

‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি,

জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি।

অবাক পৃথিবী আমরা যে পরাধীন

অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;

……………………………………………..

এদেশে জন্ম পদাঘাতই শুধু পেলাম,

অবাক পৃথিবী সেলাম, তোমাকে সেলাম।’

 

সুকান্তের এই কবিতাটি বাংলা বিপ্লবী গণমুখী কবিতার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছিল। কবিতাটি এক মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি লাভ করেছিল। সুকান্তের প্রতিটি কবিতাই ছিল গণমুখী প্রতীকাশ্রয়ী। জীবন দর্শনে বামপন্থি এই কবির মতে কৃষক শ্রমিকরাই দেশের প্রকৃত সম্পদ ও শক্তি আর জমিদার, জোতদার, মজুতদারদের সম্পদ বৃদ্ধি পায় এদের শোষণ করেই। শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ মানুষ করেছে প্রতিবাদ। সুকান্তের বহু কবিতায় তা বাণীরূপ পেয়েছে। বহু কবিতায় শোষকের বিরুদ্ধে মায়াবাণী উচ্চারিত হয়েছে। বামপন্থি আন্দোলনে এই কবিতাগুলো থেকে উদ্ধৃত পংক্তিগুলো সেই সময়ে বিশাল জনসমাজকে উদ্বেলিত করেছে। সুকান্তের ‘সিড়ি’, ‘দেশলাই’, ‘কলম’, ‘বোধন’ প্রভৃতি এ পর্যায়ের কবিতা। ‘বোধন’ কবিতার আলোচ্য অংশটুকু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-

“শোনরে মালিক, শোনরে মজুতদার!

তোদের প্রাসাদে জমা হলো কত মৃত মানুষের হাড়-

হিসাব কি দিবি তার?

প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,

ভেঙ্গেছিস ঘরবাড়ি,

সে কথা কি আমি জীবনে মরণে

কখনো ভুলতে পারি?

আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই

স্বজনহারানো শ্মশানে তাদের

চিতা আমি তুলবই।”

(বোধন: ছাড়পত্র)।

সুকান্ত অতি অল্প বয়সেই যুগের ব্যথা-বেদনাকে বুঝতে পেরেছিলেন, দুঃখী মানুষের সেবায় এবং জনযুদ্ধের আন্দোলনে শরিক হবার জন্য, মানুষকে নিজ অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রথম তিনিই নির্দ্বিধায় মানুষের কথা বলেছিলেন। সাম্যবাদী চেতনার তথ্য, সাধারণ মানুষের দুঃখের কথা, সে কথার কাব্যরূপ, শ্রমিক ধর্মঘটের কথা কাব্যের পঙক্তিতে তুলে ধরার কৃতিত্বে সুকান্ত-পূর্ববর্তী বিভিন্ন সাম্যবাদী কবি কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন। কিন্তু সুকান্তের কবিতার মতো রাজনীতি ও কবিতায় দ্বন্দের সহজ সমাধান অন্তত তখন পর্যন্ত তারা করে উঠতে পারেনি। আর এখানেই সুকান্তের স্বাতন্ত্র্য। সুকান্ত ভট্টাচার্য শ্রেণি সংগ্রামের কবি। তিনি সমগ্র কাব্যপ্রচেষ্টাই কিন্তু শ্রেণিচেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ। এ জন্য সারা পৃথিবীর বিস্তীর্ণ পরিসের নানা সমস্যাকে কেন্দ্র করে এবং নানাভাবে তিনি শ্রেণিশোষণ ও শ্রেণিসংগ্রামের কথাই নিজের কবিতায় চিত্রিত ও প্রতিফলিত করেছেন। যেমন-

‘দেখব ওপরে আজো আছে কারা,

খসাব আঘাতে আকাশের তারা,

সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,

ছড়াব ধান।

জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বানঃ’

