‘বাণ্যা বড় দুঃশীল নামেতে মুরারি শীল
লেখা-জোখা করে টাকাকড়ি।’
কবিবঙ্কণ মুকুন্দ এভাবেই মুরারিশীল নামক বেনেকে সর্বপ্রথম কাব্যে উপস্থিত করলেন। মুরারিশীলের প্রকৃত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কবির এই সংক্ষিপ্ততম উক্তিতেই ধরা পড়েছে।
দেবী চণ্ডী ব্যাধসন্তান কালকেতুর দুঃখ-দুর্দশা মোচনের অভিলাষে তাকে একটি মাণিক্যের অঙ্গুরী দিয়ে বলেছিলেন যে এর মূল্য সাতকোটি তঙ্কা। তিনি বলেছিলেন যে কালকেতু যেন এটি ভাঙ্গিয়ে নিয়ে সেই অর্থে গুজরাট বন কেটে তথায় নগর পত্তন ক’রে সেখানে রাজা হয়ে বসে মাণিক্যের অঙ্গুরী ভাঙানোর জন্য কালকেতু গেল মুরারিশীল নামক বণিকের কাছে। কবিকঙ্কণ মুরারিশীল নামটি নিজে উদ্ভাবন করেছেন, শুধু নামটি নয়, এই অদ্ভুত চরিত্রের মানুষটিও কবিরই উদ্ভাবিত অপরাপর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও এরূপ একটি চরিত্র আছে,—দ্বিজ মাধবের কাব্যে এই চরিত্রটির নাম সোমদত্ত, আর দ্বিজ রামদেবের কাব্যে এটি সুশীল বেনে। জাতিতে এরা সুবর্ণ বণিক – স্বর্ণালঙ্কার তৈরি ও বিক্রয় এবং মূল্যবান ধাতু গচ্ছিত রেখে তার বিনিময়ে চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া ছিল তাদের পেশা—সেটা সেকালে যেমন ছিল, সেই tradition বা ঐতিহ্য একালেও তেমনি চলছে। সাধারণভাবে এদের সেকালের মতো একালেও বলা হয় পোন্দার। এ জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্টা-বিষয়ে কবিকঙ্কণ অন্যত্র অর্থাৎ গুজরাট নগর পশুনে বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছেন। কালকেতু বন কেটে গুজরাট নগর করলে সেখানে বিভিন্ন বৃত্তিজীবী লোকের আগমন ঘটে, তাদের মধ্যে এলো সুবর্ণ বণিকরাও। কবি এদের সম্বন্ধে লিখেছেন—
‘সুবর্ণবণিক বৈসে রজত কাঞ্চন কষে
পোড়ে ফোড়ে দেখায়্যা সংশয়।
কিছু বেচে কিছু কেনে নিতি নিতি বাড়ে ধনে
পুর-মধ্যে তাহার নিলয়।
গুজরাটে করি ঘর নিবসে পশ্যতোহর
নির্ম্মাণ করয়ে আভরণে।
দেখিতে দেখিতে জন হরয়ে সবার ধন
হাত বদলিতে ভাল জানে।।’
এদের ‘পশ্যতোহর’ নাম বা বিশেষণটি অতিশয় প্রাচীন অর্থ ‘দেখতে দেখতে অর্থাৎ চোখের সামনে যে চুরি করে। কবিকঙ্কণ তার বিস্তৃত অভিজ্ঞতা, অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং সর্বব্যাপিনী সহানুভূতির সহায়তায় সংক্ষিপ্ততম অবসরে মাত্র দু চারটি আঁচড়ে এই চরিত্রটিকে সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল করে তুলতে পেরেছেন। একালের দৃষ্টিতে কবিকঙ্কণের মুরারিশীলের চরিত্রটিকে যামিনী রায়ের ছবি’ বলে মনে হয়।
গুজরাট নগর পত্তনের পূর্বে সম্ভবত মুরারিশীলই সেরা সুবর্ণ বণিক ছিল, অদ্ভুত কালকেতু যে আংটি ভাঙাতে তার কাছেই যাবে, এটা পূর্বনির্ধারিত ছিল। তাই আগের দিন রাত্রেই দেবী চণ্ডী মুরারিশীলকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানিয়েছিলেন যে কালকেতুকে যেন বণিক আংটির জন্য যথোচিত মূল্য প্রদান করে। কিন্তু আশঙ্কা হয়, বণিক দেবীর কথায় তদুচিত গুরুত্ব আরোপ করেনি।
