ভূমিকা : কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর গ্রন্থটি ‘চণ্ডীমঙ্গল’ নামে একালে পরিচিত হলেও কবি নিজে কোথাও এই নামটি ব্যবহার করে নি। গ্রন্থমধ্যে ‘নৌতুন মঙ্গল’ বা ‘নুতন মঙ্গল’ নামেই এর পরিচয়, কোথাও বা একে বলা হয়েছে ‘অভয়া মঙ্গল’। মূল গ্রন্থটি দুই খণ্ডে বিভক্ত—প্রথম খণ্ডের নাম ‘আখেটিক খণ্ড’ বা ‘কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনী এবং দ্বিতীয় খণ্ডের নাম ‘বণিক খণ্ড’ বা ধনপতি-লহনা-খুল্লনা-শ্রীমস্ত সদাগরের কাহিনী। এদের মধ্যে প্রথম খণ্ড বা কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনীই পাঠ্যতালিকাভুক্ত এবং সর্বাধিক পরিচিত। এই কাহিনীটিতেও আবার দুটি পর্ব আছে একটি ‘দেবখণ্ড’ বা ‘হরগৌরীর কাহিনী’,— মূলত এটি ‘শিবায়ন-কাহিনী’, অপরটি ‘নরখণ্ড’ বা ‘কালকেতু কাহিনী’। সমগ্র গ্রন্থটিতে দেবী ও মানবী নারীর তিন ধরনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ডঃ সুকুমার সেন এটিকে এভাবে দেখিয়েছেন- “প্রথম ভাগে দরিদ্র সংসারের গৃহিণীর পিতৃগৃহে অনাদর ও পতিগৃহে অসচ্ছলতা, দ্বিতীয় ভাগে স্বামী-স্ত্রীর দরিদ্র সংসারে সপত্নীর সম্ভাবনা, তৃতীয় ভাগে ধনীসংসারে সপত্নীর সমস্যা এবং পুত্রবর্তীর বেদনা। নারী প্রথম ভাগে দেবলোকে নব-বিবাহিতা স্ত্রী, দ্বিতীয় ভাগে দরিদ্র সংসারে সর্বময়ী কর্ত্রী, তৃতীয় ভাগে ধনী-সংসারে সুভগা গৃহিণী।”—এই বিশ্লেষণে আমরা প্রথম ভাগে পাচ্ছি হরগৌরীর কাহিনী, দ্বিতীয় ভাগে কালকেতু-ফুল্লরার ব্যাধ জীবন কাহিনী এবং তৃতীয় ভাগে ধনপতির লহনা-খুল্লনার বণিক জীবন কাহিনী প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে ধনপতির পুত্র শ্রীমন্তরও দুই স্ত্রী, অতএব সতীনের সংসার পূর্বোক্ত প্রথম দুটি ভাগেই গ্রন্থের প্রথম খণ্ড অর্থাৎ ‘আখেটিক খণ্ডে ‘র অন্তর্ভুক্ত।
প্রথম পর্ব : হরগৌরীর কাহিনী
গ্রন্থের প্রথমেই বিভিন্ন দেব-দেবীর বন্দনার পর কবি গ্রন্থ রচনার কাহিনী বর্ণনা করেন। মানসিংহের সুবেদারি কালে ডিহিদার মামুদ সরীফের অত্যাচার আশঙ্কায় কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী স্ত্রী-পুত্রাদি সহ গোপনে গৃহত্যাগ করে নানাবিধ বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণভূমি আরড়ার উপনীত হ’য়ে তথাকার রাজা বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় লাভ করেন। পথিমধ্যে দেবী স্বপ্নে তাকে দেখা দিয়ে গ্রন্থ রচনার আদেশ করেন। মুকুন্দ আরড়ায় অবস্থানকালেই তার ‘নৌতুন মঙ্গল’ বা ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। এরপর সৃষ্টিপত্তন কাহিনী বর্ণনার পর কবি মূল কাহিনী শুরু করেন।