(বিদ্রোহের গান)।

সুকান্ত চারদিকের পরিবেশ পাঠে বুঝেছিলেন নিদারুণ শোষণ ও শাসনের শৃঙ্খল যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে খসে পড়বে না তার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি, দীর্ঘস্থায়ী এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অপরিহার্য। তিনি মনে করেন রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়েই আসবে প্রকৃত স্বাধীনতা। সুকান্ত ভট্টাচার্য এর মধ্যে শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসংগ্রামের ক্ষেত্রে কোনো অস্পষ্টতা নেই। জনতার সংগ্রামকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুকান্ত যেমন নিজের রাজনৈতিক জীবনে, তেমনি কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে ছিলেন অনমনীয়। সেখানে কোনো আপসের চিন্তা তাঁর চেতনায় ছিল না। ফলে তাঁর কবিতাকে অনেকেই অন্তরাত্মার প্রতিধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

অন্যদিকে সুকান্তের এই স্বচ্ছতা সম্ভব হয়েছিল চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক অবস্থার গুণে। ব্যাপক গণআন্দোলনের তুফানে যে বিদ্রোহ ঘনিয়ে উঠেছিল- তিনি সে সব ক্রান্তিকালকেই তাঁর কাব্যে-কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যেমন-

১. ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ

কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাস,

যে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ

জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।

হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন

জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান,
গত আকাশের মৃত্যুকে মুছে
আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।’

সুকান্ত চারদিকের পরিবেশ পাঠে বুঝেছিলেন নিদারুণ শোষণ ও শাসনের শৃঙ্খল যে স্বতস্ফূর্তভাবে খসে পড়বে না তার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি, দীর্ঘস্থায়ী এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অপরিহার্য। তিনি মনে করেন রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়েই আসবে প্রকৃত স্বাধীনতা।

সুকান্ত পূর্ববর্তী বাংলা কাব্যের কবিদের মধ্যে অনেকেই সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তার নিরসনের উদ্দেশ্যে হয়তো আহ্বানও জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সেই সামগ্রিক কাব্য সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অতি সামান্য স্থান অধিকার করে থেকেছে। তাঁরা কেউই শোষিত জনতার সাথে উপযুক্তভাবে একাগ্রতাবোধ করেননি। ফলে তাঁদের এ জাতীয় রচনা তাঁদের সামগ্রিক রচনার মধ্যে একটা ক্ষুদ্র অংশ অধিকার করেছিলো। কিন্তু সুকান্ত সেদিক থেকে স্বতন্ত্র। তাঁর সমগ্র কাব্য প্রচেষ্টাই শ্রেণি-চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ। বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রে গোর্কি যেমন সচেতনভাবে; শোষক শোষিতের চরিত্র ও পারস্পরিক সম্পর্ককে নিজের সাহিত্যের মধ্যে রূপ দান করেছিলেন। শ্রেণি সংগ্রামের বাস্তব চিত্রকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরে তাদের সেই সংগ্রামকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, বাংলা কবিতার ক্ষুদ্রতর পরিধির মধ্যে সুকান্ত সেই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন।

সুকান্ত ছিলেন শ্রেণি সংগ্রামের কবি। তাঁর মধ্যে শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসংগ্রামের ক্ষেত্রে কোনো অস্পষ্টতা বা গড়িমসি ছিল না। জনতার সংগ্রামকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুকান্ত যেমন নিজের রাজনৈতিক জীবনে, তেমনি কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেও ছিলেন অনমনীয়। তিনি তাঁর কবিতায় শ্রমিক-কৃষক সমস্যাকে যেমন উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন তেমনি তাদের সেই সংগ্রামকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে কবিতা লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে সুকান্তের কবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কবি ও সমালোচক সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন,

“সুকান্তের কবিতা শুধুই বিরাট সম্ভাবনার ইঙ্গিত নয়, তাতে আছে মহৎ পরিণতির সুস্পষ্ট পদধ্বনি।”

তাছাড়া আধুনিক কবিতায় দূরূহ তার দুর্মর অপবাদ ঘোচানোর বিষয়ে প্রথম প্রধান কৃতিত্ব সুকান্ত ভট্টাচার্যের। সুবিস্তৃত মধ্যবিত্ত পাঠককে তিনি নতুন করে কবিতা ধরালেন। রবীন্দ্রকাব্যের শেষ পর্বে যে মানব প্রেম বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার বীভৎস রূপ সম্পর্কে সচেতনতা অভিব্যক্ত তা সুকান্তকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিান রবীন্দ্রকাব্যের এই শেষ টেকনিক সম্বন্ধে সজাগ ছিলেন। অভিজ্ঞতার স্ব-ভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই টেকনিককে সুকান্ত বাস্তবতার পাথরে পাথরে শান দিয়ে তিনি তাকে সর্বশ্রেণির পাঠকের ব্যবহার যোগ্য করে তুললেন। সুকান্তকে নতুন যুগ-চেতনার প্রতিনিধি বলা হয় আরেকটি কারণে তা হলো, তিনি চল্লিশের দশকের অস্তিত্বগত চরম বিপন্নতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁর প্রতিটি উচ্চারণের পিছনে থাকত হৃদয়ের উত্তাপ।

