ভারতীয় সংবিধান গঠনের সময়
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সংবিধান গঠিত হয়েছিল। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদের সভাপতি সংবিধানে সই করেন এবং সেটি পাস হয়ে যায়। নাগরিকত্ব, নির্বাচন, অস্থায়ী সংসদ, সাময়িক ও সংক্রমণগত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিবিধানগুলি সঙ্গে সঙ্গে চালু করা হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর থেকে। সংবিধানের বাকি অংশটি বলবৎ হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি থেকে।
জনকল্যাণের মাধ্যমে ব্যক্তির সার্বিক মঙ্গলসাধনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র কতকগুলি সুনির্দিষ্ট বিধিনিয়ম সৃষ্টি করে, যা রাষ্ট্র নিজে এবং ওই রাষ্ট্রের সকল ব্যক্তি মেনে চলতে বাধ্য হয়। ওই বিধিনিয়মগুলিকে বলে সংবিধান।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, ভারতীয়দের রাজনৈতিক ভাগ্য ভারতীয়রা নির্ধারণ করবে, এই দাবি বহুদিন আগে থেকেই ছিল।
(১) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন : ভারতের শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা চালু হলেও গভর্নর জেনারেলের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়ায় তা প্রহসনে পরিণত হয়। এর প্রতিবাদে গান্ধিজির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল অহিংস অসহযােগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের ব্যাপকতায় ইংরেজ শক্তি ভীত হয়ে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতশাসন আইন প্রণয়ন করে। দ্বৈতশাসন, গভর্নর জেনারেলের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা প্রভৃতি কারণে এই আইন সমালােচিত হলেও এই আইনের প্রেক্ষাপট পরবর্তীকালে ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা এবং স্বাধীন ভারতের সংবিধান চিনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
(২) ক্রিপস মিশন: ইংল্যান্ডের বিভিন্ন দল দ্বারা গঠিত সরকার এই মূলনীতিটি বুঝতে পারল যে, স্বশাসিত ভারতবর্যের জন্য একটা নতুন সংবিধান তৈরি করা দরকার। তাই ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ঘােষণার জন্য একটা খসড়া আনলেন, যার মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের কিছু প্রস্তাব ছিল, সেটা অবলম্বন করতে হবে (যুদ্ধের পর) এই শর্তে যে, দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, যেমন কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ তাদের প্রস্তাবটা যৌথভাবে মেনে নেবে। এই প্রস্তাবে বলা হয়—
- ভারতীয় জনগণের মধ্য থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রের গণপরিষদ তৈরি করবে ভারতীয় সংবিধান।
- সংবিধানে ভারতের অধীনে রাষ্ট্রের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকার British Common Wealth Nations -এর সমান অংশীদারিত্বে থাকবে।
- একটাই ভারত রাষ্ট্র হবে যার মধ্যে সমস্ত ভারতীয় প্রদেশ এবং রাজ্য থাকবে।
- যদি কোনাে প্রদেশ (অথবা ভারতীয় রাজ্য) এই সংবিধান মানতে না চায় তাহলে সে তার সেই সময়কার সাংবিধানিক অবস্থান বজায় রাখবে এবং এই ধরনের প্রদেশের জন্য আলাদা সাংবিধানিক ব্যবস্থা ব্রিটিশ সরকার নেবে।
কিন্তু ওই দুই দল প্রস্তাব মেনে নেওয়ার ব্যাপারে কোনােভাবেই ঐকমত্যে পৌছােতে পারল না এবং মুসলিম লিগ এই আবেদন জানায় যে—
- জাতের নিরিখে ভারতবর্ষকে দুটি স্বশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া উচিত এবং কিছু মুসলমান সম্প্রদায় অধ্যুষিত প্রদেশকে চিহ্নিত করে সেগুলিকে একত্রিতভাবে মুসলমান রাজ্য করে দেওয়া উচিত এবং তার নাম দেওয়া উচিত পাকিস্তান।
- একটি রাষ্ট্রের গণপরিষদের বদলে দুটি রাষ্ট্রের গণপরিষদ হবে অর্থাৎ পাকিস্তান তৈরি করার জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের গণপরিষদের প্রয়ােজন আছে।
(৩) ক্যাবিনেট মিশন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ব্রিটিশ শাসকরা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ক্যাবিনেট মিশন প্রেরণ করে। এই মিশন যে প্রস্তাব দেয় তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল— স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি সংবিধান রচনা সভা বা গণপরিষদ গঠিত হবে। প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যরা গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করবে এবং হিন্দু, মুসলমান ও শিখরা নিজেদের সংখ্যা অনুযায়ী প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে।
(৪) গণপরিষদ গঠন: ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী গণপরিষদ গঠিত হয়। এর মােট সদস্য সংখ্যা হল ৩৮৯ জন। এর মধ্যে প্রাদেশিক আইনসভা থেকে নির্বাচিত হন ২৯২ জন, মুসলিম প্রতিনিধি ৭৮ জন, শিখ ৪ জন এবং সাধারণের জন্য ২১০টি আসন সংরক্ষিত হয়।
(৫) গণপরিষদের উদ্দেশ্য: গণপরিষদের প্রধান কাজ হবে একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা প্রদান করা।
(৬) গণপরিষদের অধিবেশন: গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর, সভাপতি হন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ। দ্বিতীয় অধিবেশন বসে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২১-২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত, তৃতীয় অধিবেশন বসে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল-২ মে, চতুর্থ অধিবেশন বসে ১৪-৩১ জুলাই পর্যন্ত।
(৭) খসড়া কমিটি গঠন: পরিষদের বিভিন্ন কমিটি প্রস্তাবিত সংবিধানের মুখ্য তত্ত্বগুলির সংক্ষিপ্ত খসড়া বানিয়েছিল। এই কমিটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল Union Constitution Committee, Union Power Committee, Committee on Fundamental Rights ইত্যাদি। এইসকল কমিটির দেওয়া রিপাের্টের ভিত্তিতে একটি সাধারণ আলােচনা হওয়ার পর পরিষদ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট একটি খসড়া কমিটি বা Drafting Committee নিযুক্ত করল। Drafting Committee-র চেয়ারম্যান ছিলেন ড. বি আর আম্বেদকর। তারা পরিষদের সিদ্ধান্তকে বাস্তবরূপে প্রকাশিত করলেন এবং তার মধ্যে বিকল্প ও অতিরিক্ত কিছু প্রস্তাব দিলেন।
সংবিধান প্রণয়ন : ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করা হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে গণপরিষদ পুনরায় মিলিত হয় খসড়ার প্রতিবিধানগুলির প্রত্যেকটি অংশ বিবেচনা করতে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর দ্বিতীয় দফার পড়া শেষ হল। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪নভেম্বর গণপরিষদ আবার মিলিত হল তৃতীয় দফায় খসড়াটি পড়ার জন্য এবং ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর পুনরায় নিরীক্ষণ শেষে গণপরিষদের সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সংবিধানে সই করলেন এবং সেটি পাস হয়ে গেল। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি সমগ্র সংবিধান বলবৎ হয় এবং এই দিনটিকেই “সংবিধান শুরুর দিন” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
Leave a comment