কোনো এক যজ্ঞসভায় দক্ষ তার জামাতা শিব-কর্তৃক অনাদৃত হয়েছেন মনে করে স্বয়ং এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেন, কিন্তু শিবকে নিমন্ত্রণ করা হল না। শিব-গৃহিণী দক্ষকন্যা সতী তৎসত্ত্বেও অর্থাৎ অনিমন্ত্রিত অবস্থায় সেই যজ্ঞে গেলেন শিবের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই যজ্ঞস্থলে শিবনিন্দা শুনে সতী দেহত্যাগ করলেন এবং হিমালয়-গৃহে উমারূপে জন্মগ্রহণ করলেন। কালে তার বিবাহের বয়স হয়েছে। নারদ উপযাচক হয়ে সংবাদ দিলেন যে উমা বয়ঃপ্রাপ্তা বলেন— স্বয়ং মহাদেব তপস্যার নিমিত্ত হিমালয়ে উপস্থিত হয়েছেন। হিমালয় শিবের নিকট অনুমতি চাইলেন—
‘আমার জনম আজি হইল সফল।
মম কন্যা নিত্য দিবে কুশ পুষ্প জল।।’
মহাদেবের অনুমতি নিয়ে পার্বতী উমা তথা গৌরী তার পূজার উপকরণ যোগাতে লাগলেন। এদিকে স্বর্গে অসুরের অত্যাচার আরম্ভ হয়েছে একমাত্র শিবপুত্র ছাড়া অপর কেউ তাকে পরাজিত করতে পারবে না। অতএব দেবতাগণ মহাদেবকে সংসারী করবার জন্য উদ্যোগী হয়ে মদনকে পাঠালেন মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ করবার জন্য। মদন মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করলেও নিজে ভস্ম হলেন। শিব উঠে গিয়ে অন্যত্র ধ্যানে মগ্ন হলেন। এ অবস্থায় পার্বতী উমা নিজেও কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়ে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করলে মহাদেব পার্বতীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে স্বীকৃত হলেন। মহাদেবের সঙ্গে যথাবিধি উমার পরিণয় সম্পন্ন হল।
বিবাহের পর শিব হলেন ঘর জামাই হর-গৌরী দুজনেই হিমালয়-গৃহে বাস করতে লাগলেন। কালক্রমে তাদের দুটি পুত্রসন্তান হল-কার্তিক ও গণেশ। সংসার বৃদ্ধিতে হিমালয় গৃহিণী মেনকার কাজ অনেক বেড়ে গেল, সাংসারিক স্বচ্ছলতারও অভাব ঘটল। কন্যা গৌরী ঘরকন্নার কাজে মেনকাকে কিছু সাহায্য করেন না। মেনকার অস্তরে জমা অসত্তোষ একদিন বিস্ফোরণ ঘটালো। মেনকা উমাকে লক্ষ্য করে বলেন—
‘তোমা ঝি হৈতে মজিল গিরিয়াল।
ঘরে জামাই রাখিয়া পুষিব কতকাল।…..