কবিতা তোমার দিলাম আজকে ছুটি

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়:

পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

(হে মহাজীবন: ছাড়পত্র)।

বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে সুকান্ত একটা নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর কবিতা যুদ্ধ, নিপীড়ন, অনৈক্য, দুর্ভিক্ষ আর স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে পাঠকদের মনে দোলা জাগিয়েছিল। কতিপয় উদাহরণ:

১. এসেছে নতুন শিশু; তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংস স্তূপ-পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

-(ছাড়পত্র: ছাড়পত্র)।

৩. আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়

পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাঁধা,

এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-

আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।

-(আঠারো বছর বয়স: ছাড়পত্র)।

৫. সাবাস, বাংলাদেশে, এ পৃথিবী

অবাক তাকিয়ে রয়;

জ্বলে পুড়ে,-মরে ছারখার

তবু মাথা নোয়াবার নয়।”

(দুর্মর: পূর্বাভাস)।

সুকান্তের কবিতা একটা বিরাট সম্ভাবনার ইঙ্গিত বয়ে এনেছিল বাংলা কবিতা ক্ষেত্রে। তাঁর গণমুখী কবিতাগুলো যেন একটা আশ্চর্য প্রশাস্তির ভাব নিয়ে এসে দাঁড়ালো জনতার মাঝখানে। কেননা কবি ছিলেন আশাবাদী। কবি দেখেছেন এই পৃথিবীর চারদিকে ধ্বংস, অরাজকতা, দুর্নীতি, মানবতাবোধহীন আচার-আচরণ, দুর্ভিক্ষ কেমন যেন গোটা সমাজ জীবন ও পৃথিবীতে ছেয়ে ফেলেছে। সাধারণ মানুষেরা, লাঞ্ছনায়, বেদনায় যন্ত্রণাবিদ্ধ। কবি এ থেকে উদ্ধার পেতে দুঃখী মানুষের জনযুদ্ধের আন্দোলনে শরীক হবার আহব্বান জানালেন। পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা কবিকে বারবার আশাহত করলেও কবি একেবারে নিরাশ হয়ে যাননি। তাঁর কবিতার মূল তাই বিষাদ বা দুঃখ নয়, বীর রস, ক্রোধ রস। কবি একটা আশাবাদী মনোভাব তাঁর কবিতায় সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা ছিল। কবি পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাবার অঙ্গীকার করেছেন,

‘চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

নবজগতের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

সংকল্পে-দৃঢ়বিপ্লবী কবির কবিতায় তাই হতাশাই শেষ কথা নয়। আমরা শুনি ও বুঝি তাঁর কাব্য প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট স্থান অধিকার করেছে আশাবাদী মনোভাব। তাই সমাজ সচেতন এ কবি শ্রেণি শোষণের পথ ধরে তাঁর কবিতাকে রাঙিয়েছেন বিদ্রোহ আর বিপ্লবে। তিনি যেমন এ গণআন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন- তেমনি পাঠককেও জড়াতে চেয়েছেন তাঁর কবিতাতে। অতএব শ্রেণি সচেতন বা শ্রেণিসংগ্রামের কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি আসন নির্দিষ্ট আছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সমসাময়িক রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজনীতি, সমাজের বিচিত্র অসংগতি কোনো কিছুই তার লেখনী থেকে বাদ যায়নি। তদুপরি তাঁর কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি কেবল সমস্যাগুলোর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেই দান্ত হননি। এসব সমস্যা, অসংগতি এবং রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে কোন পথ গ্রহণযোগ্য আপন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তাও তিনি নির্দেশ করতে চেয়েছেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।