কবি কীটস-এর জীবনকথা সংক্ষেপে বিবৃত করে বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের পূজারীরূপে এই রোমান্টিক কবির স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণ করো।

কীটসের কবিতার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। রোমান্টিক কবিদের মধ্যে তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও অনন্যতা নির্দেশ করো।

সাধারণভাবে ১৮০০ থেকে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ এবং বিশেষভাবে ১৮০০ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকেই ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগ নামে অভিহিত করা হয়। অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে উইলিয়ম ব্লেক প্রমুখ কয়েকজন কবির রচনায় এর পূর্বাভাস লক্ষ্য করা গেলেও এবং অষ্টাদশ শতকের একেবারে ক্রান্তিক্ষণে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ উভয়ে মিলে গীতিকবিতা সংগ্রহ ‘লিরিক্যাল ব্যালাস্’ (Lyrical Ballads) প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন যুগের সূত্রপাত হলেও মোটামুটিভাবে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে অগাষ্টান সাহিত্যের প্রতিক্রিয়ারূপে রোমান্টিক যুগ তার পূর্ণ গৌরব নিয়ে প্রকাশিত হয়।

রোমান্টিক ভাবান্দোলনের (Romantic Movement) নানান দিক। এক এক দিককে বিভিন্ন সমালোচকগণ এক এক নাম দিয়েছেন। এই রোমান্টিক যুগ কারও মতে রোমান্টিক বিদ্রোহ (Romantic Revolt), কারও মতে রোমান্সের পুনরুজ্জীবন (Revival of Romance), কারও মতে এটা প্রকৃতিতে প্রত্যাবর্তন (Return to Nature), কারও মতে বিস্ময় ও রহস্যের পুনর্জন্ম (Renaissance of Wonder and Mystery) । অধ্যাপক হারফোর্ড এই যুগের মানসিকতার একটা সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন ‘কল্পনাপ্রবণ সংবেদনশীলতার বিস্ময়কর বিকাশ’ (an extraordinary development of imaginative sensibility )।

এই কালের যুগ সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে যেমন ভিন্ন ভিন্ন সমালোচকরা ভিন্ন ভিন্ন প্রবণতার দিকে লক্ষ্য করে বৈশিষ্ট্য নিরুপক ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছেন, তেমনি এই যুগের কবিদলও কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একই সুরে তাঁদের ভাবনার প্রকাশ করেননি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ পরস্পর বন্ধু ছিলেন। উভয়ে এই নামের একত্র গীতিকবিতা সংগ্রহ ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্’ প্রকাশ করেন, কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতিকে তারা একইভাবে উপস্থাপিত করেননি। প্রকৃতিতন্ময়তা, আধ্যাত্মিকতাবোধ, নৈতিক চেতনা এবং মৃন্ময় প্রকৃতির মধ্যে চিন্ময় রূপের প্রকাশ ওয়ার্ডওয়ার্থের কবিতাকে করেছে সাত্র ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ওয়ার্ডসওয়ার্থসুলভ প্রকৃতিভাবনা ও নগণ্য মানুষের কথার পরিবর্তে কোলরিজের কবিতায় ছিল রোমাঞ্চকর অলৌকিক কাহিনী। তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন এক অলৌকিক রহস্যের মায়াঘেরা রাজ্যে, স্বপ্নই যেখানে সত্য হয়ে ওঠে।

শেলি ও কীটস রোমান্টিক যুগের পরবর্তী পর্যায়ের কবি এবং উভয়েই বন্ধু ও সমসাময়িক। কীটসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোয়েমস্’ (Poems by John Keats) প্রকাশের পিছনে শেলির সহায়তা ছিল। তবু মানুষ ও প্রকৃতিকে তাঁরা একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি। ফরাসি বিপ্লবের সূতিকাগারে জাত শেলি ছিলেন বিপ্লবী। এই বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গের দাবদাহে তিনি পুরনোকে ধ্বংস করে সমাজব্যবস্থা, সমাজের মানুষ ও প্রকৃতিকে নতুন করে সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। এদিক দিয়ে শেলির ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইণ্ড’ কবি মনোভাবের এক প্রতিনিধিমূলক কবিতা।

