বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যে তিনজন কবির নাম এক পঙক্তিতে উচ্চারিত হয়ে থাকে, তারা হলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্ত। তার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয় যে, বাংলা কাব্য সাহিত্যে এই তিন নক্ষত্রই সমমানের ও সম-মর্যাদার। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকান্তর কবি প্রতিভার কোনাে অর্থে তুলনাই হতে পারে না। এমনকি নজরুলের সঙ্গেও নয়। তবু স্বল্পায়ু জীবনে সর্বহারা শ্রমজীবী মানুষের সপক্ষে কবিতাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের গৌরবে, কিশাের বয়সেই ভাষা ও ছন্দের দক্ষতায়, রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি বলিষ্ঠ বিশ্বাসে কবি সুকান্ত বাংলা কাব্যজগতে এক বিশিষ্ট উজ্জ্বল নাম সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্ মুহূর্তে সুকান্তর জন্ম (১৯২৬), এবং মাত্র একুশ বছর বয়সে ভারতের স্বাধীনতার বর্ষটিতেই তাঁর চিরবিদায় (১৯৪৭) । অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসের ঝােড়াে লগ্নে আবির্ভূত হয়ে, ভারতবর্ষের রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গে নিজেকে সক্রিয় কর্মী হিসাবে যুক্ত করেও তিনি স্বাধীনতার উজ্জ্বল দিনগুলিকে উপভােগ করার অবকাশ পেলেন না। যক্ষ্মার যন্ত্রণার মতােই তার কবিজীবনের এই ট্র্যাজেডিও যন্ত্রণাদায়ক।
কবি সুকান্তর কবি জীবনের সূচনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে। বাল্যকাল থেকেই তিনি যেমন রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরটিকে আয়ত্ত করতে চেয়েছেন, তেমনি বাল্যকালের রচনা গান ও গীতিনাট্যগুলিতেও রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে রোমান্টিক কল্পনাবিলাস, কাল্পনিক মৃত্যু চেতনা, নির্জনতার মধ্যে আপন-সত্তার রূপ আবিষ্কারের ভাববিলাস প্রকাশিত। রাখাল ছেলে নামক রচনায় বা দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে’, ওগো কবি, তুমি আপন ভােলা’ ইত্যাদি গানে রবীন্দ্রনাথের দুর্বল অনুকরণচিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু চোদ্দ পনেরাে বছর বয়স থেকেই তার মানসিকতায় এক বিপুল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। প্রথম কৈশােরেই সমাজসচেতনতা ও কাল-সচেতনতা সুকান্তকে এক অবিশ্বাস্য পরিণতি দান করেছিল। সুকান্তর থেকে বয়সে অগ্রজ আজও সৃষ্টিশীল কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় সুকান্ত সম্পর্কে লিখেছেন- ‘কলেজের বন্ধু মনােজ একদিন জোর করে আমার হাতে একটা কবিতার খাতা গছিয়ে দিল।…..তাতে কী এমন ছিল যে, পড়ে সেদিন আমরা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম?…..কোনাে কিশােরের পক্ষে ঐ বয়সে (১৪ বছর) ছন্দে অমন আশ্চর্য দখল, শব্দের অমন লাগসই ব্যবহার সেদিন ছিল অভাবিত’।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়েছে তার মৃত্যুর পর। ‘ছাড়পত্র’ এবং ‘ঘুম নেই’- এর প্রকাশের উদ্যোগ অবশ্য শুরু হয়েছিল তার অসুস্থতা কালেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি মুদ্রিত আকারে তার কোনাে কাব্যগ্রন্থ দেখে যেতে পারেন নি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছাড়পত্র প্রকাশিত হয় ১৯৪৭-এ। ‘ঘুম নেই’ প্রকাশিত হয় ১৯৫০-এ। সুকান্তর প্রথম বয়সের কবিতাগুলি নিয়ে তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পূর্বাভাস’ প্রকাশিত হয় ১৯৫০-এই। এছাড়া ছােটদের জন্য তাঁর অন্য স্বাদের ছড়া ও কবিতার সংকলন ‘মিঠে কড়া’ ১৯৫১-তে প্রকাশিত হয়।
