চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী ব্রতকথার আকারে মুকুন্দরামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব হতেই সমাজে প্রচলিত ছিল। কাহিনীর পরিবেশনায় কিছুটা বৈচিত্র্য সম্পাদন করলেও মুকুন্দরামের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এই কাব্যের আখ্যানাংশে ততটা লক্ষিত হবে না। মুকুন্দরামের প্রতিভার পরিচয় নিহিত আছে এই কাব্যের কয়েকটি চরিত্রাঙ্কনের মধ্যে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চরিত্রসৃষ্টি এবং সেই চরিত্র সৃষ্টিতে নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গী মূলতঃ আধুনিক কালের সাহিত্যিকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগের সমাজ পরিবেশ এবং জীবনবোধ এই শ্রেণির চরিত্রসৃষ্টির পক্ষে সহায়ক ছিল না। কিন্তু সার্থক প্রতিভার লক্ষণ এই যে, তা যুগকে অতিক্রম করে যায় এবং যুগান্তরের ইঙ্গিত স্পষ্ট করে তুলে। মুকুন্দরামের কাব্যে এই প্রতিভার স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।
মঙ্গলকাব্যের প্রধান ও মুখ্য বক্তব্য দেবতার মাহাত্ম্যকীর্তন, তাঁর প্রতিষ্ঠা এবং পূজা উপকথাসুলভ কোনো কাহিনীর মধ্য দিয়া এই কার্যটি সম্পাদন করা হয়। মুখ্য উদ্দেশ্য যেখানে এত প্রকট সেখানে কোনো চরিত্রই আপন বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে না। দেবতার পক্ষ এবং বিপক্ষ এই দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত হইয়া চরিত্রগুলি মুখ্য উদ্দেশ্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে মাত্র। এই দুই পক্ষের আশে পাশে আরও কিছু চরিত্র থাকে বটে কিন্তু তারাও ঐ দুই পক্ষের উপছায়া মাত্র। মুকুন্দরামের কাব্যেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। কিন্তু সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি, উদার ও সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী ছিলেন বলে মুকুন্দরাম তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে শ্রেণিগত বন্ধন মুক্ত করে তাদিকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় ভূষিত করিয়াছেন। দু-একটি চরিত্র আলোচনা করলেই আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট হবে।
প্রথমেই মুরারির শীলের কথা ধরা যাক। কালকেতু দেবীর নিকট হতে প্রাপ্ত অঙ্গুরীয় ভাঙ্গাবার জন্য এই বণিকের কাছে গেলে সে গা ঢাকা দিল। কারণ মাংসের দরুণ কালকেতু বণিকের নিকট দেড়বুড়ি পেত। বেণের বান্যাণী অধিক সেয়ানা, সে কালকেতুকে সাফ জবাব দিল, ‘ঘরেতে নাহিক পোতদার। কিন্তু কালকেতু যখন জানাল যে, সে ধারের জন্য আসে নি, অঙ্গুরী ভাঙ্গাতে এসেছে তখন প্রাপ্তির গন্ধ পেয়ে বান্যাণী বলয়া উঠেল-
কালু, দণ্ড দুই করহ বিলম্বন।
সরস করিয়া বাণী হাসি কয় বান্যাণী
দেখি বাপা অঙ্গুরী কেমন।
এদিকে কিঞ্চিৎ লাভের সম্ভাবনা দেখে মুরারি খিড়কীর দরজা দিয়ে দিয়া ঢুকে কালুর সঙ্গে আত্মীয়তা জুড়ে দিল,—
বান্যা বলে, ভাইপো এবে নাহি দেখিতো
এ তোর কেমন ব্যবহার।
যাই হোক, অঙ্গুরীয়টির ওজন হল ষোল রতি দুই ধান। বণিক হিসাব করে বলল—
সোনারূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল।
ঘষিয়া মাজিয়া বাপু করাছ উজ্জ্বল ৷৷
কাজেই এর আর মূল্য কি ? কালকেতু বুঝল যে, বণিক ঠকাতে চায়। সে অন্যত্র যেতে চাইল। তখন ধূর্ত বণিক বলে—
ধর্মকেতু ভায়া সনে কৈলু লেনা দেনা।
তাহা হইতে ভাইপো হয়্যাছ সেয়ানা ॥
এই চরিত্রাঙ্কনে যে প্রচ্ছন্ন পরিহাস কৌতুকের আমদানী করা হয়েছে তা উচ্চ প্রতিভার পরিচায়ক।
ভাঁড়ুদত্তের চরিত্রতে মুকুন্দরাম যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এই খল প্রকৃতির দুষ্ট ব্যক্তির নীচতা ও স্বার্থপরতার জন্য কালকেতুকে অশেষ নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তজ্জন্য কবির তার প্রতি কোনো বিরূপতা নেই, তাহার সমস্ত অন্যায় আচরণকে তিনি কৌতুক প্রসন্নতার সহিত লক্ষ্য করেছেন। গুজরাট নগর পত্তনকালে ভাঁড়ুর আগমন, তার গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল ভাব, বাচাতুরী, প্রজাপীড়ন, কালকেতুর বিরুদ্ধে তার ষড়যন্ত্র এবং পরিণাণে তার দুর্গতি মুকুন্দরা এক আশ্চর্য কলাকৌশলের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। মুকুন্দরামের ভাঁড়ুচরিত্র আজও বাংলা সাহিত্যের খলচরিত্রগুলির মধ্যে একক মহিমায় অধিষ্ঠিত।
Leave a comment