কীটস হচ্ছেন স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের কবি। গ্রিক পৌরাণিক জগৎ, গ্রিক ভাস্কর্য থেকে আহরিত স্বপ্ন সুন্দর সৌন্দর্যের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সমকালীন মানুষের কাছে। জগতের খণ্ড সৌন্দর্য কবিকে সাময়িক আনন্দ দিলেও এই সৌন্দর্যের নশ্বরতা কবিকে তৃপ্তি দিতে পারেনি। তিনি সন্ধান করেছেন চিরায়ত সৌন্দর্য। সেই চিরায়ত সৌন্দর্যই তাঁর কাছে সত্য। সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য— Truth is beauty, beauty is truth। এই জগতের অভাব, দুঃখ-কষ্ট, ক্লান্তি, চিন্তাস্তর থেকে তিনি সৌন্দর্যের জগতে চলে যেতে চেয়েছেন। কবি মানসিকতার এই অভিলাষ সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে ‘ওড টু দ্য নাইটিঙ্গেল’ কবিতায়। বুলবুলির সুরের ডানায় ভর করেই কবি আপন সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি চান। এইখানেই ওয়ার্ডওয়ার্থ, শেলি প্রমুখ কবিদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য ও কবি কীটসের অনন্যতা। গ্রিক সৌন্দর্যবাদ, মধ্যযুগীয় জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা, সৌন্দর্যচেতনা এবং সর্বোপরি রোমান্টিকতার প্রতি তাঁর সহজাত আকর্ষণই তাঁর কবিতাকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে।

বহিরঙ্গ বিচারে কীটসের জীবন কথা খুবই সাধারণ। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর লন্ডনে এক আস্তাবলে তাঁর জন্ম। পিতা ছিলেন আস্তাবলরক্ষক। নয় বছরে পিতৃবিয়োগ হয়, মাতৃবিয়োগ পনের বছরে। স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু পড়াশুনো খুব এগোয়নি। স্কুলে থাকতেই স্পেন্সারের ‘ফেয়ারি কুঈন’ (Faerie Queene) এবং হোমারের মহাকাব্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। পরিচয় ঘটে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত গ্রিক ভাস্কর্যের সঙ্গে এবং মাইথোলজিক্যাল ডিক্সনারির মাধ্যমে গ্রিক পুরাণকথার সঙ্গে সাহিত্য জীবনে এই ছিল তাঁর বড় পাথেয়। এ ছাড়া শেক্সপীয়র ছিলেন তাঁর আদর্শ, মিল্টন ছিলেন প্রিয়। স্কুল জীবন অন্তে ডাক্তারী শিখতে লণ্ডনে শিক্ষানবিশি আরম্ভ করেন। শিক্ষা শেষ হলেও তাঁর পেশার সঙ্গে নেশাকে (সাহিত্যনেশা) মেলাতে না পেরে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে হাসপাতালের কাজ ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এই বছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোয়েমস্’ (Poems)। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ফানী ব্রাউন (Fanny Brown) নামে এক তরুণীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে ও পরিচয় গভীর প্রেমে রূপান্তরিত হয়। এই সময়েই দুর্ভাগ্যবশত তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে তিনি ইতালিতে যান এবং সেখানেই ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর জীবনাবসান ঘটে। কীটসের সমাধিফলকে কবির স্বরচিত এই কথা কয়টি লেখা আছে— Here one whose name was writ in water.” কীটস বললেও সেই লিখন কিন্তু জলের লিখন হয়নি, মহাকালের বিচারে হয়েছে সোনার লিখন। তাঁর স্মরণে কবি শেলির অবিস্মরণীয় শোক-কবিতা ‘অ্যাডোনেইস’ (Adonais) চিরস্মরণীয়।

