উপন্যাসের উদ্ভব ও অর্থ:

কথাসাহিত্য আধুনিক কালের সৃষ্টি। এর প্রধান দুই অংশ ‘উপন্যাস’ এবং ‘ছোটগল্প’ আধুনিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই ‘উপন্যাস’ কথাটি ইংরেজী ‘নভেল’ (Novel) শব্দের সমার্থক। অবশ্য শব্দটি অভিধানবিহীন নয়। সেখানে শব্দটি (ক) সম্মুখে বা প্রারম্ভে স্থাপন, বিন্যাস, (খ) উপক্রমণিকা, মুখবন্ধ, (গ) উদাহরণ, দৃষ্টাস্ত ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত। এই ‘নভেল’ বা উপন্যাসের সঙ্গে উপাখ্যান বা অন্যান্য গল্পের পার্থক্য আছে। সেই কারণে সংস্কৃত গদ্যসাহিত্যের ‘কাদম্বরী’, ‘দশকুমারচরিত’ প্রভৃতি আখ্যান উপাখ্যানের ধারায় বাংলা উপন্যাস লেখা হয়নি। কারণ “সব গল্প নভেল নয়, উপন্যাস নয়। ‘নভেল’-এর প্রকৃতি আলাদা। ইংরেজ আমলে পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে নভেল আমাদের দেশে এসেছে। বিশেষ করে, ইংরেজী সাহিত্য ও ইংরেজী ভাষায় অনূদিত এক বিশেষ, প্রকৃতির পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য, আমাদের সামনে ধরেছিল উপন্যাসের আদর্শ” (দ্রষ্টব্য : গোপাল হালদার, “বঙ্কিমের সৃষ্টিসম্পদ”, ভূমিকা, বঙ্কিম রচনাবলী, উপন্যাস খণ্ড, সাক্ষরতা প্রকাশন, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা পাঁচ)। এই আধুনিক দৃষ্টিতে ‘উপন্যাস’ বা ‘নভেল’ হল, “fictitious prose narrative of sufficient length to fill one or more representative or real life in continuous plot”. (Concise Oxford Dictionary’) এই উপন্যাসের ধর্ম, ‘বাস্তব সামাজিক চিত্র’ রচনা বা বাস্তব জীবনচিত্র প্রকাশ।

এই উপন্যাস বিভিন্ন সময়ে সমাজ-বিবর্তনের ধারায় বিকশিত হয়েছে। তাই খ্রীস্টীয় একাদশ শতকে লেখা শ্রীমতী মুরাসিকি সিকিবুর ‘The Tale of Ganji’ উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে ছিল প্রাথমিক প্রচেষ্টা মাত্র। কারণ উপন্যাস রচনার উপযোগী সমাজ তখনও অনুপস্থিত। প্রকৃতপক্ষে ১৮ শতকে ইংলণ্ডের অগস্টান যুগ থেকেই এর যথার্থ সূচনা হয়। এর উদ্ভবের অন্তরালে ছিল একাধিক ঐতিহাসিক ও আর্থ-সামাজিক কারণসমূহ। যেমন সংক্ষেপে উল্লেখ করা যায়—রিনাসেন্স ও রির্মেশনের প্রভাব, শিল্পবিপ্লব, সামস্তশ্রেণীর হাত থেকে নয়া-বণিক বা বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা স্থানান্তর, বিভিন্ন দেশে মানুষের মনে প্রাচীন সামস্তযুগীয় বিশ্বাস থেকে মুক্তি, মধ্যবিত্ত শিক্ষিতের সংখ্যাবৃদ্ধি, তাদের বাস্তব জীবনযাত্রার প্রতি আকর্ষণ, বৈষয়িক উদ্যোগ-আয়োজন, বণিক, শ্রমিক, কেরাণি কর্মচারীর সংখ্যাবৃদ্ধি ও সমাজে তার প্রভাব, ব্যক্তিগত সম্পত্তি চেতনা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মানবাধিকার (Rights of Man), মানবিকতাবোধ ইত্যাদির বিকাশ, মুদ্রাযন্ত্রের প্রচলন, পত্র-পত্রিকার প্রকাশ, বিশ্বজগৎ ও মানব সম্পর্কে কৌতূহলী সাধারণ পাঠকসমাজের উদ্ভব প্রভৃতি। আর এইসবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিসত্তার যথার্থ বিকাশে ‘উপন্যাস’ নামক শিল্পমাধ্যমটি ইংরেজী সাহিত্যে প্রাধান্য প্রায়।