রাহ্ম্যে বাড়ো দিতে মোর কাকালে হৈল বাত।’
মায়ের গঞ্জনা গৌরী নিবির্বাদে সহ্য করলেন না, তিনিও প্রত্যুত্তরে বলেন—
‘জামাতারে বাপ মোর দিল ভূমিদান।
তথি ফলে মসুর কাপাস মাষ ধান।।’
তোমার খাই না পরি- অতএব,
‘রান্ধ্যে বাড়ো দেও বলো কত দেও খোঁটা।
আজ হৈতে তোমার দুয়ারে পড়লো কাঁটা।।’
রাগ ক’রে স্বামিপুত্র-সহ গৌরী পিতৃগৃহ ছেড়ে চলে আসেন স্বামিগৃহ কৈলাসে। কিন্তু শিবের তো কোনো সহায়-সম্বল নেই, তবে সংসার চলে কী ক’রে? অতএব শিব ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করলেন। কিন্তু তাতেই কি আর সংসার চলে। একদিন গৌরী শিবকে বল্লেন, তার ত্রিশূল বাঁধা দিয়ে চাউল যোগাড় করতে। এতে শিব রাগ করে বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইলেন। তখন গৌরী বল্লেন,- তুমি সংসার ছাড়বে কেন? যেতে হয় তো আমিই যাবো। এই বলে তিনিও যখন গৃহত্যাগে উদ্যতা হলেন, তখন সখী পদ্ম তাকে বল্লেন যে স্বামিগৃহ ছেড়ে কোথাও আশ্রয় পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে বরং ভগবতী মর্ত্যলোকে পূজা প্রচার করলে আর কোনো অভাব থাকবে না। দেবী এই যুক্তি মেনে নিয়ে মহাদেবকে অনুরোধ করলেন- মহাদেব যেন শাপ দিয়ে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে মর্ত্যলোকে পাঠিয়ে দেন—নীলাম্বর মর্ত্যলোকে গিয়ে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করবেন। মহাদেব দেবীর কথায় কূট-কৌশলে ইন্দ্ৰপুত্র নীলাম্বরকে শাপ দিয়ে মর্ত্যলোকে পাঠালেন। নীলাম্বর মর্ত্যলোকে ব্যাধসস্তান কালকেতুরূপে এবং তৎ-পত্নী ছায়া ব্যাধকন্যা ফুল্লরারূপে জন্মগ্রহণ করলো।
দ্বিতীয়-পর্ব : কালকেতু-কাহিনী
দেবী চণ্ডী পূজা প্রচারে মনোনিবেশ ক’রে প্রথমে কলিঙ্গরাজের পূজা গ্রহণ করলেন এবং সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন-পথে বনের পশুদের পূজা গ্রহণ ক’রে সিংহকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত ক’রে পশুদের অভয় দান ক’রে গেলেন। এদিকে ধর্মকেতু ব্যাধের পুত্র কালকেতু অমিতবলশালী হ’য়ে উঠলো। তার সঙ্গে যথাকালে বিয়ে হল সঞ্জয়কেতু ব্যাধের কন্যা ফুল্লরার। কালকেতু ফুল্লরাকে ঘর সংসারে থিতু ক’রে ধর্মকেতু তৎপত্নী নিদয়া সহ কাশীবাসী হল। এদিকে ফুল্লরা নিয়মিত হাট-বাজার করে সংসার চালায়—
‘মাংস বেচি লয় কড়ি চালু লয় দাল বড়ি
তৈল লোন কিনয়ে বেসাতি।
শাক বাইগন মূলা আঁট্যা থোড় কাচকলা
সকলি পুরিয়া লয় পাথি।।’
ওদিকে কালকেতুর অত্যাচারে বনের পশুরা প্রচণ্ড রকমে নির্যাতিত হয়ে দেবীর দেউলে গিয়ে দেবীর নিকট কেঁদে পড়ল। প্রত্যেক পশুই দেবীর নিকট বীর কালকেতুর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়।
