বাংলা উপন্যাসের ধারায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮] জনপ্রিয় কথাশিল্পী। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসের এক জটিল সময়ক্রান্তিতে বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর দীপ্র আবির্ভাব। বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের অত্যাসন্ন পতন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের মানবিক মূল্যবোধ চেতনার ক্রমভঙ্গুরতা এবং ভয়াবহ অর্থনৈতি অর্থনৈতিক সংকটের সময়খণ্ডে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আবেগ-শাণিত ভাবালুতালালিত যে উপন্যাস ধারা নির্মাণ করেছেন, বাঙালি পাঠক সেখানে সহসা খুঁজে পেলেন তাঁর স্বপ্নময় জীবনের নতুনপ্রান্ত। ঔপন্যাসিক বাংলা উপন্যাসের জন্য ভাবাবেগের বন্ধ দরজাটি খুলে দিয়েছিলেন ‘দেবদাস’ সহ বিভিন্ন উপন্যাসে; তাছাড়া বাংলা উপন্যাসকে তিনি নিয়ে গেছেন অনেকখানি বাস্তবের কাছাকাছি। ‘শ্রীকান্ত’ ও ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসসহ বিভিন্ন উপন্যাসে সামাজিকভাবে নিন্দিতদের করে তুলেছিলেন তাঁর উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা। এবং লেখনীর মধ্য দিয়ে আক্রমণ করেছিলেন বহুপ্রথা ও প্রথাগত নীতিবোধকে। তিনি নারী হৃদয়ের গভীরতম অন্তঃস্তলে প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছেন। ফলে তাঁর রচনায় ভাবাতিশয্য থাকা স্বাভাবিক। তাঁর অপেক্ষাকৃত অপরিণত রচনায় উচ্ছ্বাসের বাহুল্য আছে। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনায় আছে সংযমের মাধুর্য।
বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা প্রবাদ তুল্য। কাহিনি বর্ণনার নৈপুণ্য, নারীর মহিমা কীর্তন, ভাবালুতা সৃষ্টির দক্ষতা ও সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কনে একান্তভাবে হৃদয়াবেদন সৃষ্টি করেছিল এই জনপ্রিয়তা। শরৎসাহিত্যে এমন কিছু আবেদন আছে যা সর্বভারতীয়। রবীন্দ্রনাথের সময়েই শরৎচন্দ্রের ঔপন্যাসিক, প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। তিনি তাঁর পূর্বসূরির বিশ্লেষণ পদ্ধতি ও ভাষাভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারেননি, কিন্তু শরৎচন্দ্রের প্রতিটি রচনাই তাঁর শিল্পস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক যুগে তাঁর পর একমাত্র শরৎচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশকলার স্বকীয়তা বাংলা উপন্যাসকে সমৃদ্ধ ও নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করেছে, এটাই তাঁর বিস্ময়কর কৃতিত্বের নিদর্শন। এই শিল্পীর মৌলিকতা সত্যই অসাধারণ।
শরৎচন্দ্রের অসাধারণ জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ সাধারণ মেয়ে ও নারী জাতির প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও দরদ।