কীটসের কাব্যজীবন মোটামুটি চার বছরের, ১৮১৬ থেকে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ‘একজামিনার’ পত্রিকায় তাঁর একটি সনেট প্রকাশিত হয়। ওই বছরেই ডিসেম্বরে ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় ‘চাপম্যানের হোমার’ (‘Chapman’s Homer’)-এর ওপর আর একটি সনেট। তাঁর লেখা ‘সনেটগুলি নিয়ে কবি শেলির সহায়তায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। নাম ‘পোয়েমস বাইজন কীটস’ (Poems by John Keats)। কবিতাগুলি তাঁর কুড়ি-একুশ বছর বয়সের রচনা। তাঁর প্রথমদিকের রচনায় ভাবপ্রবণতা রয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে আছে এক রূপমুগ্ধ মনের কোমল স্পর্শ। এলিজাবেথের যুগের স্পেন্সারের প্রভাব অনেক স্থানে লক্ষ্য করা যায়। তিনি ‘ইমিটেশন অব স্পেন্সার’ (Imitation of Spenser) নামে এক কবিতাও লিখেছিলেন। কবির ‘ক্যালিডোর’ (Calidore ) কবিতায় স্পেন্সারের ‘ফেয়ারি কুইন’-এর ছায়াও পড়েছে। স্যার ক্যালিডোর বীর নায়ক এবং সৌজন্যের বীর (Knight of Courtesy)। এই সময়ের আর একটি উল্লেখ্য কবিতা ‘আই স্টুড টিপ-টো আপন এ লিটল হিল’ (I stood tip-toe upon a little hill)। এর দুটি পঙ্ক্তিতে কবি-ভাবনার সান্দ্র প্রকাশ দেখা যায়—’মর্মরিত নীরবতা পাতায় পাতায় অস্ফুট দীর্ঘশ্বাস নীরবতাই বাড়ায়।’ তাঁর প্রসিদ্ধ সনেটগুলির মধ্যে চাপম্যানের অনুবাদের প্রথম হোমার পাঠে (On First Looking into Chapman’s Homer) উল্লেখ্য। এ ছাড়া টু মাই ব্রাদার জর্জ (To My brother George), ‘কসিয়ুস্কো’ (To Kosciusko), ‘নী হান্টের মুক্তিতে’ (On the Day that Leigh Hunt Life Prison) প্রভৃতি তাঁর প্রসিদ্ধ সনেটগুলির অন্যতম। অল্প বয়সের লেখা হলেও কবির ভাবের প্রৌঢ়ত্ব এখানেই প্রকাশিত হয়েছে।

এর পরের বছর প্রকাশিত হয় ‘এণ্ডাইমিয়ন’ (Endyamion)। কাব্যের শুরুতেই উচ্চারিত হয়েছে কবির কাব্যমন্ত্র ‘যা সুন্দর তাই চির আনন্দের’ (a thing of beauty is a joy for ever’)। কাব্যের কাহিনী গ্রিক পুরাণ অনুসারী। এণ্ডাইমিয়ন এক অপূর্ব সুন্দর তরুণ যুবক। ‘ল্যাটমাস’ পাহাড়ে তিনি নিদ্রামগ্ন ছিলেন। শীতল হৃদয়া চন্দ্ৰদেবী সেলীনি (Selene) তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে এগিয়ে এলেন, তাঁর কাছে আপন দেহ এলিয়ে দিলেন তাঁর পাশে ও ওষ্ঠস্পর্শ করলেন সাগ্রহে। চন্দ্রদেবীর বরে এন্ডিমিয়ন অমরত্ব লাভ করেন। কবিতাটি দীর্ঘ এবং এর মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন বক্তব্য রয়েছে। কবি বলতে চেয়েছেন সুন্দর অবিনশ্বর এবং প্রেম অমর। কিন্তু সে তাৎপর্য খুব স্পষ্ট নয়। প্রধানত আনন্দই এতে প্রকাশিত। মূল কাহিনীর সঙ্গে আরও দু’একটি উপকাহিনী যুক্ত হয়েছে। এর কাহিনী পরিবেশনে কীটসের সৌন্দর্যপ্রিয়তা এবং অসাধারণ প্রাকৃতিক বর্ণনা কবিতাটিকে অপরুপ করে তুলেছে। এর কয়েকটি গান, বিশেষত ‘হিম টু প্যান’ (Hymn to Pan) গানে প্রেমদেবতার স্তুতি এবং ও সরো’ (O Sorrow) কাব্যরসিকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছে।

