‘এলিয়ট আধুনিক কাব্যধারার এক উজ্জ্বল প্রতিভা’—বিচার করো।
টি. এস. এলিয়ট ( Thomas Stearns Eliot) আধুনিক কাব্যজগতের এক স্মরণীয় নাম। জীবনের নানা অভিজ্ঞতার পাত্র থেকে জীবনরস আস্বাদন করেছিলেন আধুনিক সাহিত্য গগনের এই প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। নানা পেশায় তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন অধ্যাপনা, ব্যাঙ্কে চাকরি, পত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশন সংস্থার (Faber & Faber) অধিকর্তা হিসেবে বিভিন্নমুখী কর্মোদ্যোগের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। ছাত্রজীবনে দর্শন ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। ক্রিশ্চিয়ান ধর্মের প্রতি অনুরাগ, মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির প্রতি আস্থা, অপেক্ষাকৃত অখ্যাত ও অজ্ঞেয় ধর্মবিশ্বাসের প্রতি কৌতূহল, একটি পরিশীলিত আন্তর্জাতিক চৈতন্যবোধের প্রতি উদারতা এবং সর্বোপরি জীবন ও জগৎ বিষয়ে একটা দার্শনিক বোধ—এই সবকিছু মিলেই গড়ে উঠেছে এলিয়টের মানস জগৎ এবং তাঁর কাব্য, নাটক ও সাহিত্য সমালোচনা প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থে তারই ছাপ পড়েছে। এলিয়টের জন্ম আমেরিকায়, সেন্ট লুই শহরে, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। ছাত্রজীবন ছড়িয়ে আছে আমেরিকার হার্ভার্ডে, ফ্রান্সের সরবোন এবং ইংলণ্ডের অক্সফোর্ডে। ১৯২৭ সালে তিনি ইংলণ্ডের নাগরিক হয়ে যান। ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি ‘অর্ডার অব মেরিট’ এবং ‘নোবেল’ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে ঘটে দেহাবসান।
প্রথম মহাযুদ্ধোত্তোর কালে, ১৯২২ সালে এলিয়টের একটি ছোট্ট কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, নাম ‘ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’ (Waste Land)। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এলিয়ট শুধু ইংলণ্ডের নয়, বিশ্বের একজন প্রধান কবিৰূপে স্বীকৃত হলেন। প্রথমে মহাযুদ্ধ-বিধ্বস্ত মানুষ তাদের মনের কথার ভাষারূপ যেন এই কাব্যের মধ্যে দেখতে পেল।
‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কাব্য কবিকে জগদ্বিখ্যাত করলেও এর পূর্বে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘প্রুফ্রক এন্ড আদার অবজারভেসান’ (Prufrock and Other Observations) এবং ১৯১৯ সালে প্রকাশিত ‘পোয়েমস্’ (Poems) এলিয়টকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ‘প্রুফ্রক এণ্ড আদার অবজারভেসান’-এর কবিতাগুলি মোটামুটি ১৯০৯ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে লিখিত। এর মধ্যে ‘দ্য লাভ সঙ্ অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ (The Love Song of J. Alfred Prufrock) ১৯১১ সালে লিখিত। এই কবিতাটিতে কবি ভিক্টোরিয়ান কাব্যধারা থেকে সরে এসেছিলেন। এই কবিতার বহু প্রচলিত দু’টি পঙ্ক্তি :
In the room of women come and go
Talking of Michaelangelo.
