বাংলা কথাসাহিত্যে সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫) এক উজ্জ্বল স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। ‘জাগরী’ এবং ‘টোড়াই চরিত মানস’—এই দুখানি উপন্যাসই তার বিশিষ্ট সাহিত্য প্রতিভার দুটি উচ্চতম শিখরবিন্দু। তবে সতীনাথ ভাদুড়ীর সাহিত্য চর্চার কাল ১৯৪৫ থেকে পরবর্তী কুড়ি বছর পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি মূলত অন্তর্মুখী সাহিত্যিক হলেও পারিপার্শ্বিক ও দেশকাল সম্পর্কে তিনি ছিলেন প্রখরভাবে সচেতন। ১৯৩০-১৯৬৫ মােটামুটি এই সময়ের ভারতবর্ষের সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। আধুনিককালের কথাসাহিত্যে কালসচেতনতায় সতীনাথ ভাদুড়ী তারাশংকর বা মানিকের থেকে ন্যূন ছিলেন না। বিশেষত পূর্ণিয়া তার কথাসাহিত্যে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি ছিলেন পূর্ণিয়ার মানুষ। তাই পৃর্ণিয়ার গ্রামজীবন মানুষ ও নিসর্গ তাঁর রচনায় অপূর্ব বাণীরূপ লাভ করেছে।

সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’র পাণ্ডুলিপি বহু প্রকাশকের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষ পর্যন্ত এক অখ্যাত প্রকাশকের আনুকূল্যে ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি, নাৎসীশক্তি ও ফ্যাসীবাদের পরাজয়; ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-শক্তির অগ্রগতি এবং একই সঙ্গে এশিয়া-আফ্রিকায় শােষিত মানুষের জাগরণ; পূর্ব-ইউরােপে সমাজতান্ত্রিক শক্তির অভ্যুদয়, পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিপুল পরিবর্তন; একদিকে, রাষ্ট্রসংঘের জন্ম, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ঠাণ্ডাযুদ্ধের সূচনা—সেই কালটিকে এক ক্রান্তিলগ্নে এনে দাঁড় করিয়েছিল। এই কালান্তর-লগ্নেই সতীনাথের আবির্ভাব। স্বেচ্ছায় বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে একদা যে সতীনাথ সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, স্বাধীনতার পর রাজনীতি সম্পর্কে তাঁরই মােহভঙ্গ ও সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়ােগও এই প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ।

ভাগলপুর জেলে বসে রাজনৈতিক বন্দী সতীনাথ ‘জাগরী’র পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। বাংলা সাহিত্যে জাগরী এক অসামান্য রাজনৈতিক উপন্যাস। বাংলা রাজনৈতিক উপন্যাসের সূচনা সম্ভবত ১৮৮২-তে ‘আনন্দমঠ’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। তবে ‘আনন্দমঠ’ রাজনৈতিক উপন্যাস কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ সেদিক থেকে অনেক বেশি রাজনীতি আশ্রয়ী, স্বদেশী আন্দোলনের উত্তপ্ত পটভূমিতে ‘ঘরে বাইরে’ রচিত। ১৯২৬-এ প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ও ভারতীয় বিপ্লববাদের পটভূমিতে রচিত উল্লেখযােগ্য এক রাজনৈতিক উপন্যাস। রবীন্দ্র-শরৎ-উত্তর বাংলা সাহিত্যে রাজনীতি-সচেতন উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে রয়েছেন তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, গােপাল হালদার, সুবােধ ঘােষ এবং সতীনাথ ভাদুড়ী।