কবির এই প্রথমদিকের রচনা, তাঁর সনেটগুলির সংকলনগুচ্ছ ‘পোয়েমস্’ এবং ‘এণ্ডাইমিয়ন’ ‘কালের কপোততলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’ হয়ে শাশ্বত সাহিত্যে আপন স্থান করে নিলেও সমকালীন দুটি পত্রিকা ‘ব্ল্যাকউডস্’ ম্যাগাজিন (Black-wood’s Magazine) এবং ‘কোয়ার্টার্লি রিভিয়্যু’ (Quarterly Review) কীটসের এই কাব্য কবিতার নিন্দা করে। কারও কারও মতে ওই নিন্দার ফলেই তাঁর শরীর ও মন তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়ে এবং তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে। ‘এণ্ডাইমিয়ন’ প্রকাশের পর থেকেই তাঁর শরীরের ভাঙন দেখা দেয়। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। অন্যদিকে সাংসারিক অভাব, অনটন, দারিদ্র্য, কাব্যচর্চার পরিশ্রম, ফ্যানি ব্রাউন-এর প্রতি প্রেম এবং প্রেমে অপূর্ণতা তাঁর মনকে চির অশান্ত করে তুলল।

কিন্তু এর মধ্যেই চলল তাঁর কাব্যসাধনা। এই সময়ই তাঁর কাব্যের সবচেয়ে ফলপ্রসূ সময়। তাঁর প্রতিভার সহস্র ধারায় প্রকাশকাল। প্রদীপের নিভে যাওয়ার আগে যেন শেষবারের মতো জ্বলে ওঠা।

১৮২০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল তার শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘লামিয়া এণ্ড আদার পোয়েমস’ (Lamia and Other Poems)। ‘লামিয়া’ ছাড়া এতে আছে ইসাবেলা’ (Isabella), ‘দ্য ইভ অব সেণ্ট অ্যাগ্নিস’ (Eve of St. Agnes), ‘হাইপীরিয়ন’ (Hyperion) নামক কাহিনীমূলক ও প্রেমবিষয়ক দীর্ঘ কবিতাসমূহ এবং তাঁর বিখ্যাত ‘ওড’ (Ode) বা প্রশস্তিমূলক গীতিকবিতাসমূহ। এ ছাড়া ‘ওথো দ্য গ্রেট’ (Otho the Great) এবং ‘কিং স্টীফেন’ (King Stephen) নামক দুটি নাটকও তিনি রচনা করে গেছেন।

‘লামিয়া’ (Lamia) এক নাগিনীকন্যা। দেবতা হার্মিস এই নাগিনীকে এক অপরুপা সুন্দরী নারীতে রূপান্তরিত করেন। রূপান্তরিত লামিয়া করিন-থিয়াবাসী লীশিয়সকে (Lycius) ভালবাসল। রূপমুগ্ধ লীশিয়স গোপনে তাকে নিয়ে যান নিজের গৃহে। সেখানে মিলনোৎসবের ভোজসভায় লীশিয়সের শিক্ষাগুরু বিজ্ঞ অ্যাপোলোনিয়স (Apollonius) এই মায়াবিনীর স্বরূপ প্রকাশ করে দিতেই লামিয়া আর্তনাদ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। পড়ে রইল মর্মাহত লীশিয়াসের সুসজ্জিত দেহ, নিষ্প্রাণ, অসাড়।

কাহিনীমূলক এই দীর্ঘ কবিতাটি অতি-প্রাকৃতের রহস্য ঘেরা কল্পনার চমৎকারিত্বে এবং ভাষা ও ছন্দের কারুকার্যে অনবদ্য। কবিতাটি কোলরিজের (Samuel Taylor Coleridge, ১৭৭২-১৮৩৪ খ্রিঃ) রহস্যমণ্ডিত ‘ক্রিস্টাবেল’ (Christabel) কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। কীটস মনে করতেন, অবশ্য অনেক সমালোচকই মনে করেন দার্শনিকতার সংস্পর্শে কবিতা কল্পনালতা মিলিয়ে যায়। তাই কি এখানে বিজ্ঞ অ্যাপোলোনিয়াসের স্পর্শে লামিয়া অন্তর্হিত? কাহিনীর উৎস বার্টন-এর ‘অ্যানাটমি অব মেলাংকলি’। বার্টনের উৎস আবার রোমান লেখক ফিলোস্ট্রেটাস-এর গ্রন্থ। কাজেই কাহিনীটি মূলত রোমান কল্প-কাহিনী।