চোদ্দ-পনেরাে বছরের কিশােরের লেখা যে খাতাটি দেখে সুভাষ মুখােপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব বসু বিস্মিত হয়েছিলেন, সেই খাতার কবিতাগুলিই প্রকাশিত হয় পূর্বাভাস’ গ্রন্থে। সেই গ্রন্থের নাম কবিতাতেই সুকান্তর ছন্দবােধ ও আধুনিক মানসিকতার নির্ভুল স্বাক্ষর লক্ষিত হয়—
‘সন্ধ্যার আকাশতলে পীড়িত নিঃশ্বাসে
বিশীর্ণ পাণ্ডুর চাদ স্নান হয়ে আসে।’
‘পূর্বাভাসে’র অনেক কবিতাই হয়তাে অপরিণত বা ভাবপ্রকাশের দিক থেকে দুর্বল, কিন্তু শৈশবের এই কবিতাগুলিতেও খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে সুকান্তর বিপ্লবী মানসিকতার গঠনটি। রােমান্টিকতাকে অস্বীকার করে প্রবল বাস্তবের মাটিতে সঞ্চরণের প্রতিজ্ঞা তার কণ্ঠে শৈশব থেকেই ধ্বনিত। ‘জাগবার দিন আজ’ কবিতায় সেই প্রত্যয়ের প্রতিধ্বনি-—
‘জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে;
যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়াছবি ভাসছে-
তাদেরই যে দুর্দিন পরিণামে আরাে বেশী জানবে,
মৃত্যুর সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল হানবে।’
সুকান্ত জনতার কবি; জন-কল্লোল তাঁর কবিতায় তরঙ্গিত। সুকান্ত কমিউনিস্ট কবি; মার্কসবাদী জীবনবীক্ষা তাঁর কবিতার ভিত গড়ে দেয়। তাই সুকান্তর কবিতার গুণাবলীও তার এই স্পষ্ট রাজনৈতিক সচেতনতার মধ্যে নিহিত, তার কবিতার প্রধান দুর্বলতারও বীজ এইখানে। বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেছিলেন যে সুকান্ত কবি হতে পারত, কিন্তু রাজনীতির কারণেই তা সে হতে পারেনি। সুকান্ত কবি হতে পেরেছে, কিংবা পারেনি, কাব্যতত্ত্বের সে জটিল বিচারে না গিয়েও একথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে, সুকান্ত রাজনীতিকে গভীরভাবেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন তার কবিজীবনেও। তার কথা—‘জীবনটা দেবাে পার্টির জন্যে, জীবনটা দিয়ে দেবা। অগ্রজ প্রতিম সুভাষ মুখােপাধ্যায় কবিতা ছেড়ে যখন রাজনীতিতে এসেছেন, তখনই রাজনীতি ক্ষেত্রেও শিল্প সাহিত্য চর্চার গুরুত্ব অনুভূত হল, এবং সুকান্ত তার কবিতা নিয়েই এলেন রাজনীতির প্রাঙ্গণে। আর প্রথম থেকেই কবিতা তার কাছে হয়ে উঠল রাজনৈতিক হাতিয়ার।
‘ছাড়পত্র’ শুধু সুকান্তর প্রথম কাব্যগ্রন্থ নয়, তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলিরই সংকলন। সমকালীন উত্তাল ও বিক্ষুদ্ধ যুগ ভাষা পেল সুকান্তর কবিতায়। নাম কবিতাটিতেই ঘােষিত হল সেই সংকল্প—
‘চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযােগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
ছাড়পত্র এক আশ্চর্য সার্থক নাম। বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে কবি-কিশােরের প্রতিভার ছাড়পত্র হিসাবেই যেন গ্রন্থটির আবির্ভাব। এই গ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে রচিত। একদিকে মৃত্যুকীর্ণ যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ, বন্যা ও মহামারী, অন্যদিকে নতুন জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য মৃত্যুপণ সংগ্রাম সমকালীন ক্রান্তিকাল ছাড়পত্রের কবিতাগুলিতে উৎকীর্ণ হয়ে আছে।
অতি তুচ্ছ, সাধারণ, অ-কাব্যিক কয়েকটি বিষয়কে রূপক হিসাবে ব্যবহার করে শােষণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে কয়েকটি কবিতায়; যেমন— ‘সিঁড়ি’, ‘কলম’, ‘সিগারেট’, ‘দেশলাই কাঠি’। সিগারেটের জবানীতে সুকান্তর জিজ্ঞাসা—
‘তােমাদের আরাম; আমাদের মৃত্যু।
এমনি করে চলবে আর কতকাল?
