কবি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্ত্বার অন্তরাল হতে ‘গানের আড়াল’ কবিতার মতো ‘অভিশাপ’ কবিতার মধ্য দিয়ে প্রেমের আরও একটা নবতর স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে এ কবিতা ব্যর্থ প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস রূপে কল্পনা করলে ভুল হবে, কিংবা অভিশাপ কথাটিকে এর অভিধানিক অর্থে বিভূষিত করে কবিতাটির বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কেবল স্মরণে রাখা আবশ্যক প্রেয়সী-প্রেমিকের উদ্দেশ্যে এই যে অভিশাপ ধ্বনিত হয়েছে কোনোরূপ ক্ষতি করতে নয়, একেবারে নিজেকে নিঃশ্বেষিত করে নিজের অবর্তম প্রেয়সী প্রেমিকের কী দশা হতে পারে তার খতিয়ান এ কবিতা। কবিতার শুরুতেই কবি জানিয়ে দিয়েছেন তার এই অভিশাপ দানের স্বরূপ কী?
“যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
অস্তপারের সন্ধ্যা তারায় আমার খবর পুছবে।।”
মূলত বেঁচে থাকতে প্রেমিক কবি তাঁর মানসীর নিকট হতে যে অবহেলা অনাদরের স্বীকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত সেই যন্ত্রণার প্রতিদান স্বরূপ তিনি অনুচ্চারিত ভাষায় বলতে চেয়েছেন—যেদিন তাঁর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার সময় আসবে সেদিন বোধ করি তাঁর প্রেমিকা বুঝতে পারবে হারানোর ব্যথা, সাথি হারার যন্ত্রণা। তাইতো কবি তাঁর হারিয়ে যাবার পর কী কী ঘটতে পারে প্রেমিকার জীবনে, তা সুচারু উপায়ে সহজ প্রাঞ্জল ভাষায় অভিশাপ স্বরূপ ব্যক্ত করেছেন। মৃত্যুর পর যেমন মৃতের ছবি নিয়ে তাঁর জীবিত পরিজনরা বা স্মরণ করতে থাকে তেমনি কবির মৃত্যুর পর ও তার নিষ্ঠুর প্রেয়সী কবির ছবি বুকে বেঁধে পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে সাগর অরণ্য মরুভূমি জনপদ প্রভৃতি স্থানে খুঁজে বেড়াবে। আর এই খুঁজে বেড়ানোর যে কী যন্ত্রণা সেদিন সে বুঝবে।
হারিয়ে যাবার পর যে চিত্র প্রেমিকার জীবনে প্রতিনিয়ত আন্দোলিত হতে থাকবে তারই আনুপুঙ্খ বর্ণনা কবি এ কবিতার মধ্য দিয়ে উদ্ঘাটন করেছেন।
“স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা ছোঁয়ায় উঠবে ও বুক ছমকে।”
তখন সে ভাববে বোধ হয় কবিই নিজেই এসে বসেছেন তার কোলের কাছে, হঠাৎ তাঁকে ধরতে যাওয়ার জন্য যখন হাত বাড়াবে তখন দেখবে–“শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন ! ক্রমে বেদনায় তার চোখ বুজে আসবে। কখনো গাইতে বসে কণ্ঠ ছিঁড়ে কান্না বেরিয়ে আসবে, তখন অনেকে হয়তো বলবে এ গান বিদায়ী কবির শেখানো। এই কথা শুনে স্বভাবতই তার মনে পড়বে কবির সোহাগের কথা। নিজের অবহেলায় একদিন তাঁকে সে হারিয়েছিল।
যেদিন শিউলি ফুটে ঝরে অঙ্গন ভরে তুলবে, সেই ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতে গিয়ে হয়তো হাত দুটো কেঁপে উঠবে। সারা কুটির অঙ্গন কেঁদে উঠবে। তখন তো—
‘শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
পড়বে মনে উঠবে কাঁদি!
বুকের মালা করবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা।
মুখে হাসি ঘুচবে।”
এ কি বিষম অভিশাপ ! নিজে হারিয়ে গিয়ে প্রেয়সীর যে জ্বালা তাঁর অবর্তমানে অনুবর্ষিত হতে থাকবে বেঁচে থাকতে কবিতা মর্মে মর্মে অনুবভ করছেন। তিনি অকাতরে জানিয়েছেন—সেদিন আসবে আশ্বিন হাওয়া, কিংবা শিশির ছেঁচা রাত্রি। সেদিন সবাই থাকবে, থাকবে না কেবল তিনিই। পাশে থাকবে বন্ধু স্বজন, হয়তো থাকবে নতুন দয়িতের বাহুর বাঁধন, বুকের পরশন, তখন নিশ্চয় কবির কথা তার মনে পড়েব আর ক্ষণে ক্ষণে মন প্রাণ বিষিয়ে উঠবে।
এমনিভাবে দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতির মালায় গড়ে উঠেছে অভিশাপ কবিতার অবয়ব। তবে এখানে নিশ্চয়তার কোনো আশ্রয় নেই। সর্বত্রই একটা সংশয় ও প্রত্যাশা দানা বেঁধে উঠেছে। হতে পারে, হবে এমন কোনো কথা নেই। যেমন—বারে বারে শীতের রাতি এলেও কবি কোনো দিন ফিরবে না। কিন্তু সেই শীতের রাতে প্রেমিকার নিশ্চয়ই মনে পড়েব একদিন কবির বাহুতে সে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল আজ সেই বিছানা কণ্টকশয্যা হয়ে প্রতিভাত হবে। আবার গাঙে জোয়ার আসবে, তরী দুলে উঠবে, সেই তরীতে হয়তো তার সঙ্গে কেউ থাকবে, কিন্তু মনে অবশ্যই পড়তে কবির সঙ্গে সে একদিন এমন করে ভেসেছিল। চৈতালী চাঁদনী রাতে আবার ফুটবে দোলন চাঁপা, তারায় তারায় ফিরে বেড়াবে কবির স্মৃতি, ঋতুর পর ঋতু আবর্তিত হবে কিন্তু কবি আর ফিরবে না। ঝড়, তুফান পূর্বের মতো পৃথিবীকে মাতিয়ে তুলবে, সমস্তই একাকার হয়ে যাবে কিন্তু কবিকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না।
‘পড়বে মনে সে সাথে
বাঁধতে বুকে দুঃখ রাতে-
আপনি গালে যাচবে চুমা
চাইবে আদর মাগবে ছোঁয়া।।”
কিন্তু সবই নিঃস্ফল, সেদিন আর কখনোই ফিরবে না।
মোটের উপর সমালোচ্য কবিতার মধ্য দিয়ে কবি একটা বিষয়ে অতি সুন্দরভাবে আলোকপাত করেছেন, বেঁচে থাকতে যাদের কোনো কদর নেই মরণে তাদের জন্য আমরা হুতাশে বুক চাপড়ে মরি। ক্রমেই মনের াকাশে ভেসে ওঠে কত টুকরো টুকরো স্মৃতি, দীর্ঘশ্বাসে ভরে যায় বুকের তলদেশ। বোধ করি কবি এই টুকরো বিষয়কে রূপদিতে একটা কাহিনি মোড়কে অভিশাপ কবিতাটি প্রণয়ন করেছে। অর্থাৎ বেঁচে থাকতে যারা পায় অবহেলা অনাদর, মরণে তারাই পায় পূজার আসন। এটাই এ কবি তার মূল বর্ণিতব্য বিষয়।
Leave a comment