‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটি বাবরের স্বগতোক্তিতে রচিত; পুত্র হুমায়ুনের রোগশয্যায় বসে আল্লাহর নিকট বাবর জানু পেতে প্রার্থনা জানাচ্ছেন। অসুস্থ পুত্রের আরোগ্য লাভই স্নেহবৎসল পিতার একমাত্র প্রার্থনা—নিজের জীবনের বিনিময়ে পিতা ভিক্ষা চান পুত্রের রোগমুক্তি। বাবর এখানে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নন–যোদ্ধা নন; বীর নন। এখানে তিনি কেবল পিতা—অসুস্থ পুত্রের সুস্থ পিতা ; যে পিতা নিজের সুস্থতাকে বিসর্জন দিতে চান পুত্রের অসুস্থতার আরোগ্যের জন্য। সন্তানবৎসল পিতৃ-হৃদয়ের একান্ত আপন প্রার্থনাটি যেন অদৃষ্টের কঠিন পাষাণে প্রতিধ্বনিত হয়ে অপূর্ব এক জীবন-সঙ্গীত রচনা করেছে। কবিতার নামকরণটি যে গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ও ব্যঞ্ছনা-সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় কবি নিজেই যেন বাবরের ভূমিকায় অবতীর্ণ ; তিনি একমাত্র প্রিয় পুত্র হুমায়ুনের স্নেহ-বৎসল পিতা। পুত্রের জন্য পিতৃসত্তার বাৎসলাময় রূপটিকে যেন তিনি উজাড় করে প্রকাশ করেছেন এই কবিতায়। তিনি এই কবিতায় কেবল পিতা, সম্রাট নন, সম্রাটের কান্না আর পিতার কান্না কখনো এক হয় না—কোথায় যেন ফাঁক থেকে যায়। কবি শঙ্খ ঘোষ বাবরের পিতৃসত্তার প্রকাশে কোথাও ফাঁক রাখেন নি–তা নিটোল মুক্তাবিন্দু; ঐ বিন্দুর প্রতিফলনে উদ্ভাসিত করেছেন পিতৃহৃদয়ের নিঃসীম সপ্তাটিকে।

বাবর তাঁর একমাত্র পুত্রের আরোগ্য কামনায় আল্লাহর প্রার্থনারত। তিনি ইতিহাসের এক দুর্ধর্ষ বিজয়ী রূপে মত্ততা ও অহংকার ত্যাগ করেছেন—একটি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় নিজের অহমিকা ত্যাগ করেছেন। অতীতের রাজ্যজয়ের ইতিহাস তাঁর কাছে গৌণ, রাজ্যজয়ের উল্লাসে উদ্দীপিত বিলাসমত্ততার আলোর রোশনাই আজ তাঁর পিতৃসত্তাকে পীড়িত করে তুলেছে। তিনি মনে করেছেন, সেই আলোর রোশনাই-তে যেমন অসংখ্য নির্বোধ পতঙ্গ ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করতে উদ্যত তেমনি তাঁর বিজয়-ভোগ-লালসার রোশনাই-এ মৃত্যুবরণে প্রতীক্ষারত তাঁর প্রিয় পুত্র হুমায়ূন। পুত্রের রোগজর্জর দেহ পিতার হৃদয়কে কিভাবে নিঙড়ে দিয়ে যায়, তা তিনি অনুভব করেন। কবি শঙ্খ ঘোষ বাবরের পিতৃসত্তাকে অদৃষ্ট-নিয়ন্ত্রিত করে তুলেছেন—তাঁর হৃদয়ের যন্ত্রণাকে চিরন্তন মানুষের ব্যথা-বেদনার রূপে তুলে ধরেছেন। কবি শঙ্খ ঘোষ ব্যথিত মানবাত্মার কবি—মানব-হৃদয়ের উপরকার ঢেউ-এর গর্জন তাঁর লক্ষ্য নয়—তিনি শুনতে পান সমুদ্রের তলদেশের নীরব আর্তনাদ-যে আর্তনাদ আকাশ-বাতাস মথিত করে না ব্যথিত করে কেবল অন্তরলোককে।

‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় কবি যেন মানব-হৃদয়রূপ সিন্ধু মন্থন করে তার মধ্য থেকে তুলে এনেছেন পুত্র-স্নেহের মুক্তাবিন্দু।