‘উই চারা খাই বনে জাতিতে ভালুক।
নেউগি চৌধুরি নহি না করি তালুক।।’
হাতি বলে—
‘বড় নাম বড় গ্রাম বড় কলেবর।
লুকাইতে ঠাঁই নাই বনের ভিতর।।’
হরিণ বলে—
‘কেন হেন জন্ম বিধি কৈল পাপ বংশে।
জগৎ হৈল বৈরী আপনার মাংসে।।’
পশুদের কাতর ক্রন্দনে দেবী তাদের নিঃশঙ্কিতে জীবন-যাপন করবার ভরসা দিয়ে তিনি সেইখানে সুবর্ণ গোধিকারূপ হৈলা”।
এদিকে অন্যান্য দিনের মতোই কালকেতু শিকারে বেরিয়ে বনে প্রবেশের মুখেই অযাত্রা ‘সুবর্ণ গোধিকা’ দেখতে পেয়ে ওটিকে বেঁধে রেখে বনে প্রবেশ করলো কিন্তু সারাদিন কোনো শিকারই না জোটায় ফিরতি পথে ঐ সুবর্ণ গোধিকাকেই ধনুর ছিলায় বেঁধে ফিরলো। এটিকে শিল চাপা দিয়ে রেখে ফুল্লরাকে বল্লো—
আছয়ে তোমার সই বিমলার মাতা।
লইয়া সাজারু ভেট যাহ তুমি তথা…
সখীর উপরে দেহ তণ্ডুলের ভার।
তোমার বদলে আমি করিব পসার।।
এই বলে বাসি মাংসের পশরা নিয়ে কালকেতু গেল গোলাহাটে। আর ফুল্লরা ‘সখি গৃহে খুদ সের করিয়া উধার ঘরে ফিরে এসে—
‘কুড়্যার দুয়ারে দেখে রামা চন্দ্রমুখী।’
পরমা সুন্দরী এক কন্যা ঘর উজ্জ্বল ক’রে বসে আছে। ফুল্লরা তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন—
‘ইলাবৃত দেশে ঘর জাতিতে ব্রাহ্মণী।
শিশুকাল হৈতে আমি ভ্রমি একাকিনী।।…
তুমি গো ফুল্লরা যদি দেহ অনুমতি।
এই স্থানে কথ দিন করিব বসতি।।’
-শুনে তো ফুল্লরার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ফুল্লরা নানাভাবে তাঁকে ঘরে ফিরে যাবার পরামর্শ দিলেও ঐ রমণী তা কানে তোলেন না। তিনি বলেন—
আছিলাম একাকিনী বসিয়া কাননে।
আনিল তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে।।
ফুল্লরা বুঝলো—এটি তার স্বামীরই কীর্তি, অতএব তার সঙ্গেই ফয়সালা করবার উদ্দেশ্যে ফুল্লরা গোলাহাটের দিকে রওয়ানা হল। দূর থেকেই কালকেতু ফুল্লরার বিমর্ষবদন দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো—
‘শাগুড়ি ননদী নাহি নাহি তোর সতা।
কার সনে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কৈলি রাতা।।’
ফুল্লরা তখন ভীষণ উত্তেজিত, সে বল্লো—
‘পিপীড়ার পাখা উঠে মরিবার তরে।
কাহার যোড়শী কন্যা আনিয়াছ ঘরে।।
শিয়রে কলিঙ্গ রাজা বড়ই দুর্বার।
তোমারে বধিয়া জাতি লইবে আমার।।’
অকারণ দোষারোপে বিরক্ত হয়ে কালকেতু বলে—
“সুব্যক্ত করিয়া রামা কহ সত্যভাষা।
মিথ্যা কৈলা চিয়াড়ে কাটিব তোর নাশা।।”
উভয়ে ঘরে ফিরে এলো, কালকেতুও দেখতে পেলো সেই রমণীকে যাঁর আভায়—
‘ভাঙ্গা কুঁড়ো ঘরখানি করে ঝলমল।’
কালকেতু যথাবিহিত অনুরোধ জানালো রমণীকে স্বস্থানে ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু তিনি যখন ফিরে যেতে স্বীকৃত হলেন না, তখন—