যাহোক পরদিন প্রভাতেই বীর কালকেতু দেবী প্রদত্ত মাণিকোর অঙ্গুরী নিয়ে মুরারিশীলের গৃহে উপনীত হল। মুরারিশীলের সঙ্গে কালকেতুর পূর্ব পরিচয় ছিল—শুধু স্বগ্রামবাসী বলেই নয়, তাদের মধ্যে ছিল ব্যবসায়িক লেনদেন। তবে এই ব্যবসায় স্বর্ণালঙ্কার সম্পর্কিত কিংবা বন্ধকী-সম্বন্ধীয় নয়, অপর সাংসারিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভারের ব্যাপার। এই ক্ষেত্রে কালকেতু ছিল উত্তমর্ণ আর মুরারিশীল অধমর্ণ। শিকারের মাংস, বন থেকে নিয়ে আসা শুকনো কাঠ এবং বনজাত ফলমূল কালকেতু বিক্রয় করতো মুরারিশীলের ঘরে এবং অনেক সময়ই তার দাম থাকতো বাকি। মুরারিশীলের অতিশয় স্বচ্ছল গৃহস্থ—
‘দশ দণ্ডে হেমথালে করিয়া ভোজন,
খাটে নিদ্রা যায় বাণ্যা বিনোদ-শয়ন।।’
কাজেই তার পক্ষে মূল্য শোধ না করাকে তার স্বভাব-বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ কৃপণতা অথবা অকারণে ঋণ শোধ না করা—চলতি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ছ্যাচরামি’—এটি ছিল তার চরিত্রগত দোষ। কাজেই মনে হয়, সব সময়ই তার কাছে কালকেতুর কিছু মূল্য পাওনা থাকতো। তাই যে মুহূর্তে ঘরের দরজায় সে কালকেতুর সাড়া পেরেছে, অমনি মুরারিশীল ভিতর বাড়িতে আত্মগোপন করলো, কারণ মাংসের জন্য তার কাছে কালকেতুর দেড় বুড়ি পাওনা রয়েছে।
কালকেতু মুরারিকে গ্রাম সম্পর্কে ‘খুড়া’ বলে ডাকে। তার হাঁক-ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বাণ্যানী মুরারিশীলের পত্নী। এই নারীটি মুরারির যোগ্য গৃহিণী—যেমন হাঁড়ির মুখে সরা’। বস্তুত বেনে ও বেনেনী পরস্পরের পরিপূরক, এই দু’জনে মিলে যেন একটি অখণ্ড চরিত্র গড়ে তুলেছে: অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব রয়েছে তারও বেনের মতোই সে-ও মিথ্যাচারী এবং তেমনি বাক্পটু। অতএব বেনেনী এসে জানালো যে, পোদ্দার টাকা আদায়ের জন্য গেছে খাতক পাড়া, অতএব কালকেতু যেন পরদিন এসে মাংসের পাওনা নিয়ে যায়। অতিশয় চতুর বেনেনী কালকেতুর মনে আস্থা স্থাপনের উদ্দেশ্যে আরো কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য ফরমাশ জানালো—
‘কাষ্ঠ আন্য একভার একত্র শুধিব ধার
মিঠা কিছু আনিহ বদর।।’
কিন্তু কালকেতু তো অন্য কাজে এসেছে, বাকি আদায়ে নয়, তাই সে বলে—
শুনগো শুনগো খুড়ী কাৰ্য্যে কিছু আছে দেড়ি
অঙ্গুরী ভাঙ্গায়্যা লব কড়ি।
আমার জোহার খুড়ী কালি দিহ বাকি কড়ি যাই অন্য বণিকের বাড়ি।।’
এইবার ধনের গন্ধ পেল বেনেনী, বেড়ার আড়াল থেকে বেনে মুরারিশীলও শুনতে পেলো অঙ্গুরীর কথা এবং কালকেতুর অপর বণিকের বাড়ি যাবার কথা। অতএব বেনেকে প্রস্তুত হ’য়ে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করবার সময়টুকু দেবার জন্য বেনেনী কালকেতুকে আর একটু সময় আটকে রাখবার জন্য বলে—
‘দেখি, বাপা অঙ্গুরী কেমন ? ।।’
এই সুযোগে খিড়কীর দরজা দিয়ে হস্তদস্ত হয়ে প্রবেশ করে মুরারিশীল—
‘মনে বড় কুতূহলী কান্ধেতে তঙ্কার থলি
হড়পী তরাজু করি হাতে ।।’
মুরারির প্রবেশ যেমন নাটকীয়, তার প্রথম উক্তিটুকুও তেমনি চমকপ্রদ। যেন সে সুদীর্ঘকাল প্রাণাধিক আত্মীয়ের দর্শনে বঞ্চিত, তেমনি উদ্বেগ উৎকন্ঠা এবং অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে সে অনুযোগ দেয়—
‘বাণ্যা বলে ভাইপো ইবে নাহি দেখি তো