সাধারণ মেয়েকে তিনি দিয়েছিলেন অসাধারণ মর্যাদা। তাঁর করুণ-নিপুণ লেখনী-মুখে বাংলার সাধারণ মেয়ের স্বভাবের গভীর তলিয়ে থাকা অসাধারণত্ব ধরা দিয়েছিল। তাদের তিনি ধন্য করেছিলেন। নারীর হৃদয়-রহস্য উন্মোচনেও সহজ আন্ত রিকতার প্রকাশকে ফুটিয়ে তুলতে শরৎচন্দ্র অদ্বিতীয়। শরৎ সাহিত্যের যেসব বিশিষ্ট কৌশল লক্ষ করা যায় তার ভেতর প্রধানত হচ্ছে নারীর অপরিসীম শক্তির উদঘাটন। এমন কিছু নারী শরৎ সাহিত্যে আছে যাদের ভেতর শক্তির এক অপরিসীম দীপ্তি লক্ষ করা যায়। শরৎ সাহিত্যের নারীরা সবাই সতীসাধ্বী গৃহবধূ নয়, এদের মধ্যে আছে বাল্যবিধবা, অবক্ষণীয়া, অনূঢ়া কন্যা, আর আছে সংসার-সীমান্তের পতিতা-ভ্রষ্টারা। এসব তথাকথিত পতিতা ও ভ্রষ্টার চরিত্র চিত্রণে শরৎচন্দ্রের শিল্পদৃষ্টি সম্পূর্ণ সজাগ ছিল, এখানে তাঁর ঔদার্যের তুলনা হয় না। শরৎচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, ‘সতীত্বের চেয়ে নারীত্ব বড়’। আর তাই এসব ‘অসতী’র কালিমালিপ্ত বাইরের জীবনের অন্তরালে তাদের নারীত্বের যে দুর্লভ মহিমা তিনি দেখেছিলেন, তা চিত্রিত করেছেন সযত্নে দরদ দিয়ে। নারী অবস্থা বৈগুণ্যে পতিতা হলেও তার মধ্যে মানবিক মনোভাব যে বেঁচে থাকতে পারে, শরৎচন্দ্র এসব নারী (রাজলক্ষ্মী, সাবিত্রী, চন্দ্রমুখী, প্রমুখ) চরিত্রের মাধ্যমে তা-ই দেখিয়েছেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হৃদয়ের আবেদন অস্বীকার করেননি। বিশেষকরে নরনারীর প্রেমের জন্য তাকে আকৃষ্ট করেছে। তাঁর কাছে ব্যক্তির মূল্য বেশি বলে ব্যক্তি হৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ নরনারীর প্রেমের প্রকাশ হয়েছে নিরঙ্কুশ। প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি সামাজিক প্রচলিত নিয়ম আকুতিকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছেন, তাকে সমাজের সংকীর্ণতাকে দিয়ে
গলা টিপে হত্যা করার কোনো যুক্তি তিনি খুঁজে পাননি।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে প্রেমের প্রকাশ বহু-বিচিত্র রূপে প্রতিভাত হয়েছে। কোথাও এর প্রকাশ অবিবাহিত তরুণ- তরুণীর রোমান্টিক কাহিনিতে (দত্তা, পরিণীতা), কোথাও দাম্পত্য-সম্পর্কের বিচিত্র জটিল রহস্যরূপে (পণ্ডিতমশাই, বিরাজ বৌ, চন্দ্রনাথ, দেনা পাওনা), কোথাও বা হিন্দু বিধবার সমাজ নিষিদ্ধ প্রেমে (বড়দিদি, পল্লীসমাজ), আবার কোথাও বিবাহিতা সধবা নারীর পরকিয়া প্রেমে (স্বামী, গৃহদাহ, শ্রীকান্ত) এবং সর্বশেষে পতিতা নারীর প্রেমে (দেবদাস-চন্দ্রমুখী, চরিত্রহীন- সাবিত্রী, শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মী)। প্রেমের এমন বিচিত্র লীলা-রহস্য ও গভীর রসানুভূতি শরৎচন্দ্রের আগে কোনো সামাজিক-পারিবারিক উপন্যাসে রূপ লাভ করেনি। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নরনারীর বিচিত্র সম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রেমের যে আশ্চর্য বিকাশ সম্ভব শরৎচন্দ্র সেদিকে বাঙালি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অত্যন্ত হৃদয়বান এবং যথার্থ মানবদরদি কথাশিল্পী। স্থবির সমাজব্যবস্থায় ধর্ম, দেশাচার ও সমাজ রক্ষার অজুহাতে ব্যক্তির অধিকার যেভাবে পদদলিত হয়, ব্যক্তির উপর সেভাবে নিপীড়ন চলে, লেখক শরৎচন্দ্র তা গভীর বেদনার সাথে প্রত্যক্ষ করেছেন। এ ধরনের সামাজিক অন্যায় ও অবিচার