‘ভানু সাক্ষী করি বীর জুড়িলেক শর।’
কিন্তু হাতের শর হাতেই রইল, অতএব—
‘বল বুদ্ধি হত হৈল ব্যাধের নন্দন।’
তখন ঐ রমণী আত্মপরিচয় দিয়ে বল্লেন—
‘আইনু পার্বতী আমি তোরে দিতে বর।
বর মাগ কালকেতু তাজ ধনুঃশর।।’
কিন্তু স্বয়ং পার্বতী স্বেচ্ছায় এসেছেন তার গৃহে, কালকেতু তা বিশ্বাস ক’রে উঠতে পারলো না। তাই সে বলে—
‘আশ্বিনে যেমন বেশে পূজা নিলা সর্বদেশে
দেখাইয়া পুর মোর সাধ।’
তখন—
‘মহিষমর্দিনী রূপ ধরেন চণ্ডিকা।
অষ্টদিকে শোভা করে অষ্ট যে নায়িকা।।’
দেবীর ঐ মূর্তি দেখে কালকেতু ফুল্লরা দু’জনে মূর্ছিত হয়ে পড়লো। দেবী ওদের ডেকে তুলে বল্লেন—
‘বিনাশ করিব দুঃখ তোরে করি দয়া।’
অতঃপর দেবী কালকেতুকে ‘সাতকোটি তঙ্কা’ মূল্যের এক মাণিক্যের অঙ্গুরী দিলে—
‘লইতে নিষেধ করে ফুল্লরা সুন্দরী।।’
কারণ ফুল্লরার ধারণা—
একটি অঙ্গুরী নিলে হবে কোন কাম।
সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম।।
দেবী ওদের মতলব বুঝতে পেরে ওদের নিয়ে ডালিম গাছের তলায় গিয়ে মাটি খুঁড়তে আদেশ করলেন। সেখানে পাওয়া গেল সাত ঘড়া ধন ঘড়া ভারে নিয়ে কালকেতু ঘরে যায়, অবশিষ্ট এক ঘড়া দেবীর কাঁধে চাপানো হল—
‘পশ্চাতে চণ্ডীকা যান আগে কালু যায়।
ফিরি ফিরি কালকেতু পিছুপানে চায়।।
মনে মনে কালকেতু করেন যুকতি।
ধন ঘড়া নিয়ে পাছে পালায় পার্বতী।।’
যাহোক্ সমস্ত ধন নিয়ে গৃহে প্রবেশ ক’রে দেবী চণ্ডী কালকেতুকে আদেশ করেন—
‘পূজিবে মঙ্গলবারে পাতাইবে জাত।
গুজরাট নগরের তুমি হবে নাথ।।
স্থাপিয়া আমার বারি করিও পুজন।
নিযুক্ত করিও তাহে উত্তম ব্ৰাহ্মণ।।’
অতঃপর দেবীর আদেশে কালকেতু মাণিক্যের অঙ্গুরী ভাঙ্গিয়ে টাকা নেবার আসায় গেলো মুরারি শীলের ঘরে।
দুঃশীল বেনে মুরারি শীল প্রথমে কালকেতুকে ঠকাতে চেষ্টা করেছিল। মাণিক্যের অঙ্গুরী দেখে বলেছিল—
‘সোনারূপা নহে বাপা এ বেঙা পিতল।
ঘষিয়া মাজিয়া বাপা করেছ উজ্জ্বল।।’
যাহোক, দৈবাদেশ পেয়ে পরে মুরারি শীল কালকেতুকে অঙ্গুরীর উপযুক্ত মূল্য দান করলো। এবার দেবীর অনুগ্রহে প্রচুর ধনের অধিকারী হয়ে কালকেতু ব্যাধবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে ঐ অর্থের সাহায্যে গুজরাট বন কেটে নগর পত্তন করলো। নগর হল কিন্তু ব্যাধ রাজার রাজ্যে প্রজা আসে না। তখন কালকেতু চণ্ডীর নিকট কাতর প্রার্থনা জানালে দেবী অপর দেবগণের সহায়তায় কলিঙ্গ রাজ্যে ঝড়-বৃষ্টি-বন্যার সৃষ্টি করেন। তখন কলিঙ্গের প্রজারা কালকেতুর প্রতিশ্রুত নানাপ্রকার সুযোগ-সুবিধার লোভে গুজরাটে এসে বসবাস শুরু করলো। গুজরাট রাজ্য জমে উঠলো। এখানে