এই কাব্যের অন্যান্য কবিতায়ও এলিয়টের স্বগত-ভাষণ (monologue) বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েও নিজেকে অসম্পৃক্ত করে তোলা, দ্রুতগতি, নাটকীয় পরিবেশন প্রভৃতি তাঁর কবিতাতে পৃথক স্বাদ এনে দেয়। ‘দ্য পোর্ট্রেট অব এ লেডি’ (The Portrait of a Lady) একই সঙ্গে স্মৃতিভারাতুরতা, বিভিন্ন ভাবনার একত্র সংমিশ্রণ, গ্রাম্য পরিবেশ এবং ব্যাঙ্গাত্মক পরিবেশন সব মিলে কবিতাকে করে তুলেছে জটিল কিন্তু উপভোগ্য। শব্দ ব্যবহারেও ‘শামুকের খোল’-এর পাশেই ‘মাইকেল এঞ্জেলো’র হয়েছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কাব্যে এজরা পাউণ্ড (Ezra Pound) এবং জুলস্ লফ্যর্গ (Jules Laforgue)-এর প্রভাব এখান থেকেই দেখা যায়।
এরপর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ (The Waste Land)। ১৯২২ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’। যুদ্ধান্তে বিধ্বস্ত মূল্যবোধের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে মানব জমিনকে কবির মনে হয়েছে ঊষর পোড়ো জমি। আর জীবনের মূল্যবোধকে মনে হয়েছে ক্যাকটাস্ বা কাঁটগাছ। একটা আপাত হতাশাবোধ এই কাব্যে দেখা যায়।
এরপর ১৯২৫ সালের দিকে এলিয়টের আর একটি কাব্যগ্রন্থ ‘পোয়েমস্’ (Poems) প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা দ্য হলো মেন (The Hollow Men)। কবিতাটিতে তিনি আজকের মানুষকে ‘শূন্যগর্ভ’—অসার বলে বর্ণনা করেছেন। ‘আমরা ফাঁপা মানুষ, আমরা ঠাসা মানুষ, গায়ে গায়ে হেলে আছি, মাথায় পোরা খড়। রূপহীন আকৃতি, বর্ণনাহীন ছায়া, পঙ্গু শক্তি, গতিহীন ভঙ্গিমা।’ কিন্তু এই বক্তব্যই কি কাব্যের একমাত্র বক্তব্য? কাঁটাগাছ আপাতঃ রসহীন, কিন্তু ভাঙলে কান্ডের মধ্যে লুকানো রসের খোঁজ পাওয়া যায়। তেমনি হতাশার মধ্যেও কবি আশার স্বপ্ন দেখেন। তিনি অনেক জায়গায় বলেছেন, একদিন নামবে বর্ষা, মানুষ জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে।
সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়, সমবেত জীবনের মধ্যেই জীবন হবে সার্থক। এই বোধ পরবর্তী কবিতাতেও কবি প্রকাশ করেছেন। কবি-উপলখিতে এই বোধই যেন আপাতঃশুদ্ধ কাঁটাগাছের অন্তরের রস।
১৯৩৫ সালের দিকে ‘কালেকটেড পোয়েমস্’ (Collected Poems) নামে কবির আর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যের অন্যতম একটি কবিতা অ্যাস ওয়েডনেসডে (Ash Wedenesday) প্রকৃতই দুর্বোধ্য কবিতা। কিন্তু এখান থেকেই একটা নতুক বাঁক নিল।
চারটি বিচ্ছিন্ন কবিতা নিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমকালে, ১৯৪৩ সালে রচিত একটি কাব্যমালা হচ্ছে ফোর কোয়াটের্টস (Four Quarters)। বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক সত্যে কবি এসে পৌঁছেছেন। কবি সময়, সময়চেতনা ও সময়হীনতার কথা একই সঙ্গে শুনিয়েছেন। সময় একটা নতুন মাত্রা (dimension) নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে। এলিয়টের কাব্য ও নাটক নিয়ে একটা রচনা সমগ্র ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়।
এলিয়টের কাব্যকৃতি বিদগ্ধ জন-মানসকে সচকিত করলেও যে অর্থে বায়রণ বা স্কটকে জনপ্রিয় কবি বা সাহিত্যিক বলা হয় সে অর্থে তিনি জনপ্রিয় কবি ছিলেন না, বরং বলা যেতে পারে তিনি ছিলেন কবির কবি।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে সারা পৃথিবীর কবিদের ওপর যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল, তিনি হচ্ছেন এলিয়ট। বাংলা সাহিত্যে বিষ্ণু দে প্রত্যক্ষভাবে এলিয়ট প্রভাবিত কবি। কল্লোল-যুগীয় অনেক কবির ওপরেই এলিয়টের প্রভাব অল্প-বিস্তর দেখা যায়। এলিয়টের ‘জার্নি অব দ্য মেজাই’ (Journey of the Magi) ‘তীর্থযাত্রী’ নামে রবীন্দ্রনাথ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।
Leave a comment