বন্ধ্যাযুগ: প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ মহামনীষী ম্যাক্সমূলরের অভিমতকে মূল্য দিলে বলতে হয়, ভারতবর্ষে লৌকিক সংস্কৃত সাহিত্যের প্রকৃত প্রবর্তকের মর্যাদা প্রাপ্য মহাকবি কালিদাসেরই। ম্যাক্সমূলর মনে করেছিলেন যে, বৈদিক যুগের সুদীর্ঘকাল ছিল সাহিত্যের ‘বন্ধ্যাযুগ’। কালিদাসের কাল থেকেই দেখা দেয় ‘পুনর্জাগরণ’ এবং কালিদাস সাহিত্য-রচনা দ্বারা ‘লৌকিক সংস্কৃত সাহিত্যে’ ‘সমৃদ্ধি যুগে’র সূচনা করেন। ম্যাক্সমূলরের এই সিদ্ধান্ত কিছুকালের জন্যই মাত্র স্বীকৃতি পেয়েছিল। বর্তমান শতকের গোড়ার দিকেই দুটি আকস্মিক আবিষ্কার তাঁর এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিকে টলিয়ে দেয়। একটি আবিষ্কার—বৌদ্ধ আচার্য অশ্বঘোষের কিছু বিলুপ্ত রচনা, অপরটি ভাসের নাটকচক্র। ম্যাক্সমূলর যে যুগটাকে ‘বন্ধ্যাযুগ’ নামে অভিহিত করেছিলেন অশ্বঘোষ (আঃ ১০০ খ্রিঃ) এবং ভাস (আঃ খ্রিঃ তৃতীয় শতাব্দ) সেই যুগেই বর্তমান ছিলেন; অতএব এই যুগটাকে যেমন আর ‘বন্ধ্যাযুগ’ নামে অভিহিত করবার সার্থকতা থাকে না তেমনি কালিদাসের আবির্ভাবেও আর পুনর্জাগরণের সূচনা বলে মনে করা চলে না। কিন্তু কালিদাসের আবির্ভাব যে সংস্কৃত সাহিত্যের ‘সমৃদ্ধিযুগে’র সূচনা করেছিল, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

বিক্রমাদিত্য ও নবরত্নসভা : সংস্কৃত সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কালিদাস—কথাটি সর্বার্থেই সত্য বলে মেনে নিতে হয়। কারণ প্রবাদ ছাড়া কালিদাসের জীবনের কোনো পরিচয় কোনো সূত্রেই পাবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু প্রচলিত প্রবাদগুলিও নির্ভরযোগ্য নয়; কারণ, ‘প্রবাদ’ অনুযায়ী তিনি যে প্রথম জীবনে মূর্খ এবং নির্বোধ ছিলেন, তা কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভবপর নয়। বিভিন্ন বিষয়ে এবং শাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্যের যে পরিচয় তাঁর গ্রন্থগুলি থেকে পাওয়া যায়, তা কখনও ভুঁইফোড় হতে পারে না। বিভিন্ন জনশ্রুতির মধ্যে একমাত্র ‘জ্যোতির্বিদাভরণ’ নামক এক জ্যোতিষগ্রন্থে রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভার অন্যতম রত্নরূপে যে কালিদাস এবং কয়েকজন শ্রুতকীর্তি কবি-মনীষীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, এটিই অন্ধকারের মধ্যে আলোকবর্তিকা রূপে গ্রহণ করে পণ্ডিতগণ কালিদাসের পরিচয় উদ্ঘাটনে ব্রতী হয়েছেন। কিন্তু সমস্যা এখানেও রয়েছে। প্রথমত, ‘জ্যোতির্বিদাভরণ’ গ্রন্থের রচয়িতারূপে স্বয়ং কালিদাসের নাম উল্লেখ করা হলেও তার স্বপক্ষে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ নেই, দ্বিতীয়ত, গ্রন্থে যে রাজা বিক্রমাদিত্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তার পরিচয়ও অজ্ঞাত; বরং এতে সমস্যার জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এই কারণে যে, ভারতের ইতিহাসে ‘বিক্রমাদিত্য’ নাম বা উপাধিধারী অনেক নরপতি বর্তমান ছিলেন। তাঁদের কোনজন ছিলেন নবরত্নসভার পৃষ্ঠপোষক, তার কোনো ইঙ্গিত গ্রন্থে নেই। তৃতীয়ত, গ্রন্থে নবরত্ন সভার কবিদের নাম প্রদত্ত হয়েছে কালিদাস, ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, অমরসিংহ, শঙ্কু, বেতালভট্ট, ঘটকর্পর, বরাহমিহির এবং বররুচি। এঁদের অনেকেরই রচনার সন্ধান এবং কথঞ্চিৎ পরিচয়ও পাওয়া যায়, কিন্তু এরা যে একই কালে বর্তমান ছিলেন তা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ‘উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের সভাকবি ছিলেন কালিদাস’—এই সূত্রটিকে অবলম্বন করেই কালিদাসের কাল নির্ণয়ে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