তাঁর লেখক সত্তাকে খুবই প্রভাবান্বিত করেছে। তাঁর সহানুভূতি সর্বদাই ছিল বঞ্চিত নিপীড়িতদের সপক্ষে। সমাজের তথাকথিত নিচু শ্রেণির প্রতি তাঁর আন্তরিক সহানুভূতির পরিচয় শরৎ-উপন্যাসের পাতায় পাতায়। ‘পল্লীসমাজ’, অরক্ষণীয়’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘দেনা-পাওনা’, ‘ছবি’, ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ প্রভৃতি গল্প-উপন্যাসে নির্বাচিত নারী এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিচু তলার মানুষের অন্তরঙ্গ জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
গভীর দরদ ও মানবিক দৃষ্টি দিয়ে শরৎচন্দ্র যৌথ পরিবারের চিত্র এঁকেছেন। তিনি কখনো ভাঙনের পক্ষপাতী ছিলেন না। তবে প্রথানুগত্যের অন্তঃসারশূন্য পরিস্থিতির প্রতিও তিনি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। পূর্ব পুরুষের জীর্ণ আবাসস্থলের প্রতিও তিনি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। পূর্বপুরুষদের জীর্ণ আবাসস্থলের প্রতি বাঙালি হিন্দুদের মমত্ববোধ বেশি দেখা যায় তা অনেক সময় ধর্ম বিশ্বাসের ন্যায় বিশ্বাস জন্মায়, শরৎচন্দ্র এই বিশ্বাসের মূল্য দিয়েছেন তবে বাস্তব সত্যকে তিনি স্বীকার করেছেন। যৌথ পরিবার ভিত্তি গল্প-উপন্যাসগুলো হচ্ছে ‘নিষ্কৃতি’, রামের সুমতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘মেজদিদি’ প্রভৃতি।
শরৎসাহিত্যে বাংলার শোষিত কৃষক, খেতমজুর, অনগ্রসর সম্প্রদায় এবং নির্যাতিত নারী সমাজ বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। সামস্ত শ্রেণির লোভের আগুনে যাঁরা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হয়েছে তাঁদের চরিত্র শরৎচন্দ্র প্রগাঢ় সহানুভূতি ও গভীর মমত্ববোধের সাথে এঁকেছেন এবং তাঁদেরকে মানব স্বভাবের বিশিষ্ট গুণের আধার করে গড়ে তুলেছেন। কৃষক চরিত্রগুলো রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদের শরীরে গাঁয়ের মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ। তাঁরা স্নেহমমতায়, সততায়, সাধুতায়, দুর্বলতায়, কৃতজ্ঞতায়, পরোপকারিতায়, আন্দোলনে সংগ্রামে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। সামন্ত অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা কখনো প্রতিবাদে মুখর, আবার কখনো প্রতিকারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শরৎচন্দ্রের দৃষ্টিতে তারা শ্রমজীবী- পরশ্রমজীবী নয়। তিনি মনে করতেন, জমিদার নয়, কৃষকরাই যা কিছু wealth সৃষ্টি করেছে। সাগর সর্দার (দেনা-পাওনা), গফুর (মহেশ), গদাধর, হরিচরণ, কামিনীর মা, (অভাগীর স্বর্গ), নয়ন বাগদী, সনাতন হাজরা, লেঠেল সর্দার আকবর (পল্লিসমাজ) প্রমুখ কৃষক চরিত্র যার সাহিত্যে মুখ্য স্থান অধিকার না করলেও ক্ষুদ্র পরিসরে আপন মহিমায় উজ্জ্বল।