ইসাবেলা, অর দ্য পট অব ব্যাসিল’ (Isabella or The Pot of Basil) : ইসাবেল বা ব্যাসিল ফুলের টব—কাহিনীটি ইতালির বিখ্যাত গল্পলেখক বোক্কাচিও (Boccaccio)-র ‘ডেকামেরন’ থেকে নেওয়া। ইসাবেলা ও লরেঞ্জোর (Lorenzo) মধ্যে ছিল গভীর ভালোবাসা। ইসাবেলার ভাইয়েরা তা জানতে পেরে একদিন লরেঞ্জোকে দুরে বনের মধ্যে ভুলিয়ে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। স্বপ্নে জানতে পেরে বিরহকাতরা ইসাবেলা বনমধ্যে হাজির হল এবং মৃতদেহ দেখতে পেল। ব্যথাহতা ইসাবেলা প্রিয়তম লরেঞ্জোর ছিন্ন শির একটা টবে মাটি চাপা দিয়ে রেখে তাতে লাগাল সুগন্ধি গুগ্ম ব্যাসিলের চারা। ব্যাসিলর গুল্মের টবের প্রতি ইসাবেলার আন্তরিক আকর্ষণ দেখে তার নিষ্ঠুর ভাইয়েরা একদিন টবটি চুরি করল। টবটির মধ্যে ছিন্নমুণ্ড দেখে আতঙ্কিত হয়ে তারা পালাল আর হতভাগিনী ইসাবেলা সব হারানোর বেদনায় জর্জরিত হয়ে তিলে তিলে শুকিয়ে মারা গেল। চন্দ্র, সূর্য তারাঘেরা এই বিশ্বসংসারকে ভুলে লরেঞ্জোর ধ্যানে মগ্না উন্মাদিনী ইসাবেলা। এই উন্মাদনাতেই প্রেম মৃত্যুঞ্জয়ী। সেই চিরঞ্জীব প্রেমের এক অপূর্ব রূপ ইসাবেলার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বে পাঠকের সহমর্মিতা লাভ করে প্রেমই জয়ী হয়েছে।

‘দ্য ঈভ অব সেন্ট আগ্নিস’ (The Eve of St. Agnes) : মধ্যযুগের পটভূমিকায় রচিত এক বর্ণাঢ্য আখ্যানমূলক কবিতা। নায়িকা ম্যাডলীন (Madline) এবং নায়ক পফিরো (Porphyro) পরস্পর প্রণয়াসক্ত কিন্তু উভয় পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা বর্তমান। এই মিলনে তাই কোনো পক্ষেরই সায় নেই এবং কার্যত ম্যাডলীন গৃহবন্দিনী। চারপাশে হিংস্র পশুদল ও নিষ্ঠুর প্রহরী দ্বারা বেষ্টিত। লোকশ্রুতিতে ম্যাডলীন শুনেছে যে সেণ্ট অ্যাগ্নিসের স্মরণ দিনের পূর্ব রাত্রে স্বপ্নে কুমারীরা তাদের প্রেমিককে দেখতে পায়। এই স্বপ্ন কামনা নিয়েই রাত্রে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। স্বপ্নে সে দেখল পর্ফিরোকে। স্বপ্ন থেকে জেগে সে দেখল তার পর্ফিরো সেখানে স্বদেহে ই উপস্থিত। তাঁর বিহ্বল অবস্থা কেটে যাওয়ার পর সেই শত্রু-বেষ্টিত পুরীতে কোনো অঘটন ঘটে যাওয়ার আগেই দু’জনে পালিয়ে গেল।

প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বে এখানেও প্রেম জয়ী। তবে ইসাবেলা’তে জয় বিরহে, এখানে জয় মিলনে। এই কবিতাটিতে আধ্যাত্মিকতা, মধ্যযুগীয় সংস্কার ও বিশ্বাস মিলিয়ে কবি পাঠকমনকে ক্ষণকালের জন্য এক মধ্যযুগীয় পটভূমিকায় নিয়ে গেছেন। কবির রচনা এখানে অনেক পরিণত।