(ক) কালিদাসের আবির্ভাব কাল:

হায়রে করে কেটে গেছে কালিদাসের কাল

পণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ সাল।

কালিদাসের অমর কাব্য সমূহ মহাকালের নৌকায় কালান্তরের পথ পেরিয়ে বর্তমানের ঘাটে এসে পৌঁছালেও কাব্য স্রষ্টা কালিদাস বিস্মৃতির বল্মীকস্তূপে চাপা পড়ে গেছেন। তাঁর ব্যক্তি পরিচয় আজ অনেকটাই কিংবদন্তী নির্ভর। বিস্মৃতির বল্মীক স্তুপ চাপা পড়ে শুধু রামায়ণকারই বাল্মীকি নন, সেদিক থেকে বেদব্যাস, এমন কি মধ্যযুগের চণ্ডীদাস প্রমুখ সবাই একই সঙ্গে বিস্মরণীয় ও অবিস্মরণীয় এবং এঁদের ব্যক্তি পরিচয় সম্বলিত আবির্ভাব কাল নিয়ে তর্ক আজও অনবসিত।

বাল্মীকি ও বেদব্যাসের পরই সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসের স্থান। তাঁর রচনাবলীর আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে মনে হয় উজ্জয়িনীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল।

কালিদাসের জীবৎকাল: কালিদাসের জীবৎকাল বিষয়ে তিনটি অভিমত প্রচলিত আছে। স্যার উইলিয়ম জোন্স এবং বহু ভারতীয় মনীষী মনে করেন যে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় কালিদাস বর্তমান ছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ ঐ কালে ভারতবর্ষে বিক্রমাদিত্য নামে কোনো রাজার সন্ধান পান নি। এছাড়া কালিদাসের রচনায় ‘ভাসে’র নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁর রচনায় অশ্বঘোষের প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু অশ্বঘোষ নিশ্চিতভাবেই ১০০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ছিলেন এবং ভাস সম্ভবত খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে বর্তমান ছিলেন, কাজেই কালিদাস-এর পরবর্তীকালের লোক ছিলেন। তবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে শৃঙ্গ বংশের রাজত্বকালের ‘ভিটা পদকে’ যে চিত্রটি পাওয়া যায়, তার সঙ্গে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ নাটকের প্রারম্ভিক দৃশ্যটির সাদৃশ্যের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

ম্যাক্সমূলার, ফার্গুসন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতি অনুমান করেন যে ৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে উজ্জয়িনী-রাজ হর্ষ বিক্রমাদিত্য ভারতবর্ষ থেকে শক জাতিকে বিতাড়ন করে ‘বিক্রমাব্দ’ প্রচলন করেছিলেন, তাঁর রাজসভাতেই কালিদাস অধিষ্ঠিত ছিলেন। এর সমর্থনে অতিরিক্ত দু’টি যুক্তি এই—নবরত্ন সভার অন্যতম সদস্য বরাহমিহির ৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এবং কালিদাসের প্রতিদ্বন্দ্বী দিনাগ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে বর্তমান ছিলেন। তবে কালিদাসের কাল-বিষয়ক তৃতীয় অভিমতের আলোচনায় এর বিরোধী যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য : ম্যাকডোনেল, কীথ, ভিনসেন্ট স্মিথ প্রভৃতি অনুমান করেন যে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের শেষ থেকে পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধেই কালিদাস বর্তমান ছিলেন। ফার্গুসন যে ‘শক-বিতাড়ন’ এবং ‘বিক্রমাব্দ’ প্রবর্তনের কথা বলেছেন, সেই অনুমান ভ্রান্ত; বস্তুত উক্ত তারিখের শতাধিক বৎসর পূর্বে প্রচলিত হয়েছিল ‘মালবাব্দ নামে—’বিক্রমাব্দ’ নামটি প্রচলিত হয় নবম শতাব্দীতে; আর ঐ সময়ে শক-বিতাড়নের প্রশ্নই ওঠে না, কারণ তখন পশ্চিম ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত এবং ষষ্ঠ শতকে যিনি হুণদের ভারত থেকে বিতাড়িত করেছিলেন তিনি ‘বিক্রমাদিত্য’ নন, তাঁর নাম হল ‘যশোবর্মন বিষ্ণুবর্মন’। ‘দিনাগ’ সম্বন্ধীয় উক্তিটির ভিন্নার্থ থাকাই সম্ভব। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দে বাণভট্ট কালিদাসের নাম উল্লেখ করেছেন, সমকালীন আইহোল প্রস্তরলিপিতে কালিদাসের নাম। পাওয়া যায়; ৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে মান্দাসোরের সূর্যমন্দিরে খোদিত কোনো কোনো শ্লোকে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ এবং ‘ঋতুসংহার’ কাব্যের প্রতিরূপ লক্ষ্য করা যায়। অতএব কালিদাসকে কোনোক্রমে পঞ্চম শতকের পরে স্থান দেওয়া চলে না। এবার সদর্থক দিক দিয়ে আলোচনা করে কীথ বলেন, গুপ্তবংশীয় সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১৩ খ্রিঃ) ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে উজ্জয়িনীতে সরিয়ে নিয়ে যান। সেই উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার এক উজ্জ্বল রত্ন ছিলেন কালিদাস। অধিকন্তু কালিদাসের ‘বিক্রমোৰ্বশীয়’ কাব্য ‘বিক্রম’ নামের এবং ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে বিক্রমাদিত্য-পুত্র কুমারগুপ্তের নাম-সাদৃশ্যও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এইসব মিলিয়ে কীথ মন্তব্য করেছেন, “Kalidasa then lived before A.D. 472 and probably at a considerable dis tance, so that to place him about A.D. 400 seems completely justified.”—অতএব কালিদাস খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের শেষ থেকে পঞ্চম শতকের কিছুকাল পর্যন্ত বর্তমান ছিলেন—এই অভিমতই সর্বথা গ্রহণযোগ্য।

