হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাসে ফণীশ্বর নাথ রেণু একজন কীর্তিমান লেখক। উপন্যাস রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত শিল্পী। ভারতীয় গ্রামীণ জীবন ও সমাজ ছিল তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা আট, সেগুলি হল—

  • ১। ময়লা আঁচল (১৯৫৪) ; 

  • ২। পরতি পরিকথা (১৯৩৭) ; 

  • ৩। দীর্ঘতপা (১৯৬৩); 

  • ৪। কিতনে চৌরাহে (১৯৬৬) ; 

  • ৫। গোত্রান্তর (১৯৭০); 

  • ৬। রামরতন রস (অসম্পূর্ণ ১৯৭১); 

  • ৭। পন্টুবাবু রোড (১৯৭১) 

  • ৮। জুলুস।

রেণু রচিত উপন্যাসগুলির যে যে বৈশিষ্ট্য আমাদের নজরে আসে সেগুলিকে সূত্রাকারে এইভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যথা—

১। ঔপন্যাসিক রেণুর সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল আঞ্চলিকতা। বিহারের বিশেষ অঞ্চলের ভূমিরূপ তথা শস্যরূপের, সমাজের মানুষের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-আচার বিশ্বাস-প্রথার চিত্রণে যেমন তাঁর উপন্যাস বিশিষ্ট তেমনি শিল্পগত দিক দিয়েও উৎকৃষ্ট।

২। অবহেলিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত অন্ত্যজ মানুষের সার্থক রূপকার রেণু। তাঁর উপন্যাসে অর টোলি, যাদব টোলি, অত্সা টোলি, চামার টোলি, দুসাদ টোলির মানুষের জীবন সংগ্রামের চিত্র সহানুভূতির সঙ্গে প্রকাশিত। 

৩। রাজনৈতিক প্রসঙ্গ ফণীশ্বর নাথ রেণুর উপন্যাসের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক দলাদলি, নেতা, নেতৃত্ব ও উচ্চশ্রেণির কর্মীদের সুবিধাবাদী মনোভাব ও রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিরোধের চিত্রে মুখর রেণুর উপন্যাস।

৪। রেণুর উপন্যাস বৃত্তান্তধর্মী। লোকজ উপাদানের সমন্বয়ে তার উপন্যাসের গঠন স্বতন্ত্র।

মাটি ও মানুষের লেখক ফণীশ্বর নাথ রেণু। মৃত্তিকালগ্ন মানুষের বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবসম্মত রূপায়ণই তার উপন্যাসের মূল উপজীব্য। তাঁর উপন্যাসগুলির ক্রমিক আলোচনায় এ সত্য প্রতিপন্ন হবে।

ময়লা আচল : উপন্যাসটি সমগ্র হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ রচনা। প্রেমচন্দের গোদানের পর এটাই হিন্দি উপন্যাসের বলিষ্ঠ লেখা। এই উপন্যাসের দুটি স্তর। প্রথম স্তরে আছে অন্ত্যজ মানুষের আঞ্চলিক জীবনের রূপচিত্র। দ্বিতীয় স্তরে আছে গান্ধিজি প্রভাবিত রাজনৈতিক সংগ্রামশীলতার চিত্র। বিহারের পূর্ণিয়া জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজীবন, তাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্ম জীবনের চিত্র এই উপন্যাসে চিত্রিত। দ্বিতীয় পর্বে ময়লা আঁচল স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধিজির প্রভাব ও জনমানসে তার গ্রহণ যোগ্যতার কথা প্রতিফলিত। এক বাঙালি ডাক্তার প্রশান্ত বাঁড়ুজ্জেকে কেন্দ্র রেখে এ উপন্যাসের কাহিনি বর্ণিত। তার দর্পণে চিত্রিত উপন্যাসের বিষয়।

পরতি পরিকথা : পরতি পরিকথা উপন্যাসের শিল্প সিদ্ধি সর্বাধিক। উপন্যাসটির প্রেক্ষিত কোশী অঞ্চল এবং কোশী নদী ও নদীবাঁধ। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জিতেনবাবু চরিত্রে একই সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় জীবনধারা ও আধুনিক চিন্তাধারা প্রতিফলিত। আছে লুত্তোবাবুর মতো কৃতঘ্ন চরিত্রও। তবে এ উপন্যাসের বিষয় কোশী নদীতে বাঁধ দিয়ে তার ধারাকে দুলারীদাই নদীতে প্রবাহিত করে পতিত জমিকে শস্যশ্যামলা করার অনবদ্য উপস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে ভূমিপুত্র মানুষের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণেও মুখর পরতি পরিকথা।

দীর্ঘতপা-জুলুস-কিতনে চৌরাহে : ‘দীর্ঘতপা’ শহরকে পটভূমি করে রচিত উপন্যাস। নারী জীবন ও সে জীবনের সমস্যাই এর উপজীব্য। এ উপন্যাসে রেণু পুরুষতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রামশীল জীবনের কথাকেই বিষয় করেছেন।

দেশভাগের পটভূমিকায় রচিত একটি স্বতন্ত্র উপন্যাস ‘জুলুস’। পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জীবন সংগ্রাম, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, দেশত্যাগজনিত বেদনাই এই উপন্যাসের উপজীব্য।

কিশোর পাঠ্য উপন্যাস ‘কিতনে চৌরাহে’। এটি দেশাত্মবোধমূলক উপন্যাস। বিষয় যেমন মর্মস্পর্শী তেমনি চমকপ্রদ। অন্তরঙ্গ গীতিকাব্য সুলভ মেজাজই এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

পল্টুবাবু রোড : ‘পন্টুবাবু রোড’ উপন্যাসটির নায়ক চরিত্র পন্টুবাবুই। তার মাধ্যমেই তৎকালীন সমাজের ক্ষয়িষ্ণু রূপটি অঙ্কিত। পটভূমি বৈরীগাছি গঞ্জ। কুটিল, ধূর্ত, স্বার্থপর, কামুক পন্টুবাবুর অঙ্গুলি হেলনে, ঠিকাদার, ব্যবসায়ীরা কীভাবে আমজনতার ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করেন তার সত্য চিত্র এখানে উন্মোচিত।

এই ছ’খানি উপন্যাসের বাইরে আর দু’খানি উপন্যাস রেণু লিখেছিলেন। তার মধ্যে ‘রামরতন রায়’ অসম্পূর্ণ রচনা। রামরতন নামক এক চোরের কৌতূহলোদ্দীপক জীবন কথা নিয়ে শুরু হয়েছিল এই উপন্যাস। ভারত-নেপাল সীমান্তের কাহিনি এ উপন্যাসে লিপিবদ্ধ।

গোত্রান্তর প্রকৃত অর্থে উপন্যাস নয়। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। ঔপন্যাসিক রেণুর উপন্যাসাবলির মর্মকথা হল অন্ত্যজ মানুষের প্রতি সহানুভূতি। গ্রাম জীবনের প্রতি মমত্ববোধ। তদুপরি ভারতাত্মার অন্বেষণ তাঁর উপন্যাসের তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ সবের মিশ্রণেই বিশিষ্ট হয়ে উঠেছেন ঔপন্যাসিক ফণীশ্বর নাথ রেণু।