এ তোমার কেমন ব্যবহার।।’
কালকেতুর মনে বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য এই যে অতিরিক্ত আত্মীয়তার ভান, আসলে এটি ঠকানো প্রবৃত্তি—যা মুরারির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। যাহোক কালকেতুর কাছ থেকে আংটি নিয়ে তাকে দাড়িপাল্লায় ওজন করলো, ওজন হল যোল রতি দুই ধান। ওজনে কোন কারচুপি হয়েছে কিনা সেটা জানা যায় না। কিন্তু পূর্বরাত্রিতে দেবীর সতর্কতা সত্ত্বেও যখন মুরারি জানায় যে—
‘সোণা-রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল।
ঘসিয়া মাজিয়া বাপু করেছ উজ্জ্বল।।’
তখন বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। মুরারির মতে এটা বেঙ্গা অর্থাৎ সীসা বা রাং ও পিতলের মিশ্রণে তৈরি আংটি অতএব রতি পিছু দশ গণ্ডা হিশাবে এর পুরো দাম ‘অষ্টপণ পাঁচগণ্ডা’ (সোয়া আট আনা) মাত্র মাংসের দাম সহ কালকেতুর মোট পাওনা অষ্টপণ আড়াই বুড়ি, এর মধ্যে কিছু নগদ এবং চাউলের খুদ দেবার প্রস্তাব দিল মুরারি। হিশেবের কারচুপি কিছু আছে কিনা ওটা বোঝবার ক্ষমতা না থাকলেও কালকেতু বুঝতে পারে, এটি আংটির উচিত মূল্য নয়। কাজেই সে বলে—
‘কালকেতু বলে খুড়া মূল্য নাহি পাই।
যে জন দিয়াছে ইহা তার ঠাঁই যাই।।’
দর-কষাকষির জন্য যে কালকেতু ফিরে যাবার কথা বলেছে তা মনে হয় না। সম্ভবত সে ভেবেছিল, আংটিটি যদি এত স্বল্পমূল্যই হয়, তবে এটি ফিরিয়ে দেওয়াই ভালো। কিন্তু এতে রাজি হবে কেন? সে তো এর প্রকৃত মূলা বিষয়ে সচেতন। কাজেই আংটিটি তার চাই শুধু বেটা কালকেতুকে যতটা ঠকানো যায়। তাই সে আংটির মূল্য পাঁচবট বাড়িয়ে জানালো — ‘আমা সনে সওদা কৈলে না পাবে কপট। আর্থিক মুদ্রায় পাঁট বটের সঙ্গে সঙ্গে মুরারিশীল কালকেতুর মনেও কিছুটা বিশ্বাস বাড়ানোর জন্য বলে—
‘ধর্মকেতু ব্যাধের সাধে কৈলু লেনা-দেনা।
তাহা হইতে ভাইপো হয়্যাছ সেয়ানা।।’
যে কালকেতুর ঘরে ‘মাটিয়া পাথর’ অর্থাৎ মাটির পাত্র ছাড়া অপর কোনো তৈজস নেই— সেই কালকেতুর পিতা ধর্মকেতুর সঙ্গে মুরারির মূল্যবান কোনো লেনদেন হবার কোনো কারণ নেই। এ শুধু পিতার দোহাই দিয়ে কালকেতুর বিশ্বাস উৎপাদন প্রচেষ্টা। কিন্তু এতে কালকেতুর মন ভিজলো না, তাই সে বলে—’যাই অন্য বণিকের বাড়ি। হয়তো বণিক আরও কিছু দরকষাকষি করতো, কিন্তু তখনি সে দৈববাণী শুনলো—
‘অকপটে সাতকোটি তঙ্কা দেহ বীরে।
বাড়িবে তোমার ঘর চণ্ডিকার বরে।।’
এতক্ষণ সে কালকেতুর সঙ্গে পরিহাস করেছে, এই বলে মুরারি কালকেতুর প্রাপ্য সাতকোটি মুদ্রা মিটিয়ে দিল। মুরারির এই বৈশিষ্ট্যকে জনৈক সমালোচক ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ “কোনো সুকৃতি নেই, কোনো যোগ্যতাও নেই, কেবল সমাজে অবশ্য প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি দ্বারা মুরারি সর্বশক্তিময়ী দেবী চণ্ডীকাকেও নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে। বেণের রূপোর চাকায় বিধিবিধানের রথচক্র কেবল আজই নয়, চিরদিনই রুদ্ধগতি হয়ে পড়তো, মুরারিশীলের চরিতকথায় এই সত্য প্রচার করেই মুকুন্দরাম আধুনিক বাস্তববাদী ঔপন্যাসিকদের সুদূর পূর্বসূচনা করেছেন।”
Leave a comment