(খ) কালিদাসের রচনাবলী ও রচনা বৈশিষ্ট্য:

কালিদাসের রচনাবলী: কালিদাস সম্বন্ধীয় একটি প্রবাদবাক্যে জানা যায় যে, বিবাহরাত্রেই কালিদাস গণ্ডমূর্খ প্রমাণিত হওয়াতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে গৃহ থেকে বহিষ্কার করে দেন; মনোদুঃখে কালিদাস আত্মহত্যা করতে গেলে দেবী সরস্বতীর কৃপায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বাপটুতা অর্জন করে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে দ্বারে করাঘাত করে তাঁর স্ত্রীকে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে জানালেন ‘অস্তি কশ্চিৎ বাগ্‌বিশেষঃ’ অর্থাৎ একটি কথা আছে। পরবর্তীকালে এই বাক্যটির প্রতিটি শব্দকে আরম্ভরূপে গ্রহণ করে তিনি চারটি কাব্য রচনা করেন। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের প্রথমেই ‘অস্তি’ (অস্ত্রাত্তরস্যা দিশি হিমালয়ঃ নামো নগাধিরাজঃ) ‘মেঘদূত কাব্যে’র আরম্ভে ‘কশ্চিৎ’ (‘কশ্চিৎ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ), ‘রঘুবংশ’ কাব্যের আদিতে ‘বাগ্‌’ (‘বাগর্থবির সম্পৃক্তৌ বাগর্থপ্রতিপত্তয়ে’)—‘বিশেষ’ শব্দের সাহায্যে আবদ্ধ কোনো রচনার সাক্ষাৎ না পাওয়াতে অনুমিত হয়, উক্ত কাব্যটি হয়তো কাল-কবলিত হয়েছে। অবশ্য এ সমস্তই গল্পকথা। বাস্তবে কালিদাসের নিজস্ব রচনা ছাড়াও এমন গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের গ্রন্থকর্তৃত্ব কালিদাসে আরোপিত হলেও তা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। যাহোক, অন্তত ছয়খানি গ্রন্থ কালিদাস রচনা করেছিলেন এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এদের মধ্যে রয়েছে তিনখানি নাটক (১) ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’, (২) ‘বিক্ৰমোবশীয়’, (৩) ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’; দু’খানি মহাকাব্য – (৪) ‘কুমারসম্ভব’ ও (৫) ‘রঘুবংশ’ এবং একখানি খণ্ডকাব্য— (৬) ‘মেঘদূত’। অপর একখানি খণ্ডকাব্য (৭) ‘ঋতুসংহার’ সাধারণভাবে কালিদাসের রচনা বলে স্বীকৃতি লাভ করলেও এ বিষয়ে কেউ কেউ মনে সন্দেহ পোষণ করেন। অষ্টম/নবম শতাব্দীতে রাজশেখর ‘কালিদাস’ নামক তিনজন কবির উল্লেখ করেছেন। এ থেকে স্পষ্টতঃই অনুমিত হতে পারে, অপর কালিদাসের রচনাও মহাকবি কালিদাসের নামে আরোপিত হয়ে থাকতে পারে। এরূপ গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে— নলোদয়, রাক্ষসকাব্য, পুষ্পবাণ-বিলাস, শৃঙ্কারতিলক, দুর্ঘটকাব্যচিত্রকা, দুষ্করমালা, চিদ্‌গগনচন্দ্রিকা, ভ্রমরাষ্টক, শ্রুতবোধ, অর্থাস্তর, লঘুস্তবক, কালীস্তোত্র, বিদ্বদবিশেষ কাব্য, গঙ্গাষ্টক, মঙ্গলাষ্টক, শৃঙ্গারসার, বৃন্দাবন কাব্য, চণ্ডিকাদগুস্তোত্র, ঘটকর্পর এবং প্রাকৃত ভাষায় ‘রাবণবহো’ বা সেতুবন্ধ।

‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌’ নাটক কালিদাসের শ্রেষ্ঠ কৃতিরূপে অভিনন্দিত। মহর্ষি করে তপোবনে পুরুবংশীয় নৃপতি দুষ্মন্তের সঙ্গে শকুন্তলার গান্ধর্ব বিবাহ, দুর্বাশার অভিশাপে তাদের সাময়িক বিচ্ছেদ ও পরিশেষে মহর্ষি মারীচের আশ্রমে পুত্রবর্তী শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের মিলন—এই হচ্ছে সপ্তাঙ্ক-বিশিষ্ট নাটকের কথাবস্তু।

পাঁচ অঙ্কে রচিত ‘বিক্রমোবশীয়’ নাটকের ঋগ্‌বেদে-গ্রন্থিত মর্ত নৃপতি পুরুরবা বা শাপভ্রষ্টা উর্বশীর প্রণয়কাহিনী নব নাট্যরূপ লাভ করেছে।

অপর উল্লেখযোগ্য পাঁচ অঙ্কে নিবদ্ধ ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকে রাজা অগ্নিমিত্র ও মালবিকার প্রণয়কাহিনী রসঘন রূপায়ণ হয়েছে। প্রণয় প্রত্যাখ্যাতা তরুণী মহিষী দুরাবতীর ঈর্ষামূলক আচরণ ও প্রৌঢ়া মহিষী ধারিণীর ঔদার্য—এই উভয়ের সংঘাতের সঙ্গে বিদুষক গৌতমের উপভোগ্য চটুলতা এই নাটককে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

সপ্তদশ সর্গে রচিত মহাকাব্য ‘কুমারসম্ভব’। তারকাসুরের বধের নিমিত্ত মহাদেব ও হিমালয় দুহিতা পার্বতীর বিবাহ ব্যবস্থা এবং কুমার কার্তিকেয়ের জন্ম–এই কাব্যের উপজীব্য। এর প্রথম সাতটি সর্গ কালিদাসের এবং পরের দশটি সর্গ প্রক্ষিপ্ত বলে পণ্ডিতগণ অনেকে মনে করেন।

কালিদাসের দুটি মহাকাব্যের মধ্যে উনিশ সর্গে রচিত ‘রঘুবংশ’ পরিণততর। রঘুকুল স্থাপনের ইতিবৃত্ত দিয়ে— নৃপতি দিলীপ থেকে আরম্ভ করে অগ্নিবর্ণ পর্যন্ত ২৭ জন সূর্যবংশীয় নৃপতির উত্থান পতনের কাহিনী এখানে বিবৃত হয়েছে।

মেঘের মাধ্যমে বিরহিণী প্রিয়ার নিকট এক নির্বাসিত যক্ষের বার্তাপ্রেরণ ‘মেঘদূত কাব্যের উপজীব্য। পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ দুই অংশে কাব্যটি বিভক্ত। কাব্যটি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং পরবর্তী বহু কবি এই কাব্যের অনুকরণে বহু দূতকাব্য রচনা করেন।

ছয় সর্গে বিভক্ত ‘ঋতুসংহার’ খণ্ডকাব্যে অনুরাগীজনের দৃষ্টিতে ছয় ঋতুতে প্রকৃতির রূপ বৈশিষ্ট্য সাবলীলভাবে বর্ণিত হয়েছে।

কাব্য ও নাটকে কালিদাস প্রেমকেই প্রেমের চরম গৌরব বলে স্বীকার করেন নি। তিনি আত্মসংবৃত প্রেমের মঙ্গলময় সৌন্দর্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আসক্তি বিমূঢ় হৃদয়ে কর্তব্য পালনে পরান্মুখ হলে তার অনিবার্য প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজনীয়তা তিনি প্রতিপন্ন করেছেন।

কালিদাসের কাব্যে বৈদভী রীতির অনবদ্য নিদর্শন। লোকোত্তর কবিপ্রতিভার জন্য কালিদাসকে শেক্‌সপীয়র, মিল্টন, দান্তে, গোটে প্রমুখ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও কবিকুলের মধ্যে সমান পতিভুক্ত করা যায়।