শোকক্লিষ্ট পিতা বাবর জানু পেতে পশ্চিমমুখী হয়ে প্রার্থনা করছেন; তাঁর প্রার্থনার ভাষা হৃদয়-সাত। মহাকবি মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র রাবণের পিতৃসত্তার হৃদয়াবেগের কথা যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নিকট তাঁর প্রার্থনা—তিনি যেন তাঁর নিজের জীবনের বিনিময়ে তাঁর পুত্রকে রোগমুক্ত করে দেন। কবিতাটির প্রারম্ভে বেদনার নিথর মূর্তি পিতা বাবরের মুখে শুনি

“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম

আজ বসন্তের শূন্য হাত।

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’

দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ তাঁর তরুণ তরতাজা পুত্রের যৌবনকে কুরে কুরে ক্ষয় করে দিচ্ছে; তাঁর শিরায় শিরায় দুষিত ব্যাধির রক্তের প্রবাহ। ব্যাধির প্রকোপে রক্তের লাল রঙ্ হয়ে গেছে ধূসর বর্ণের; অর্থাৎ মৃত্যুদূত দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। পুত্র হুমায়ুনকে তার যৌবন-জীবন আনন্দ সবকিছু নিয়ে ছেড়ে চলে যেতে হবে এই আনন্দ ও বিশ্বাসের পৃথিবী থেকে। রাজপ্রাসাদের প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য তাহলে ভোগ করবে কে? বৃদ্ধ পিতা কি সেগুলিকে নিয়ে পুত্রের কথা ভুলে যাবেন। তিনি যে ভারতীয় পুরাণের যযাতির বিপরীত কোটিতে অবস্থান করেন : যযাতি চেয়েছিলেন পুত্রকে জরা দিয়ে নিজে পুত্রের যৌবন ভোগ করবেন। কিন্তু বিজয়ী বাবর তাঁর বীর্য-বিজয়-পরাক্রম জীবন প্রভৃতি সমস্ত কিছুর বিনিময়ে চায় নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে এবং পুত্রকে রোগমুক্ত করে তুলতে। বাবরের মধ্যে কবি দেখেছেন চিরকালীন পিতৃসত্তার অনন্য রূপ-যে রূপ মানবিকতা বোধে উজ্জ্বল দেশ-কাল-যুগ অতিক্রম করে মানবসত্তার মহিমায় ভাস্বর।

‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় কবি পুত্র হুমায়ুনের রোগশীর্ণ দেহকে দেখেছেন বর্তমানের অসুস্থ ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতারূপে, যে সভ্যতার মধ্যে আছে ভোগমুখী প্রবৃত্তির উচ্ছৃঙ্খলতা, ভোগের পাপের জালে জড়িয়ে পড়ার অসহায়তা। বাবর যেন ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতারই জন্মদাতা নিজেই জন্ম দিয়েছেন সেই ক্ষয়িষু রোগদীর্ণ সভ্যতাকে ; কিন্তু রোগ প্রতিরোধ করার শক্তি তাঁর নেই। তিনি রাজ্য জয় করতে পারেন, প্রাসাদে প্রাসাদে আলোর রোশনাই জ্বালাতে পারেন কিন্তু তাঁর শক্তির দ্বারা অসুস্থ সভ্যতাকে বাঁচাতে পারেন না। রথের চাকা আর পিছনদিকে ফেরানোর সাধ্য নেই তাঁর : তাই তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছে অদৃষ্টের ওপর। নিয়তির হাতে বন্দী মানুষ যখন তার লৌকিক অবলম্বনটুকু হারিয়ে ফেলে, তখন তাকে নির্ভর করতে হয় অলৌকিক দণ্ডকে। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় কবি শঙ্খ ঘোষ বাবরের রূপ নিয়ে বর্তমান যুগের ভোগবাদী মৃতপ্রায় অসুস্থ সভ্যতাকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে চান। কবি পুরাতন ইতিহাস কাহিনীর প্রেক্ষাপটে রচনা করেছেন নবযুগের জীবন-সঙ্গীত।

খণ্ডিত ইতিহাসকে কবি দিয়েছেন পূর্ণতার মাত্রা। ইতিহাস যেখানে জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্যসূত্রে গ্রথিত, সেইখানে জীবন পূর্ণতার মাত্রা পায়। জীবনকে বাদ দিয়ে ইতিহাস মূক, প্রাণস্পন্দন ব্যতিরেকে ইতিহাস বধির। কবি শঙ্খ ঘোষ ইতিহাসকে পূর্ণতার রূপ দিয়েছেন—জীবনকে দিয়েছেন অতলান্ত গভীরের রহস্যময়তার উজ্জ্বলতা।