‘হাইপীরিয়ন’ (Hyperion) গ্রিক আখ্যামূলক কাব্য। রচনা শুরু করেন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু শেষ হয়। না। কিছুদিন পরে আবার লিখতে শুরু করেন। কিন্তু শেষ সেবারেও হল না। ফলে কাব্যটি অসমাপ্তই রয়ে গেল। হাইপীরিয়নের (সূর্যদেবতার) পৌরাণিক আখ্যান দিয়েই কাব্যের বর্ণনা আরম্ভ হয়েছে। রাজ্যচ্যুত শনি রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সূর্যদেবতা হাইপীরিয়নের সাহায্যপ্রার্থী হন। কিন্তু তাঁর আশা পূর্ণ হয় না। সঙ্গীত, কাব্য ও জ্ঞানের দেবতা ‘অ্যাপোলো’ দেখা দিলেন। কাব্যের প্রথমাংশ এখানেই অসমাপ্ত, দ্বিতীয়াংশে হাইপীরিয়নের পতন (Fall of Hyperion) । কবি স্বপ্নে কোনো মন্দিরের দিকে চলেছেন। পৃথিবীর দুঃখে দুঃখিত সহৃদয় জনেরই সেখানে মাত্র প্রবেশাধিকার। হৃতগৌরব শনির দুঃখে বিষাদময়ী দেবী মনীটা (Moneta, জুনো) কবিকে জানালেন হাইপীরিয়নের পতন হয়েছে এবং রাজ্যলাভ করেছেন অ্যাপেলো। কাব্য শেষ।

সম্ভবত কোনো রূপক তাৎপর্য এখানে কবির অভিপ্রেত ছিল। রচনা এখানে পরিণততর। গ্রিক সৌন্দর্য ও মহাকাব্যের গুণে এই অসমাপ্ত কাব্যটি স্মরণীয় কাব্যটির আঙ্গিক পরিকল্পনা মিল্টনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

কবির এই শেষ কাব্য সংকলন গ্রন্থে এই কাহিনী কাব্যগুলি ছাড়া একটি ছোট্ট সুন্দর কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ‘লা বেল ড্যাম সান্স মার্সি’ (La Bele Dame Sans Merci, the beautiful woman without love)। হৃদয়হীন সুন্দরী কুহকিনী অপ্সরার প্রেমে মুগ্ধ মধ্যযুগীয় নাইট এক সৈনিক। সেই অপ্সরা এক প্রান্তরে একদিন অশ্বপৃষ্ঠে এই বীর সৈনিকের সঙ্গে ভ্রমণে বেরিয়েছিল। তারপর সৈনিক ঘুমিয়ে পড়ে, সেই অবসরে নিঠুরা সুন্দরী অপ্সরা পালিয়ে যায়। দিনের পর দিন দীর্ঘ বিরহ ভোগের দুঃসহ তাপে সৈনিকের মুখ শুকনো, চক্ষু কোটরগত, তার জগৎ বিবর্ণ, তবু খ্যাপা খুঁজে ফিরে পরশপাথর। কিন্তু তাপ্সরা আর এলো না। কবিতাটি আকারে ছোটো কিন্তু সার্থক কবিতা। মধ্যযুগীয় করুণ রোমান্টিক প্রেমের চিত্র এখানে চিরকালীন হয়ে উঠেছে।

এ ছাড়া কবির বিখ্যাত ‘ওড’ (Ode)-গুলিও এই কাব্য সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে ‘ওড টু এ নাইটিঙ্গেল’, ‘ওড অন এ গ্রীসিয়ান আর্ন’, ‘ওড অন মেলাংকলি’, ‘ওড টু অটাম’ প্রভৃতি কবির বিখ্যাত কবিতা।

কবির প্রথমদিকে কাব্যগুলি প্রশংসার চেয়ে নিন্দা বেশি কুড়োলেও তাঁর এই শেষ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি বিশেষ করে তাঁর ‘ওড’গুলি ‘এডিনবরা রিভিয়্যু’তে উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছিল, পেয়েছিল রসিকজনের স্বীকৃতি এবং পেয়েছে মহাকালের জয়তিলক। তাঁর জীবনটা ছোটো, কাব্যের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু তাঁর সামান্য উপকরণের মধ্যেই আছে অসামান্যের স্পর্শ। ছোটর মধ্যেও বিরাটের ব্যঞ্জনা নিয়ে তিনি তাঁর সমকাল ও ভবিষ্যৎকালের পাঠকমনে অনেকখানি স্থান জুড়ে আছেন। মহাকাল তাঁর ‘সোনার তরী’তে কবির সোনার ফসল নিয়ে কালের ঘাটে ঘাটে আজও এগিয়ে চলেছেন।