কৌলিনী প্রথা ও বহুবিবাহ প্রথার বিষময় ফল কিভাবে কর্মজীবনকে জর্জরিত ও দিশেহারা করে তুলেছিল শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্রদাস’, ‘পল্লিসমাজ’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘রাজলক্ষ্মী’, ‘পথনির্দেশ,’ ‘অরক্ষণীয়া’ প্রভৃতি উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই। নির্যাতিতা ও পতিতা নারীর জীবনযন্ত্রণার কথা স্থান পেয়েছে ‘দেবদাস’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’, ‘আঁধারে আলো’ প্রভৃতি রচনায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পতিতাদের মানবিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করেছেন। তাঁর মতে, পতিতারা নিকৃষ্ট ও জঘন্য জীবনযাপন করলেও তাদের মধ্যে মানবিক সত্তা বিলুপ্ত হয় না। পতিতারা সতীত্ব হারালেও নারীত্ব হারায় না। প্রতিকূল পরিবেশে হয়ত তারা এ ধরনের জঘন্য জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়, কিন্তু তাহলেও নারীধর্ম তাদের লোপ পায় না। শরৎচন্দ্র পতিতাদের পূর্ণতা দিতে পারেননি সত্য, তবে গভীর দরদের সাথে এদের দুঃখ বেদনা বর্ণনা করেছেন। মূল্য দিয়েছেন এদের প্রেমের। শুধু সহানুভূতি নয়, মানুষ হিসেবে রাজলক্ষ্মী, সাবিত্রী, চন্দ্রমুখী, বিজলীর প্রতি শরৎচন্দ্রের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। ফলে তিনি দেখিয়েছেন এদের প্রত্যেকের জীবনে এসেছে প্রেমের অপূর্ব মহিমা। বহুচারিণী হয়েও তারা পবিত্র প্রেমের শিখা প্রজ্বলিত করেছে। সেই আলোকে প্রস্ফুটিত হয়েছে তাদের মানবিকতা ও নারীত্ব। তারা ফিরে আসতে চেয়েছে সমাজে সংসারে। জীবনকে মাধুর্যমণ্ডিত করতে চেয়েছে ছেলে-মেয়ে-স্বামী-সংসার নিয়ে। নারীত্বের চিরন্তন কামনা সংসার সন্তান। তাদের নিষ্ফল আসা বাহির দ্বারে বৃথাই মাথা কুটে মরেছে। পুরুষের গড়া সমাজ তাদের আর কিছুতেই ভেতরে আসতে দেয়নি। ভগ্ন প্রাণ সেই পতিতাদের হৃদয়ের আর্তি শরৎসাহিত্যে প্রতিধ্বনি হয়েছে।
শরৎচন্দ্র তাঁর রচনায় বিপ্লবের কথা বলেছেন। সমাজের অর্থনৈতিক দিকটার প্রতি তাঁকে কোনো কোনো সময় সচেতন হতে দেখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির আবেগের স্রোতে সমষ্টির কথা ভেসে গেছে। যেমন- ‘বিপ্রদাস’ উপন্যাসে দ্বিজদাসকে দেখতে পাই জমিদারের বিরুদ্ধে মিছিলের পুরোভাগে। কিন্তু শরৎচন্দ্র তাঁর সমাপ্তি টেনেছেন বন্দনার আঁচলের নিচে মুখুজ্জ্যে পরিবারের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য। ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসের জমিদার জীবানন্দ গ্রামের কৃষিজমি বিক্রি করে দিয়েছেন চিনিকলের মালিকের কাছে। ভূমিহীন কৃষকরা অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এ উপন্যাসে সর্বপ্রথম নিঃস্ব কৃষক সমাজকে সংগঠিতভাবে অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে দেখা যায় এবং অর্থনৈতিক সংগ্রামের একটি সুস্পষ্ট রূপ এতে ফুটে উঠেছিল। সমালোচক কুমুদকুমার ভট্টাচার্যের ভাষায়:
“তারা জমিদারের বাড়িতে আগুন দিয়াছে। জীবনের অধিকাংশ কাল যাহারা পেট ভরিয়া খাইতে পায় না, শীতের রাত্রে যাহারা বসিয়া কাটায়, খরার দিনে যাহারা কুকুর বেড়ালের মত মরে, আবাদের দিনে এক মুষ্ঠি বীজের জন্য যাহারা ওই দরজার বাইরে হানা দেয়- তাদের দুর্জয় সাহস দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন জনার্দন সর্বেশ্বরের দলবল।” (শরৎচন্দ্র ও বাংলার কৃষক)