১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস ‘জাগরী’। আঙ্গিক ও অন্তর্মুখী বিশ্লেষণে জাগরী’ শুধু একটি যুগের রাজনৈতিক দলিল নয়, হয়ে উঠেছে এক প্রথম শ্রেণীর ভাষাশিল্প। বিয়াল্লিশের সহিংস আন্দোলনকে নেতৃত্বদানের জন্য সােসালিষ্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী বিলু ব্রিটিশ শাসনের বিচারে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত। তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে ছােটভাই নীলু। একই জেলের আপার ডিভিশন ওয়ার্ডে বন্দী বিলুর বাবা, যিনি নৈষ্ঠিক গান্ধীবাদী। জেলের মহিলা ওয়ার্ড বা ‘আওরৎ কিতা’য় বন্দিনী স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণকারিণী বিলুর মা। বিলুর ফাসীর পূর্বরাত্রে এই চারটি চরিত্রের আত্মচিন্তার সূত্রে স্মৃতিপথ ধরে ভেসে ওঠা সময়ের অনুপুক্ষ, রাজনৈতিক শ্রোত-প্রতিস্রোত, রাজনীতি ও মানবতার টানাপােড়েন, কর্তব্য ও হৃদয়ধর্মের রক্তক্ষয়ী সংঘাত এক অপুর্ব আত্মমগ্ন ভাষায় ‘জাগরী’ উপন্যাসে উপস্থাপিত। শ্রী অমূল্যধন মুখােপাধ্যায় উপন্যাসটি সম্পর্কে আশুতােষ কলেজ পত্রিকায় (১৯৫০) মন্তব্য করেছে— ‘আনুপূর্বিক আখ্যায়িকা হিসাবে উপন্যাসটি রচনা করা হয় নাই, এক প্রলয়ংকর মুহূর্তের প্রতীক্ষায় চারিটি মানবমনে একই সময়ে কী কী ভাব, চিন্তা, স্মৃতির প্রবাহ বহিয়া যাইতেছিল, তাহাই এই উপন্যাসের বিষয়।’

সতীনাথ ভাদুড়ীর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চিত্রগুপ্তর ফাইল’ (১৯৪৯) লেখকের প্রধান দুটি উপন্যাসের জনপ্রিয়তার জন্য এই উপন্যাসটি পাঠকের তেমন মনােযােগ আকর্ষণ করতে পারেনি। বাস্তব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকেই সতীনাথ ভাদুড়ী এই উপন্যাসটির উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। কাটিহার জুটমিলের ধর্মঘটী শ্রমিকদের সঙ্গে সহাবস্থান তাঁর অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছিল। সেই অভিজ্ঞতাই ‘চিত্রগুপ্তের ফাইল’ ‘বলীরামপুর জুট মিলস’-এর শ্রমিক আন্দোলন হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। ১৯৪৮-এ মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পরদিন শ্রমিক নেতা অভিমন্যুর অস্তিম সংস্কারের সময় মিল-ম্যানেজার থেকে শুরু করে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা শিউচন্দ্রিকা পর্যন্ত নিজেদের অপরাধী বলে মনে করেছে। অভিমন্যুর জীবনের ঘটনা এবং পরিণাম নিরাসক্ত নিরাবেগভাবে পর্যালােচনা করেছেন ‘চিত্রগুপ্ত’ ছদ্মনামধারী প্রসিদ্ধ সাহিত্য সমালােচক।

সতীনাথ ভাদুড়ীর তৃতীয় উপন্যাস ‘টোড়াই চরিত মানস’। এই উপন্যাসের প্রথম চরণ প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে। দ্বিতীয় চরণ ‘দেশ’-এ বেরিয়েছিল ১৩৫৭- তে। প্রথম ও দ্বিতীয় চরণের গ্রন্থাকারে প্রকাশকাল যথাক্রমে ১৩৫৬ ও ১৩৫৮ (১৯৪৯ ও ১৯৫১)। এই উপন্যাস সম্পর্কে ঔপন্যাসিক বলেছেন- “তাতমাটুলিতে টোড়াই নামের একজন লােক সত্যিই ছিল।….বহু মূর্তিতে আমি টোড়াইকে দেখেছি। তাকে ভিক্ষা করতে দেখেছি, ঘর ছাইতে দেখেছি, গােরুর গাড়ি চালাতে দেখেছি।……এই টোড়াইকে এযুগের শ্রীরামচন্দ্র করবার কঠিন কাজ ছিল আমার সম্মুখে। শ্রীরামচন্দ্রের চেয়ে ছােট আদর্শে উত্তর ভারতের সাধারণ লােকের মন ভরে না।”

উত্তর-বিহারের অনুন্নত দেহাতে নীচুতলার তাতমা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিল টোড়াই। পুরােনাে সামাজিক বিধিনিষেধ ও অস্পৃশ্যতার প্রাচীরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে টোড়াই। এক বিশাল মহাকাব্যীয় পটভূমিকায় নায়করূপে তাতমাটুলির মানুষদের ত্রাণকর্তা চোড়াইয়ের উত্থান।

উত্তর-বিহারের গ্রামাঞ্চলের তিরিশ বছরের (১৯১৫-৪৫) পটভূমিতে রচিত ‘টোড়াই চরিত মানস’। ব্যক্তি ও সমাজের পরিবর্তনশীল দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিষয়ে এই উপন্যাসে লেখক তীর সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। বিহারের শিক্ষাবর্জিত অন্ধ-সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামের ভীরু চাষী, মজুর, মহাজন-জোতদার সম্প্রদায়ের কাছে গানহীবাবা’ তথা মহাত্মা গান্ধী কিভাবে পরিচিত হয়ে উঠলেন, যুদ্ধবিরােধী সত্যাগ্রহ আন্দোলন কিভাবে ভীরু মানুষগুলিকে পরিবর্তিত করে দিল, এই উপন্যাসে সেই জীবনচিত্র জীবন্ত হয়ে ধরা পড়েছে।

‘জাগরী’-র অনবদ্যতা স্বীকার করেও বলা চলে যে, ‘টোড়াই চরিত মানস’ সতীনাথের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এটি একাধারে পরিবর্তনশীল সমাজ সম্পর্কে তীব্ৰসচেতন উপন্যাস, রাজনৈতিক উপন্যাস, আবার আঞ্চলিক উপন্যাসও বটে। ‘টোড়াই চরিত মানস’-এর মহাকাব্যিক পটে ধরা পড়েছে ভারতের হৃদয়স্পন্দন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে মানুষের, ‘ইনার রিয়ালিটি’-র সন্ধান শিল্পসাহিত্যিকদের অন্বিষ্ট হয়ে উঠেছে। জেমস্ জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, ডােরথী রিচার্ডসন, মার্সেল পুস্ত-এর রচনা সমুহে মানুষের অন্তর্লীন চেতনাপ্রবাহ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও ১৯১৬-তে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে সেই ‘ইনার রিয়ালিটি’-কে খুঁজেছো। সতীনাথ ভাদুড়ী প্রথমাবধিই সেই অন্তর্মুখী চেতনার প্রবাহকে আঙ্গিক হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তবে প্রথম তিনটি উপন্যাসের সঙ্গে সতীনাথের পরবর্তী তিনটি উপন্যাসের সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। ‘অচিন রাগিণী’, ‘সংকট’ এবং ‘দিগভ্রান্ত’- এই তিনটি উপন্যাসে বহিলোকের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় অনুপস্থিত। এখানে সতীনাথ আরাে বেশী চিন্তাশীল ও অন্তর্মুখী।

‘অচিন রাগিণী’ (১৯৫৪) উপন্যাসে ঔপন্যাসিক আত্মপ্রক্ষেপ ঘটিয়েছেন। তার বাল্য, কৈশাের ও প্রথম যৌবনের নানা ঘটনা ও অভিজ্ঞতাই এই উপন্যাসের প্রত্যক্ষ উপকরণ। ‘অচিন রাগিণী’ উপন্যাসের দুই চরিত্র—পিলে এবং তুলসীর মধ্যে সতীনাথ নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। চিন্তার প্রবাহকে ধরতে এই উপন্যাসে সতীনাথ ব্যবহার করেছেন বিন্দু-চিহ্ন (….), যাঁকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘চিন্তন চিহ্ন’। এই চিন্তনের প্রাধান্য প্লটকে উপেক্ষা করে যায়, কালগত ক্রমকে অতিক্রম করে আসে এলােমেলাে স্মৃতির অনুষঙ্গ, স্পষ্ট হয় অন্তর্লীন জটিলতা ও রহস্য। মানব- সম্পর্কের জটিল অন্তলোকের রহস্যই অচিন রাগিণী’ উপন্যাসের বিষয়।

একই আঙ্গিক অনুসৃত হয়েছে ‘সংকট’ (১৯৫৭) এবং ‘দিগভ্রান্ত’ (১৯৬৬) উপন্যাসেও। ‘সংকট’ উপন্যাসেও বিশ্বাসজী চরিত্র অবলম্বনে অন্তলোক অন্বেষণ মুখ্য বিষয়। বিশ্বাসজীই এখানে কথক। পুরাে নাম যুক্তিনাথ বিশ্বাস। এখানেও বিশ্বাসজীর জনসেশ, রাজনীতি চর্চা, মানুষের সংঘবদ্ধ লড়াইয়ের অংশীদার হওয়া, ফুলগাছ পরিচর্যা, পাখি দেখা, বইপড়া এবং রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা-অবসর গ্রহণ-ইত্যাদির মধ্যে লেখকের আত্মপ্রক্ষেপ দুর্লক্ষ্য নয়। ছাড়া ছাড়া নির্বাচিত কয়েকটি দৃশ্য—হাবুর মায়ের মৃত্যু-মুহূর্ত, ইলােরাতে ধ্যানমগ্ন বৃদ্ধের বুকের ওঠানামা, ট্যাক্সি ড্রাইভার বিষয়ক ব্যাপার, মুনিয়ার ব্যর্থ দাম্পত্যজীবন, মণিবস্ত্রী রেণুর ঘরে গহনাচুরি, মুনিয়ার মায়ের সংসারে অনাসক্তি ও আত্মপরতা, অঘােরীবাবা ও গুজরাতীর মায়ের কাহিনী, দাড়িওয়ালা মহাত্মার আত্মানুসন্ধান—ইত্যাদি বিচিত্র খণ্ডদৃশ্যের মাধ্যমেই ‘সংকট উপন্যাসে জীবনের অন্বেষণ।

‘দিগভ্রান্ত’ পারিবারিক বৃত্তের উপন্যাস হলেও ব্যক্তি জীবনের সমস্যা, একাকীত্ব, দিগভ্রান্ত অবস্থাই এর মুখ্য বিষয় এই উপন্যাসে চিন্তন-চিহ্নের প্রয়ােজন হয়নি। কেননা এখানে সতীনাথ অনুপুঙ্খের গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। মার্সেল প্রুস্তের আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘আ ল্য রেশর্মে দ্যু- তঁ পারদু’ পড়ে তিনি লিখেছিলেন— ‘জীবনের আপাততুচ্ছ ঘটনাগুলাের উপর এত গুরুত্ব, তার আগে আর কেউ দেননি।..দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছ জিনিসগুলােও সাহিত্যের দরবারে আর অপাঙ্ক্তেয় থাকে না’ (পড়ুয়ার নােট থেকে)। ‘দিগভ্রান্ত’ উপন্যাসে সতীনাথ অনেকটা প্রুস্তের পদ্ধতিই অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। সুবোধ ডাক্তার, অতসীবালা, তাদের পুত্র সুশীল ও কন্যা মণি, এবং বহিরাগত হরিদাসকে নিয়ে এই উপন্যাসে লেখক মানব-জীবনের জটিল অন্তলোকের আলাে-আঁধারি রহস্যময়তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রতিটি চরিত্রই যেন বিচ্ছিন্ন, একাকীত্বের দ্বীপে বন্দী, সকলেই যেন পথহারা-দিগভ্রান্ত।

ঔপন্যাসিক হিসেবে যে নির্মোহ নিরাসক্তি সতীনাথের বিশেষত্ব, সেই নির্মোহ বিশ্লেষণ ও বলিষ্ঠ মননের পরিচয় মিলবে ১৯৪৯-এ ইউরােপ ভ্রমণের বৃত্তান্ত ‘সত্যি ভ্রমণ কাহিনী’ (১৯৫১) নামক অসাধারণ জার্ণালে। বাংলা সাহিত্যে এই জার্ণালটিও এক অনবদ্য সংযােজন সন্দেহ নেই। তবে উপন্যাস ছাড়াও ছােটগল্পের ক্ষেত্রেও সতীনাথ ভাদুড়ী এক উল্লেখযােগ্য নাম। তাঁর গল্প-সংকলনের সংখ্যা ছয়টি—’গণনায়ক’ (১৯৪৮), ‘অপরিচিতা’ (১৯৫৪), ‘চকাচকী’ (১৯৫৬), ‘পত্রলেখার বাবা’ (১৯৫৯), ‘জলভ্রমি’ (১৯৬২) এবং ‘আলােকদৃষ্টি’ (১৯৬৩)।

সতীনাথের প্রথম গল্প ‘জামাইবাবু ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে লেখা গল্গুলি নিয়েই প্রকাশিত হয় ‘গণনায়ক’। প্রথম গল্প ‘জামাইবাবু’ মাত্র ছেচল্লিশটি লাইনে দৃঢ়সংবদ্ধ। এই মিতভাষিতা, অল্পের মধ্যে অনেকখানি ব্যঞ্জনা, তীব্র তির্যক ইঙ্গিতময়তা, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি—এগুলিই সতীনাথ ভাদুড়ীর সমস্ত ছােট গল্পের বিশেষত্ব।

সতীনাথের ছােটগল্পকে চারটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথমপর্বে ‘গণনায়ক’, দ্বিতীয় পর্বে ‘অপরিচিতা’ ও ‘চকাচকী’, তৃতীয় পর্বে ‘পত্রলেখার বাবা’ এবং চতুর্থ পর্বে ‘জলভ্রমি’ ও ‘অলােকদৃষ্টি’ প্রথম পর্বের গল্পগুলি সমকাল ও পরিবেশকে স্পর্শ করেছে। দেশবিভাগ, রাজনীতি, পরিবেশ সচেতনতা এইসব গল্পে লক্ষ্যণীয়। ‘গণনায়ক’ গল্পে দেখি নাগর নদীর পুলের এপারে ওপারে বসবাসকারী হিন্দু-মুসলমানদের দেশবিভাগ নিয়ে ভয় দেখিয়ে মুনাফা লুটছে মুনিমজী।

দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলিতে মনােলােকের রহস্যময় পথে পরিক্রমণ। ‘ভূত’, ‘ঈর্ষা’, বা ‘রথের তলে’ গল্পে মানুষের মনের সেই গহন অন্তলোকের ছবি আছে।

সতীনাথের তৃতীয় পর্বের গল্পগুলির সংকলন ‘পত্রলেখার বাবা’। এখানে ব্যবহৃত হয়েছে বিচিত্র পটভূমি। অলৌকিক, নারকীয়, গৃঢ় অস্বাভাবিক মনােবিকার নিয়ে এখানে নিজের রচনা সামর্থ্য পরীক্ষা করেছেন লেখক। নাম-গল্পটিতে পরছিদ্রান্বেষী দোলগােবিন্দবাবু বেনামা চিঠি লিখে পত্র-প্রাপকের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে আনন্দ পান। ‘পূতিগন্ধ’ ও ‘সাঁঝের শীতল’ নৈতিক অধঃপতনের বক্রগতি নিষ্ঠুর গল্প। ‘কমাণ্ডার ইন চীফ’ গল্পে অপরাধবােধের অনুপ্রবেশে কয়েকটি আতঙ্কগ্রস্ত চরিত্র ফুটে উঠেছে। জগদীশ গুপ্ত, মানিক, বনফুল প্রমুখের মতাে সতীনাথও মানব মনের রহস্য ও জটিলতাকে অসাধারণ দক্ষতায় উন্মােচিত করেছেন।

চতুর্থ পর্বের গল্পগুলিতে একদিকে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় সমাজের ত্রুটি, নীচতা, আত্মম্ভরিতা, আমলাতন্ত্র, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি উদ্ঘাটিত; অন্যদিকে তেমনি আবার এসেছে মনােবিকলনের বৃত্তান্ত। ‘চরণদাস এম. এল. এ’ এবং ‘পরকীয় সনইন-ল’ গল্পে নীতিভ্রষ্ট রাজনীতিকের প্রতি তীব্র শ্লেষ প্রকাশিত। ‘স্বর্গের স্বাদ’ গল্পে বিষয় ও ভাষার এক অন্য পরীক্ষা। বৈদিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ভাষাও এখানে তৎসম বহুল। বিষয়- ব্রহ্মবাদিণী অপালার ইন্দ্র কর্তৃক অপরূপ লাবণ্য ও নীরােগ দেহ প্রাপ্তির কাহিনী।

‘জাগরী’ ও ‘টোড়াই চরিত মানস’-এর লেখক সতীনাথের সমগ্র সাহিত্যকর্ম আজও যথেষ্ট আলােচিত ও বহুপাঠ্য নয়। আসলে মননের গভীরতা তাঁকে সস্তা জনপ্রিয়তা কখনও দান করেনি। তবু রুচিবান মননশীল পাঠকের কাছে সতীনাথ ভাদুড়ী বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ও অবিস্মৃত নাম।