ব্রাহ্মণ শূদ্র, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-মূর্খ প্রভৃতি নানা ধরনের লোক এসে জমা হল। একটা স্বয়ম্ভর সমাজ গড়ে ওঠার পক্ষে যতপ্রকার বৃত্তিজীবী বা ব্যবসায়ীর প্রয়োজন তারা গুজরাটে এলো। এলো নানাজাতির মুসলমানও— তারা বাসস্থান নির্মাণ করলো গুজরাটের পশ্চিমাংশে অবস্থিত হাসনহাটীতে। এত সমস্ত লোকের মধ্যে এসে গেলো এক ঠক ভাড়ু দত্ত – তার নাম। সে এসেই রাজসভায় স্বীয় প্রাধান্য করবার জন্য যেমন আপন গৌরব জাহির করতে প্রবৃত্ত হলো, তেমনি প্রজাদের মূখ্য বুলান মণ্ডলের নামেও লাগানি-ভাঙানি শুরু করলো।
বাক্যালাপে অতিশয় চতুর কায়স্থসস্তান ভাড়ু দত্তের কথায় মুগ্ধ হ’য়ে ব্যাধসত্তান গুজরাটাধিপতি কালকেতু ভাডুকে উপযুক্ত মর্যাদাই দান করেছিল। কিন্তু ক্ষমতামত্ত ভাড়ু হাট বাজারে এবং প্রজাদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে কালকেতু ভাঁড়ু দত্তকে অপমান ক’রে তাড়িয়ে দেয়। অপমানিত ভাড়ু প্রতিশোধ নেবার কথা জানিয়ে বলে—
“তিন গোটা বাণ ছিল এক খান বাঁশ।
হাটে হাটে ফুল্লরা পসার দিত মাস।…
হরি দত্তের বেটা হঙ জয়দত্তের নাতি।
হাটে হৈলা বেচাঙ বীরের ঘোড়া হাতি।।
তবে সে শাসিত করো গুজরাট ধরা।
পুনরপি হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা।।”
এরপর ভাড়ু দত্ত—
‘চুবড়ি পুরিয়া লএ কদলীর মোচা।
মাগের বসন পরে ভূয়েঁ লাম্বা কোচা।।’
এই অবস্থায় সে কলিগরাজের দরবারে হাজির হয়ে বড় বড় কথায় মন ভুলিয়ে কালকেতুর কথা জানালো যে তারই অধীন প্রজা কালকেতু গুজরাট নগরে রাজা হয়ে বসেছে। কলিঙ্গরাজ কোটাল পাঠিয়ে ভাড়ু দত্তের কথার সত্যতা নির্ধারণ করে অবশেষে কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করলেন। সেই যুদ্ধে কলিঙ্গরাজের সৈন্যদল পরাজিত হয়ে ফিরে গেলো। কিন্তু ভাঁড়ু দত্ত তাদের উত্তেজিত ক’রে আবার ফিরিয়ে আনলো। পরাজিত সৈন্যদল কোন্ শক্তিতে শক্তিমান হ’য়ে আবার ফিরে এলো তা বুঝতে না পেরে কালকেতু বিচারবৃদ্ধি হারিয়ে ফেলে ধান্যগৃহে। (ধনগৃহে?) আত্মগোপন করলো। এদিকে ভাড়ু দত্ত কালকেতুর হিতৈষী সেজে ফুল্লরার কাছ থেকে কৌশলে কালকেতুর অবস্থান জেনে নিয়ে কলিঙ্গরাজের হাতে কালকেতুকে ধরিয়ে দিলো। কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে হত্যা করবার জন্য মশানে নিয়ে গেলে কালকেতু চণ্ডীর স্তবপাঠ করেন। চণ্ডীর আদেশে কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে মুক্তিদান করলে কালকেতু ঘরে ফিরে এসে ভাঁড়ু দত্তের মস্তক মুণ্ডন করে এবং পুত্র পুষ্পকেতুকে সিংহাসনে বসিয়ে ফুল্লরা সহ স্বর্গে গমন করে।
Leave a comment