যে-কোনো লেখকের সাহিত্যকে বিচার করতে হলে তাঁর যুগের ঐতিহ্য ও চাহিদাকে সামনে রেখে শিল্প ব্যক্তিত্বের তথা সাহিত্যের বিচার করতে হয়। ‘ঈশ্বর গুপ্ত’ প্রবন্ধে কবি ও সমালোচক বিষ্ণু দে তেমনই পথের দিশারি হয়েছেন। ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাবের পটভূমি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক দিকটাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিষ্ণু দে । পরাধীন ভারতবর্ষের স্বদেশি নবজাগরণের কালে। ইংরাজের সংশ্রবে জাতীয় জীবনে মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে জেগেছিল এক প্রাণের স্পন্দন। সেজন্য তিনি প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছেন—“গত শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত বাঙালি আমরা পরম উৎসাহে নতুন শিক্ষায় মেতেছিলুম, তখন সে উৎসাহ ছিল স্বাভাবিক। একমাত্র সোজাপথ।” এর কারণ সমাজ ব্যবস্থায় মোড় ফেরাবার সময় তখন, নতুন শিক্ষায় ছিল জীবিকার ভরসা এবং নতুন জীবন যাত্রার আশা। এই ঐতিহাসিক বিনয় থেকে—যুগের সংকট বা যুগের চাহিদাকে না বুঝে শিল্পীর স্বভাবকে সম্যক উপলব্ধি না করে শিল্পীর শিল্পের সমালোচনা হবে ঔদ্ধত্যের পরিচয়। কারণ ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে আজকাল সে সমালোচনা করা হয় তার মধ্যে ঐতিহাসিক বিষয় নেই। অথচ এই ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে যদি সে যুগের বৈশিষ্ট্য বিচার করা হয়, তাহলে ঈশ্বর গুপ্তের সাহিত্যিক প্রতিভার একটা কার্যকারণ সূত্র অনুসন্ধান করা যাবে।
যে-কোনো উত্তরাধিকার বিচার করতে হলে পূর্বসূরীর সমকালীন জীবন ও সেই প্রেক্ষিতে তাঁর ক্রিয়াকর্মই বিবেচ্য হওয়া উচিত। কবি বিষ্ণু দে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রতিভার বিচারে সমকালীন জীবনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এবিষয়ে তার পূর্বসূরী বঙ্কিমচন্দ্রের ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কিত মূল্যায়নকে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবন চরিত ও কবিত্ব’ প্রবন্ধে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা সংগ্রহের কাজে কেন আগ্রহী হয়েছিলেন যে বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে বিষয় জানিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিষ্ণু দে কে আকৃষ্ট করেছিল। তবে বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তকে বাঙালির কবি বললেও বিষ্ণু দে’র বক্তব্য হল—“ইতিমধ্যে শিক্ষিত বাঙালি আর খাঁটি বাঙালি, দুই স্রোত অনেক দূর বয়ে গিয়েছে, দুর্লঙ্ঘ্য ভেদের ব্যবধানে দুই স্রোতই সমুদ্রে গিয়ে আজ একাকার।” এর জন্য বিষ্ণু দে দুঃখ করে জানালেন যে—আমরা আজ শিক্ষিত শ্রেণির বিড়ম্বিত কাব্য সাধনার চূড়ান্তে এসেছি। আমাদের সংস্কৃতির ক্ষুরধার চূড়ায় সামাজিক সমর্থনের আশ্রয় নেই অথচ সমাজ জীবনের মরিয়া তাগিদ আমাদের ব্যক্তিত্ববাদের দোড়গড়ায় হানা দিচ্ছে।
অন্যদিকে ঐতিহ্য চর্চার ক্ষেত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বর গুপ্তের প্রতিভা যে নিয়োজিত ছিল, সে বিষয়ে বিষ্ণু দে জানালেন—“গত শতাব্দীর কণ্টকিত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঈশ্বর গুপ্ত এই ঐতিহ্য রক্ষায় দিকপাল। সেখানে তার কাজ শুধু উপভোগ্য লেখা নয়। তাঁর সাহিত্য জীবন রূপক ও বটে।” অর্থাৎ ঈশ্বরগুপ্ত পুরাতন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরেও নতুন সমাজের পটে সে আঁচড় দিতে পেরেছিলেন—সেই বিস্ময়কর ঘটনার কথা বিষ্ণু দে উল্লেখ করেছেন। তিনি একথাও স্বীকার করেছেন যে, ঈশ্বর গুপ্তের মধ্যে মহাকবির রূপ নেই। আছে কবিয়ালদের অনুবর্তন, আছে সাংবাদিকতার স্পষ্ট অভিব্যক্তি এবং তা ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিষ্ণু দে তাঁর সমালোচনা সূত্রে উল্লেখ করেছেন এবং সংবাদ প্রভাকরের সাংবাদিক হিসাবে তাঁর সে গুরুত্ব কতখানি তা উল্লেখ করে লিখেছেন—
“প্রভাকর প্রভাতে, প্রভাতে মনোলোভা
দেখিতে সুন্দর অতি, জগতের শোভা।।
আকাশের অকস্মাৎ আর একভাব
হয় দৃষ্ট নব সৃষ্ট সুখদ সম্পদ।।