ইংরেজীর অনুসরণে বাংলা উপন্যাসে উদ্ভব ঘটলেও পরিবেশ-পরিস্থিতি কিন্তু সমরূপে ছিল না। বিদেশী শাসন ও ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় এদেশীয় সমাজ তখন সম্পূর্ণভাবে জমিদারতন্ত্রে বাঁধা। মুষ্টিমেয় শিক্ষিত শ্রেণী আধুনিক ভাবাদর্শ ও সাহিত্যপাঠে মুগ্ধচিত্ত হ’লেও সেই সময় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সহজ স্বাভাবিক বিকাশ ছিল অবরুদ্ধ। পরাধীনতার দায়ে বৈষয়িক উদ্যোগ উন্নতির সুযোগ থেকেও তখন এদেশীয় পুরুষেরা ছিলেন বঞ্চিত।

অন্যদিকে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা, জাতি-বর্ণের-ধর্মের বিবিধ বাধায় পূর্ণ মানুষরূপে এদেশীয় ব্যক্তিপুরুষের আত্মবিকাশের পথ জানা ছিল না। নারী পুরুষের সহজ স্বাভাবিক মেলামেশার চিন্তা সেই সময় অকল্পনীয় ছিল। তাই সমকালের সমাজ-আশ্রিত প্রেম-ভালোবাসার দ্বন্দ্বে ভরা প্লট-রচনার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ প্রথম পর্যায়ের বাঙালী ঔপন্যাসিকদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ‘কলকাতা’ নগরী ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীরূপে স্বীকৃত হয়। সেইসময় শেঠ, বসাক প্রভৃতি পূর্ববর্তী অভিজাত ধনীদের দল, ইংরেজের সহায়তাপুষ্ট নতুন ধনিক গোষ্ঠীর (ঘোষাল-মিত্র-দেব-ঠাকুর ইত্যাদি) এবং জীবিকান্বেষী মধ্যবিত্তের ব্যবসা-বাণিজ্য বা সামাজিক লেনদেন সূত্রে সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ ঘটে। কিন্তু তবু ঐতিহ্য-বিহীন মূল্যবোধ-লুপ্ত এই ‘বাবু’ শ্রেণীর জীবনযাপন কোনমতেই উপন্যাসে আদর্শ মানুষের চিত্ররূপে কাহিনীর উপাদান হয়ে উঠেনি। কারণ এরা হয়েছিলেন প্রায়শই প্রহসন বা কৌতুকের পাত্র, নায়ক-পদবাচ্য নয়। সেইজন্য দেখা যায়, বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক রূপটি নক্শা-জাতীয় রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে।

‘উপন্যাস’ কথাটির প্রথম ব্যবহার ও প্রাথমিক পর্যায় : বাংলা উপন্যাসের যথার্থ সূচনাকাল ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) থেকে তার শিল্পসম্মত রূপলাভ। এর পূর্বরূপ আখ্যান-উপাখ্যান-অনুবাদ-নক্সাজাতীয় রচনাধারায় অপরিণত শিল্প ভাবনায় উপস্থাপিত হয়েছে। অবশ্য এক টেকচাদ বাদে অন্য লেখকরা কেউই তাঁদের সৃষ্টিকে ‘উপন্যাস’ বলে দাবী করেননি। বস্তুত, “…..‘উপন্যাস’ শব্দটি যতদূর মনে হয় ‘বিবিধার্থ সংগ্রহের ই প্রথম প্রচলন। সাধারণভাবে ‘উপাখ্যান’ শব্দটি তত্রত্য মনোনীত হয়েছিল। তারও আগে অবশ্য নীলমণি বসাক ‘আরব্য উপন্যাস’-এ (১৮৫০) রোমাঞ্চক আখ্যায়িকা অর্থে ‘উপন্যাস’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন”।

উপন্যাসের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত:

বাংলা উপন্যাসের প্রথম সৃষ্টিকর্তা কে সে নিয়ে আধুনিক কালে কিছু সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। যেমন প্রাচীনপন্থী সমালোচকদের মধ্যে রাজনারায়ণ বসু অভিমত প্রকাশ করেছেন : “শ্রীযুক্ত প্যারীচাঁদ মিত্র বাঙ্গালা উপন্যাসের সৃষ্টিকর্তা, কিন্তু তাহা হাস্যরসের উপন্যাস। পাইকপাড়ার রাজাদিগের স্বসম্পৰ্কীয় গোপীমোহন ঘোষ প্রকৃত বাঙ্গালা উপন্যাসের সৃষ্টিকর্তা। তাঁহার লেখনী হইতে প্রথম বাঙ্গালা উপন্যাস বিনিঃসৃত হয়, সেই উপন্যাসের নাম, ‘বিজয়বল্লভ’, কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসের সৃষ্টিকর্তা আমাদের পরম বিজ্ঞ বান্ধব শ্রীযুক্ত ভূদেব মুখোপাধ্যায় মহাশয়” (“বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’)। পক্ষান্তরে, একালের সমালোচকদ্বয়ের (অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত এবং দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়) মতে, “… গোপীমোহনের লেখা প্রকৃত প্রস্তাবে পরিচিত একটি বাংলা রূপকথাকাহিনীর কাঠামোটিকে বিশদ করে ভরিয়ে তোলা মাত্র, এবং সেই দিক থেকে তা প্রকৃত বাংলাদেশের কাহিনীও বটে, কিন্তু তার বেশি নয়। অর্থাৎ তার উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে উপকথা; উপকথাকে কোথাও তিনি অতিক্রম করেছেন, এই লেখায় তারও প্রমাণ নেই। উপকথায় যা প্রাথমিক চরিত্র— অনির্ধারিত ও নির্বিশেষ স্থান-কাল-পাত্রের মধ্যবর্তিতা, এই লেখাতে কোথাও তা বিশেষ ব্যক্তির চেহারায় কিংবা বাস্তবোচিত পরিসরে নেমে আসে নি। উপন্যাসের জন্য ন্যূনতম যে আধুনিকতাটুকু দরকার, গোপীমোহন সে বিষয়ে অবহিত ছিলেন বলে মনে হয় না”।

বঙ্কিম-পূর্ববর্তী লেখকগোষ্ঠী

বাংলা উপন্যাস-চর্চার প্রাথমিক ধারাটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশের (১৮৬৫) পূর্বে বা সমকালে কয়েকজন লেখকের প্রচেষ্টায় দীর্ঘায়িত হয়। কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে এর নামোল্লেখ করা যায়

(ক) সামাজিক নক্‌শা : ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কলিকাতা কমলালয়’ (১৮২৩), ‘নববাবু বিলাস’ (১৮২৫), ‘নববিবি বিলাস’ (১৮৩১)। 

কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম পাচার নক্শা’ (১৮৬১ থেকে খণ্ড আকারে প্রকাশিত)। 

ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় ‘আপনার মুখ আপনি দেখ’।

টেকচাঁদ ঠাকুর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৪)।

(খ) প্রাচীন কথার অনুবাদ : তারাশঙ্কর তর্করত্ন – ‘কাদম্বরী’ (১৮৫৪)। রামলাল মিত্র : ‘শকুন্তলার উপাখ্যান’ (১৮৫৪), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪), গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন : ‘দশকুমার’ (১৮৫৬)। আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ : ‘বৃহকথা’—দু’খণ্ড (১৮৫৭), ‘শকুন্তলোপাখ্যান’ (১৮৫৮)।

(গ) আখ্যান-উপাখ্যান-উপন্যাস : রামনারায়ণ তর্করত্ন : ‘পতিব্রতোপাখ্যান’ (১৮২২), নীলমণি বসাক : ‘নবনারী’ (১৮৫২), হ্যানা ক্যাথরিন মূলেন্সঃ ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ (১৮৫২), ভূদেব মুখোপাধ্যায় : ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ ও ‘সফল স্বপ্ন’ (১৮৬২), রামগতি ন্যায়রত্ন : ‘রোমাবতী’ (১৮৬২), গোপীমোহন ঘোষ : ‘বিজয়বল্লভ’ (১৮৬৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : “আখ্যানমঞ্জরী’ (১৮৬৩)।

(ঘ) মুসলিম আখ্যান-উপাখ্যান : নীলমণি বসাক ও গিরিশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পারস্য উপন্যাস’ (১৮৩৪), হরিমোহন সেন সম্পাদিত ‘আরব্য উপন্যাস’ (১৮৩৯) এবং নীলমণি বসাক সম্পাদিত (১৮৫০), রেভারেণ্ড ডব্লু ও স্মিথ (১৮৫০) এবং পূর্ণচন্দ্রোদয় সম্পাদকের লিখিত। হরিশচন্দ্র নন্দী ‘চাহার দরবেশ’ (১৮৫৪), উমাচরণ মিত্র : ‘গোলেবকাওলি’ (১৮৫৫)।

ইসলামী গল্প : ‘চন্দ্ৰকান্ত’ (১৮২৯), ‘চন্দ্রবংশ’ (১৮৩৪), ‘কামিনীকুমার’ (১৮৩৫)– কালীকৃষ্ণ দাস; ‘মন্মথমঞ্জরী’ (১৮৫১), ‘অপূর্বোপাখ্যান’ (১৮৪২), এছাড় ‘হাতেম তাই’, ‘আনবার সোহেলি’, ‘লায়লা-মজনু’, ‘শাহনামা’ প্রভৃতি গ্রন্থ।

(ঙ) নীতিমূলক বিলিতি গল্প অনুবাদ : ফেলিক্স কেরি কৃত বানিয়নের ‘পিলগ্রিম্স প্রগেসে’র অনুবাদ (১৮২১); সাটন : ‘স্বর্গীয় যাত্রীর বৃত্তান্ত’ (১৮৩৮); অজ্ঞাতনামা লেখক : ‘যাত্রিকের গতি’ (১৮৭৭); স্যামুয়েল জনসনের moral novel ‘Russaleus’ এর অনুবাদ করেছিলেন কালীকৃষ্ণ ঠাকুর (১৮৩৩) এবং তারাশঙ্কর তর্করত্ন (১৮৫৭)।

(চ) ল্যাম্বের লেখা থেকে শেকসপিয়রের নাটকের গল্প অনুবাদ : গুরুদাস হাজরাঃ ‘রোমিও এবং জুলিয়েটের মনোহর উপাখ্যান’ (১৮৪৮), এডোয়ার্ড রোয়ার : ‘লেম্বসটেলের কতিপয় আখ্যায়িকা’ (১৮৫৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৮৬৯)।

(ছ) ভ্রমণমূলক অনুবাদ কাহিনী ও রোমান্স : স্কটের ‘লেডি অফ দি লেক’-এর অবলম্বনে অজ্ঞাতনামা লেখক-কৃত ‘অপূর্ব কারাবাস’ অনুবাদ, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য : ‘দুরাকাক্ষের বৃথা ভ্রমণ’ (১৮৫৭), ‘বিচিত্রবীর্য্য’ (১৮৬২), Bernardim de Saint Pierre-কৃত ‘Paulet Virginie’-এর অনুবাদ ‘পৌলবৰ্জ্জিনী’ (১৮৬২), ‘গালিভারস্ ট্রাভেল্স’-এর অনুবাদ উপেন্দ্রনাথ মিত্র : ‘অপূর্ব দেশভ্রমণ’ (১৮৭৬); ডন কুইকসোট এর অনুবাদ বিপিনবিহারী চক্রবর্তী : ‘অদ্ভূত দিগ্বিজয়’ (১৮৮৩) ; রেনল্ডসের গ্রন্থ অনুবাদ ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় : রেনল্ডস-কৃত রহস্যাবলী অবলম্বনে লিখিত আখ্যায়িকাবলী’ (১৮৮২)।