এভাবে এ উপন্যাসে ভূমিহীন কৃষকদের বাঁচা মরার সমস্যা নিয়ে সুন্দর একটি সামাজিক পট তৈরি হতে পারত। কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর সেদিকে এগোননি। উপন্যাসের কাহিনি দানা বেঁধে উঠেছে দোর্দন্ত প্রতাপ অত্যাচারী জমিদারের কাছে বলশালিনী ভৈরব আত্মসমর্পণকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কাছে পরাজিত হয়েছে সমাজ- প্রগতির সংগ্রাম। ‘পল্লিসমাজ’ উপন্যাসেও কৃষক ও নীচ জাতির জাগরণের চিত্র আছে। রমার বাড়ির দুর্গাপূজার উৎসবকে গ্রামের সমস্ত নীচু জাতি বয়কট করেছে। রমেশের কর্মকাণ্ডে সমষ্টির ভাগ্য উন্নয়নের একটি প্রয়াসও লক্ষ করা যায়। কিন্তু এতে শ্রেণিসংগ্রাম এতখানি সুস্পষ্ট হয়নি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপ্লবের কথা, বিদ্রোহের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকারণে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। তাঁর উপন্যাসের প্রত্যেক নায়ক চরিত্রই ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নিয়ে আবর্তিত। যেমন- বড়দিদির সুরেন্দ্র ‘পরিণীতার’ শেখর, ‘দেবদাসে’র দেবদাস, ‘চরিত্রহীনে’র সতীশ, ‘দত্তা’র নরেন, ‘গৃহদাহে’র মহিম ও সুরেশ, ‘পথের দাবী’র অপূর্ব। বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে এদের সম্পর্ক নির্ণয়ে শিল্পীজীবনের বাস্তব দিক, বিশেষকরে অর্থনৈতিক দিক থেকে শরৎচন্দ্র সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন। কিছু চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমাজের হৃদয়হীন নিষ্ঠুর রীতিনীতি ও আচার-আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও আক্রোশ প্রকাশ পেলেও শেষ পর্যন্ত তা-ও সমাজ সংস্কারের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছে। যেমন-
‘চরিত্রহীনে’র কিরণময়ী, ‘গৃহদাহের অচলা, কিংবা ‘শেষপ্রশ্নে’র কমল সমাজের কাছে শেষ পর্যন্ত পরাভূত হয়েছে।
‘পথের দাবী’ উপন্যাসে সাম্রাজ্যবাদের অমানুষিক শোষণের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট চিত্রিত হয়েছে।
কিন্তু পরিণামে এ উপন্যাসেরও বৈপ্লবিকতা অনেকখানি হালকা হয়ে গিয়েছে। শরৎচন্দ্র অপূর্ব ভারতীয় প্রেম-কাহিনিকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কারণে কাহিনির পরিণামে বিপ্লববাদের পরিবর্তে মানবীয় দুর্বলতা প্রধান হয়ে উঠেছে। শরৎসাহিত্যে বাংলার শোষিত কৃষক, খেত-মজুর, অনগ্রসর সম্প্রদায় এবং নির্যাতিত নারীসমাজ বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। তিনি বাংলার কৃষক ও কৃষক আন্দোলন, ছোটো জাতের দরিদ্র মানুষের উপর সমাজের উচ্চবর্ণের শোষণ ও মানসের চিত্র চিত্রিত করেছেন।
সমাজ সমস্যার আবিষ্কারক: সমাজ সমস্যার আলোচনামূলক উপন্যাসেও শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব পরিস্ফুট।
রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ উপন্যাসেই আমরা বাঙালি সমাজের মজ্জাগত সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার প্রবণতা সমালোচনা পাই। কিন্তু “রবীন্দ্রনাথ সাধারণত এই বিষয়ের খুব ব্যাপক ও গভীর বিশ্লেষণ করেন না, প্রসঙ্গক্রমে সামাজিক দুর্নীতিগুলোর প্রতি কটাক্ষপাত বা অঙ্গুলি সংকেত করেন, ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যালোচনাই তাঁহার প্রধান বিষয়।” আর শরৎচন্দ্রের ‘অরক্ষণীয়া’, ‘বামুনের মেয়ে’ ও ‘পল্লীসমাজে’ আচারসর্বস্ব কুসংস্কারের সমর্থনে সমাজশক্তি আনুষঙ্গিক উৎপীড়ন যে আবেগতীব্রতা ও বাস্তব চিত্রণের তীক্ষ্ণতায় উদ্ঘাটিত হয়েছে, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে তার কোনো তুলনা মেলে না। এই প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলছেন-অন্যান্য লেখকের সহিত তুলনায় শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে এই অত্যাচার কাহিনি আরও করুণরসপ্রধান ও মর্মস্পর্শী হইয়াছে। তাঁর বিশ্লেষণ যেমন তীক্ষ্ণ ও অভ্রান্ত লক্ষ্য, তাঁহার করুণরস সঞ্চার করিবার ক্ষমতাও সেই পরিমাণে অসাধারণ।”
‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’, ‘শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি উপন্যাসে নিষিদ্ধ সমাজবিরোধী প্রেমচিত্রণে শরৎচন্দ্রের অনন্যসাধারণ দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে সমাজশক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে ও নিজেরও আবেগ সংস্কারের আন্তর সংঘাতে নারীর আত্মোপলব্ধির সমস্যা আরও বাস্তব, জটিল এবং তীক্ষ্ণ। ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের নায়িকা অচলার ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার টানাপোড়েনে নারীর দোলাচলবৃত্তির সমস্যা যে বিশ্লেষণ নৈপুণ্য ও সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিতে চিত্রিত হয়েছে, তা অতুলনীয়। আর কোনো ঔপন্যাসিকই যন্ত্রণার অগ্নিদহনে দগ্ধ নারীর হৃদয়কে এমন রক্তবর্ণে, বাস্তব অভিজ্ঞতার তীব্রতা ও প্রত্যক্ষতায় উজ্জ্বল করে তুলতে পারেননি।”
উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বিশ শতকের সূচনায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নতুন গল্পের যে ডালি হাতে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন তা-ই জয় করে নিয়েছিল বাঙালি পাঠক-চিত্তকে। উৎপীড়িত, ব্রাত্য মানুষের প্রতি তাঁর গভীর সমবেদনা। আর সেই মর্মস্পর্শী মমত্ববোধের মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাঁর অক্ষুণ্ণ জনপ্রিয়তার উৎস। তাছাড়া শরৎচন্দ্রের সাহিত্যে বিচিত্র-৩রিত্রের বিচিত্র রহস্য ও সমন্য, রূপায়িত হয়েছে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে। তিনি সমাজের অনুপুঙ্খরূপ অঙ্কনের সাথে সাথে দারিদ্রা লাঞ্ছিত নারীর ব্যক্তিত্বময় নারীর রূপও অঙ্কন করেছেন। আর সবকিছু মিলিয়ে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসসমূহ শিল্পসফল এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনিও সফল হয়েছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment