চণ্ডীমঙ্গল-এ আছে দুটি কাহিনি, আখেটিক খণ্ড ও বণিক খণ্ড, দুটি খণ্ডই স্বতন্ত্র। চণ্ডী শব্দটি আসলে অনার্য ভাষা সঞ্জাত-অস্ট্রিক বা দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে। দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠীরা চণ্ডী নামক এক শক্তিদেবীর পূজা করত যে দেবী শিকারী ও যোদ্ধাদের বিজয়দাত্রী। চণ্ডীমণ্ডলের আখেটিক (ব্যাধ) খণ্ডের নায়ক কালকেতুর আরাধ্যা দেবীর সঙ্গে এই চণ্ডীর বহু সাদৃশ্য বর্তমান। দ্রাবিড় ওরাওঁ জাতির চন্ডী ও চণ্ডীমঙ্গলের ব্যাধ-কাহিনি বর্ণিত চণ্ডীদেবীর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস গ্রন্থে প্রচুর প্রচুর তথ্য সহযোগে এই মত প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে বণিকখণ্ডে ধনপতি সওদাগরের গল্পের ক্ষেত্রে চণ্ডী যেন গৃহস্থ ঘরের কল্যাণ সাধিকা দেবী। উভয় কাহিনির ভিত্তি ভূমিটি স্বতন্ত্র দেব-পরিকল্পনা উদ্ভূত।

মঙ্গলকাব্যের চণ্ডী লৌকিক ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে পৌরাণিক ধর্মের মিলন জাত মিশ্রফল একথা স্বীকার্য। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে দেবী এই যে ব্যাধের দ্বারা নিজের পূজা মর্তে প্রচার করলেন, বাংলাদেশের এই লোক প্রচলিত কথার কি কোনও ঐতিহাসিক অর্থ নেই ? পশুবলি প্রভৃতির দ্বারা যে ভীষণ পূজা এককালে ব্যাধের মধ্যে প্রচলিত ছিল সেই পূর্ছাই কি কালক্রমে উচ্চসমাজে প্রবেশ লাভ করেনি? সুতরাং মঙ্গলকাব্যের চণ্ডীর পিছনে অন্-আর্য লৌকিক সংস্কৃতি যে পটভূমি সৃষ্টি করেছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ব্যাধের অত্যাচার হতে পশুদের রক্ষা করবার জন্য দেবী চণ্ডী ব্যাধকে প্রচুর ধন দিয়ে বন কেটে রাজ্যস্থাপন করিয়েছেন। এই কাহিনির মধ্যে বাঙ্গলা দেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তের অরণ্য অঞ্চলের মনুষ্যবাসের ও রাজ্যস্থাপনের প্রাগৈতিহাসিক কল্পনা কিছু আছে বলে মনে হয়।

দ্বিতীয় কাহিনিতে দেবী অরণ্য পালিকা। দুর্গত নায়িকা খুল্লনাকে স্বপ্ন দেওয়া এবং হারানো পশু ফিরিয়ে দিয়ে তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছেন। গৃহিণীকে নবদেবতার পূজায় রত দেখে শিবভক্ত পতি ধনপতি তা বরদাস্ত করলেন না। দেবীর কোপে বিদেশে তাঁর কারাবাস হল। দীর্ঘকাল পরে পুত্র শ্রীমস্ত দেবীর সাহায্যে পিতাকে উদ্ধার করে এবং রাজকন্যাকে বিবাহ করে ধনসম্পত্তি সহ দেশে ফেরে। দেবী কমলে কামিনীর বর্ণনা, রোমান ঐতিহাসিক তাসিতুসের জার্মান ইতিহাসে যে দেবীর উল্লেখ আছে তার সাথে মেলে।

সাগরের মধ্যে কালিদহ। তাতে প্রস্ফুটিত চৌষট্রিদল পদ্ম, তার উপরে ষোড়শী কন্যা বসে আছে। তার হাতে একটি বা দুটি) হাতি, একবার গিলছে আবার উদ্‌গার করছে। এই দৃশ্য ধনপতির পরে তার পুত্র দেখে সত্য মনে করে। রাজাকে দেখাতে না পেরে প্রাণদণ্ডের আদেশ পায়। আসলে এখানে “নাগ” এবং সে নাগ হাতি নয়, সাপ। মনসা কমলার মুখ হতে সাপ বের হওয়া ও পুনরায় মুখের মধ্যে চলে যাওয়া অসম্ভব বা অশ্রুত পূর্ব ব্যাপার নয়। এই অংশটুকু রূপকথার অংশ হলেও কাহিনিকে জোরালো করবার জন্য এবং প্রাচীনতর মনসামঙ্গলের ধনপতির দুর্গতির সঙ্গে তাল রাখবার জন্য সংযোজিত হয়েছিল। হাতির সঙ্গে অভয়া চণ্ডীর যোগাযোগ গজলক্ষ্মীতে। লক্ষ্মণ সেনের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে চণ্ডী মূর্তির উপর দুটি হাতি জল ঢালছে— আঁকা আছে। মূলত কমলে কামিনী তারই সঙ্গে সাজুয্য রেখেই রচিত।

মঙ্গলকাব্যের কালকেতু ও ধনপতির প্রশংসা ও চারিত্রিক গুণাবলী বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে আসা যায়—মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কাহিনিতে মানবিক রসের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। কলিঙ্গরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে কালকেতুর নগর পত্তন, ধনপতির আদর্শকে টিকিয়ে রেখে সিংহল রাজ্যে প্রত্যাবর্তন—এগুলো ইতিহাসবিরচিত কাহিনি ধারায় পর্যবসিত হয়েছে মাত্র। তবে এক চিত্তে স্বীকার করতেই হয়, কবিকঙ্কণ তাঁর কাব্যে ঐতিহাসিক তার ছাপ ফেলেছেন বলেই পাঠকের পক্ষে ঐতিহাসিক রসাস্বাদন সম্ভব হয়েছে।