আর কতকাল আমরা এমন নিঃশ ডাকব
আয়ু-হরণকারী তিল তিল অপঘাতকে।’
নবযৌবনের জলতরঙ্গ কল্লোলিত হয়েছিল নজরুলের কবিতায়। রবীন্দ্রনাথও তার পূর্বে সবুজের জয়গান করেছিলেন। কিন্তু সুকান্তর এই যৌবন বরণ বিদ্রোহের অগ্নিতাপে জ্যোতির্ময়। ‘আঠারাে বছর বয়স’ কবিতায় সুকান্ত লিখলেন—
‘আঠারাে বছর বয়স ভয়ংকর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।’
‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের দুটি বিখ্যাত কবিতা বােধন এবং ‘রাণার। ‘রাণার কবিতায় ডাকহরকরার জীবনকে অবলম্বন করে সুকান্ত ফুটিয়ে তুললেন বঞ্চিত সর্বহারা জীবনের যন্ত্রণা—
‘অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।’
সর্বহারা বঞ্চিত রাণারকেই তিনি শেষপর্যন্ত নবযুগের বার্তাবাহক রূপে দেখতে চেয়ে সুকান্ত তার রাজনৈতিক আদর্শটিকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করেন।
সুকান্তর শ্রেষ্ঠ কবিতা বােধন’, শিশুঘাতী নারীঘাতী সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত বীভৎসার প্রতি ক্ষমাহীন অভিশাপবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। এই ধিক্কারই প্রচণ্ড ক্রোধে বিস্ফোরিত হয়েছে সুকান্তর কবিতায়। ১৩৫০-এর পরবর্তী বাংলার পটভূমিকায় কবিতাটি রচিত। মন্বন্তরের মহাশ্মশানে উপবিষ্ট মজুতদার ও মুনাফাখােরের প্রতি এখানেও উচ্চারিত হল প্রচণ্ড ঘৃণা ও অভিশাপ—
‘প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তােরা/ ভেঙেছিস ঘরবাড়ি।
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে/কখনাে ভুলতে পারি?
আদিম হিংস্রমানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজন-হারানাে শ্মশানে তােদের/চিতা আমি তুলবই।’
‘ছাড়পত্র’-র অন্যান্য বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবিতাগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য—একটি মােরগের কাহিনী’, ‘ঠিকানা’, ‘ঐহিতাসিক’, ডাক’, ‘হে মহাজীবন’। ‘ডাক’ কবিতায় অহিংসার বাণী প্রচারক বুদ্ধের আদর্শকে নাকচ করার মধ্য দিয়ে কার্যত সুকান্ত গান্ধীবাদকেই বর্জন করেছেন—
‘মুখে মৃদু হাসি অহিংস বুদ্ধের
ভূমিকা চাই না, ডাক ওঠে যুদ্ধের।’
আর ‘হে মহাজীবন’ কবিতায় ললিত কাব্যকে তিনি বর্জন করলেন, বাতিল করে দিলেন ক্ষুধাজর্জর পৃথিবীতে চাঁদের রােমান্টিকতাকে—
‘হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়,
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনাে,
পদলালিত্য ঝংকার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানাে’
সুকান্ত আত্মসচেতন ও বাস্তবিকতার কবি। ইতিহাসের দীক্ষায় তিনি দীক্ষিত। তীব্র আবেগ ও উত্তেজনায় তাঁর সেই সংগ্রামী চেতনা কবিতার ছত্রে ছত্রে উচ্চারিত, তবে ‘ঘুম নেই’ কাব্যগ্রনথে উত্তেজনার থেকে স্থিরতা অনেক গাঢ়, প্রতিজ্ঞা আত্মমুখী প্রস্তুতিতে একাগ্র। ‘ঘুম নেই’ এর কবি আলাের পূজারী। অতন্দ্র রাত্রির বুকে তিনি সূর্যের প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করেন। ‘রৌদ্রের গান’ কবিতায় ধ্বনিত হয় সেই রৌদ্র বন্দনা—
‘রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল
ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে
শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা
স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে।’
‘প্রিয়তমাসু’ কবিতায় পরের জন্য যুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিক ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে বন্দী স্বদেশের মুক্তির জন্য সচেতন হয়। এখানেও সেই আলাের প্রত্যাশা। সূর্যের দীপ্তি বা মুক্তির আলােকে সমার্থক জেনে সেই সৈনিক নিজেকে বাতিওয়ালার সঙ্গে তুলনা করে—
‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা
যে সন্ধ্যায় রাজপথে পথে বাতি জ্বালিয়ে কে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতিজ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।’
প্রথমাবধিই রােমান্টিক স্বর্গস্বপ্নের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও একদিক থেকে তাঁর অগ্রজ অনেক কবির থেকে সুকান্ত পরিণত বােধের পরিচয় রেখেছেন, সেটি তার রবীন্দ্রনাথের প্রতি সশ্রদ্ধ মানসিকতা। বিদ্রোহ, বিপ্লব, বাস্তবতার মােহে রবীন্দ্রনাথের সুউচ্চ কবিপ্রতিভা ও মানবতার সপক্ষে তার অবস্থানটিকে চিনে নিতে সুকান্তর ভুল হয়নি। বাস্তব রূঢ়তার মাঝখানেও রবীন্দ্রনাথ সুকান্তকে অনুপ্রাণিত করেন, এ স্বীকারােক্তি করতে সুকান্তর আধুনিকতায় বাধেনি—
‘যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তােমার সৃষ্টিকে
এখনাে প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।’
কেননা রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ও সুকান্তর প্রত্যয় এক জায়গায় এসে মিলেছে- ‘শান্তির ললিত বাণী শােনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’
‘অখ্যাত জনের নির্বাক মনের’ যে কবিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, কিশাের সুকান্ত সেই জনগণের কবি। সুকান্তও রবীন্দ্রনাথকে ফিরে পেতে চেয়েছেন জন-জাগরণের বিক্ষুব্ধ পথে—
‘এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর
বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে, কণ্ঠে গণ-সংগীতের সুর।’
পথ হয়তাে ভিন্নতর, তবু রবীন্দ্রনাথ সুকান্তর এই সম্পর্ক যেন এক অভিন্ন স্বপ্নেরই ক্রমাভিব্যক্তি।
শুধু বড়দের জন্য কবিতাতেই নয়, ছােটোদের জন্য ছড়াতেও বাংলা সাহিত্যে যেন এক নতুন দিগন্তের উন্মােচন ঘটালেন সুকান্ত তাঁর ‘মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থে। সুভাষ মুখােপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন— ‘আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ির ছড়া নয়,একেবারে টাটকা হাতে গরম ছড়া। হাসতে হাসতে হঠাৎ হাত মুঠো হয়ে যাবে, চোখ দুটো জ্বলে উঠবে লাল টকটকে সূর্য ওঠা দিনের কথা ভেবে। এমন ছড়া বাংলাদেশে আর কেউ লেখেনি।’
পুরােনাে দিনের ঘুমপাড়ানী দড়া নয়, বা রবীন্দ্রনাথের লেখা কল্পনা-প্রবণ সরল অবােধ শিশুর কথা নিয়ে ছড়া নয়, সুকান্তর লেখা ছড়াতেও উঠে এল সেই সময় ও ঝােড়াে যুগের বাণী। একদিকে বড়লােকের বাড়ি বিবাহ উৎসবের অপচয়, অন্যদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের আস্তাকুড়ে কাড়াকাড়ির ছবি যেন ‘নবান্ন’ নাটকের দৃশ্যকেই মনে করিয়ে দেয় (‘বিয়ে বাড়ির মজা’), অথবা ধনীরাম পােদ্দার যে কিভাবে নিজের তৈরি ব্যবস্থারই শিকার হয় তা চিনিয়ে দেয় আমাদের সুকান্তর অব্যর্থ সমাজ চেতনা। পুরােনাে ধাধা’ কবিতায় উঠে আসে অনিবার্য সেই প্রশ্ন—
‘বলতে পারে বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?’
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিসত্তার বিবর্তন বা তার কবিতার শিল্পগত ক্রমপরিণতি দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবু প্রবল শক্তিধর এই কবি-কিশাের যে অনেকখানি পরিণত হবার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন, সে বিষয়ে সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের মূল্যায়নের সঙ্গে আমরা একমত। সুভাষ লিখেছেন- ‘আঠারাে থেকে একুশ বছর বয়সে সুকান্ত যেভাবে লিখেছিল—বেঁচে থাকলে তিরিশ থেকে পয়ত্রিশ বছর বয়সেও সেই একই ভাবে লিখে যেত ..এক জায়গায় থেকে যাওয়া সুকান্তর পক্ষে অসম্ভব ছিল।….কাজে হাত দিয়েই সুকান্তকে চলে যেতে হয়েছে এ কথা ভুলে গেলে সুকান্তর প্রতি অবিচার করা হবে।’
Leave a comment