তাই তা বিস্ময়সূচক আবেগে ঈশ্বরচন্দ্র সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন—“যাহা আছে, ঈশ্বর গুপ্ত তাহার কবি। তিনি এই কবি। তিনি কলকাতা শহরের কবি, তিনি বাঙ্গালি গ্রাম্যদেশের কবি।”
ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে যে বস্তুবাদ আছে তাকে বিষ্ণু দে দ্বৈতধর্মী বস্তুবাদ নাম দিয়েছেন। তাঁর মতে—”ঈশ্বর গুপ্তের ইংরেজি নববর্ষ নামক কবিতা থেকেই এই দ্বৈতধর্মী বস্তুবাদের মজাদার উদাহরণ আরম্ভ কবি।” প্রাবন্ধিক ঈশ্বর গুপ্তের এই দ্বৈতধর্মী বস্তুবাদের যে উদাহরণ দিয়েছেন তাহলো—
‘নববর্ষ’ কবিতায় আছে-
খৃস্টমতে নববর্ষ অতি মনোহর।
প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর।।
সেই উৎসবে বিড়ালাক্ষী বিধু মুখীরা কী করেন তারও বর্ণনা দিয়েছেন—
“বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছুটে।
আহা তায় রোজ রোজ কত রোজ ফোটে।।”
মেমদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেও আমাদের দেশের মেয়েদের নিয়ে যখন ব্যঙ্গ করেন তখন তাঁর দ্বৈতসত্ত্বা উপলব্ধি করা যায়—
বিবিজান চলে যান লবেজান করে।
শাড়িপরা এলোচুল আমাদের মেম।
বেলাক মোটিভ লেডি শেম্ শেষ শেম্।।
সিন্দুরের বিন্দুসহ কপালেতে উল্কি।
নসী, যশী, ক্ষেমী, রাণী, রামী, যামী, শামী গুল্কি ইত্যাদি।।
এসব সত্ত্বেও প্রাবন্ধিক ঈশ্বর গুপ্তের কবিত্বের স্বরূপ পর্যালোচনা করতে ভোলেননি। তাঁর মতে রোমান্টিক কাব্যের সংজ্ঞানুযায়ী গুপ্ত কবির কাব্যকে রোমান্টিক কাব্য বলা না গেলেও তাঁর কাব্য স্বতন্ত্র শ্রেণির। কারণ ঈশ্বর গুপ্তের রচনায় প্রাকৃত মনোবৃত্তি থাকলেও তাঁর শিল্পী সত্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য মানবপ্রেম ও সুগভীর সহানুভূতি। তবে বিষ্ণু দে স্বীকার করেছেন, রোমান্টিক কাব্যের বিষয়বস্তু ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে থাকলেও তাঁর ‘ফর্ম’ সচেতনতা ছিল না। এর কারণ হিসাবে শৈশবের প্রতিকূল পরিবেশ এবং শিক্ষার অভাবকে দায়ী করেছেন। কিন্তু সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক রূপে তিনি যে পরবর্তী কবিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন তা মানতেই হয়। বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, দীনবন্ধু, মনোমোহন বসু প্রভৃতি সাহিত্যিক তাঁকে গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছেন। বিষ্ণু দের মতের দেশীয় ঐতিহ্যকে গ্রহণ করায়, আধুনিক কাব্যের কর্মটিকে কী কী সম্যক উপলব্ধি করত বা ধরতে পারেননি, এর মধ্যে দায়ী তাঁর কবি প্রতিভা নয়, বরণ সমকালীন যুগই এজন্য দায়ী। আর তা যদি ঈশ্বর গুপ্তের প্রতিভার সীমাবদ্ধতা হয় তবে এই সীমাবদ্ধতা হেমচন্দ্র প্রভৃতি কবিদের মধ্যে বর্তমান ছিল।
বিষ্ণু দে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রবন্ধের উপসংহার টেনেছেন যে, আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যকে যদি সাহিত্যিকদের মধ্যে খুঁজতে হয় তবে চণ্ডীদাস, কবিকংকন, থেকে ঈশ্বরগুপ্ত পর্যন্ত বাঙালি কবিদের কাব্যের দ্বারস্থ হতে হবে। তবে এঁদের কাব্যে যে ত্রুটি রয়েছে তার জন্য দায়ী হল আমাদের “ঐতিহাসিক বোধের অভাব এবং মধ্যবিত্ত কুরুচি।” অর্থাৎ বিন্ধুদের মতে ঈশ্বর গুপ্তের প্রতিভার মধ্যে যে বিচ্যুতি ছিল তা যুগ প্রয়োজনেই। যুগের চাহিদা ও চিত্রে যে কবির প্রতিভাকে নিয়ন্ত্রিত করে তা মেনে নিয়েছেন সমলোচক। তবে যুগের চাহিদা বা সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিকে প্রধান করে দেখার অর্থ এই নয় যে, শিল্পীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করে। কারণ মার্কসীয় দর্শনে প্রকৃতি জড় পদার্থ নয়। বহির্জগত মানবসম্পর্কে উদ্ভাসিত হয়ে নতুন রূপে বিকশিত হচ্ছে। গোর্কির মতে—“কল্পনার কাজ হচ্ছে বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলিত করা, অবসর দেওয়া। জীবনকে পর্যবেক্ষণ ও জীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করার পরে কল্পনা তাকে তাৎপর্য পূর্ণ এক সামাজিক রূপ দিয়ে জীবন্ত করে তোলে।” সুতরাং যুগের চাহিদাকে শিল্পী যেহেতু এড়াতে পারেন না, তাই সচেতন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঈশ্বর গুপ্তই বা কীভাবে এড়াতে পারবেন, সে কারণে বিষ্ণু দে’র এই সমালোচনা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে যথার্থ।
Leave a comment