বাঙলা উপন্যাসের যথার্থ স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর আগে বাঙলা সাহিত্যে গল্পের কাহিনী ছিল, কিন্তু উপন্যাস ছিল না অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণময় বাস্তবধর্মী কাহিনী একেবারেই ছিল না। প্যারীচাঁদ মিত্র ‘আলালের ঘরের দুলালে’ উপন্যাসের একটি পটভূমিকা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু চরিত্রগুলাের মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ নেই বলেই তার মধ্যে উপন্যাসধর্মিতা আসে নি। বঙ্কিম-উপন্যাসে এই গুণগুলাে সর্বপ্রথম পুরােপুরিভাবেই এসেছে এবং সেইজন্যেই বাঙলা সাহিত্যে উপন্যাসের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র।
ডাঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস-সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন- “বঙ্কিমের হাতে বাঙলা উপন্যাস পূর্ণ যৌবনের শক্তি ও সৌন্দর্য লাভ করিয়াছে। তাহার সবকয়টি উপন্যাসের মধ্যেই একটা সতেজ ও সমৃদ্ধ ভাব খেলিয়া যাইতেছে। জীবনের গভীর রস ও বিকাশগুলি ফুটিয়া উঠিয়াছে এবং জীবনের মর্মস্থলে যে নিগূঢ় রহস্য আছে, তাহার উপর আলােকসম্পাত করা হইয়াছে।”
শিল্পী বঙ্কিমের হৃদয়াবেগ চিরদিনই রােমান্স রসকে গ্রহণ করেছে। রােমান্স লেখকের অতীতের প্রতি যেমন একটি স্বাভাবিক মানসপ্রবণতা থাকে, তেমনি একটি অতিপ্রাকৃতের প্রতি বিশ্বাসও থাকে। কিন্তু তা হলেও রােমান্সের মধ্যে একটি বাস্তবধর্মিতার সূত্রও একেবারে অলক্ষিত থাকে না। “অতীতের বিচিত্র বেশভূষা ও আচার-ব্যবহার অতীতের আকাশ বাতাস লঘু মেঘখণ্ডের মত যে সমস্ত অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস ও কবিত্বময় কল্পনায় ভাসিয়া বেড়ায়, রােমান্স লেখক সেইগুলিকেই ফুটাইয়া তুলিতে যত্ন করেন। অবশ্যই সমস্ত অসাধারণত্বের রােমান্স বাস্তব জীবনের সহিত একটি নিগূঢ় ঐক্য হারায় না; জীবনের সহিত যােগসূত্র হারাইলেই ইহা একটি সম্পূর্ণ অসম্ভব গল্পের মত হইয়া পড়িবে।” বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সুদূরপ্রসারী কল্পনার দ্বারা বহমান জীবনের তুচ্ছতা ও দীপ্তিহীনতা থেকে অতীত ইতিহাসের ঘটনাবহুল পরিপ্রেক্ষিতে তার বেশির ভাগ কাহিনীর মূলকেন্দ্র স্থাপন করেছেন; এর মধ্যে হয়তাে আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরব-ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে আমাদের ব্যক্তি-মানসকে জাগ্রত করবার একটি অভিপ্রায় লুকানাে ছিল। ইতিহাসের কথাবস্তুতে কল্পনারস মিশিয়ে তিনি মানব-মনের নিগূঢ়তম সত্যকে রূপ দিতে চেয়েছেন। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের রােমান্টিক উপন্যাসে কেবল ঘটনার বর্ণচ্ছটাই নেই, মানবজীবনের চিত্তলােকের অত্যুজ্জ্বল প্রকাশও আছে। তার উপন্যাসে যে অতলস্পর্শী জীবনজিজ্ঞাসার অপরূপত্ব এসেছে তা বাঙলা সাহিত্য সত্যই অপূর্ব। সাহিত্যরসের এক দুর্লভ আভিজাত্যে তার উপন্যাসগুলাে তাই এক চিরন্তন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বঙ্কিম-উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যের দিক আলাচনা করতে গেলে প্রথমেই দেখা যায়, তার উপন্যাসের প্রধান ভাবগ্রন্থি দাম্পত্যপ্রেম।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’; ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে যখন এই উপন্যাস প্রকাশিত হয় তখন বঙ্কিমচন্দ্র মাত্র সাতাশ বছরের যুবক। এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বাঙলা সাহিত্য ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর আলােড়নের সৃষ্টি হয়। এই রােমান্টিক উপন্যাসে জীবন জিজ্ঞাসার ততটা গভীরতা আসেনি, চরিত্রচিত্রণের শিল্পমূল্যও খুব বেশী নেই, কিন্তু তৎকালীন বাঙলা গল্প-সাহিত্যের দৈন্যের দিকটা বিচার করলে এটি একটি বিরাট সৃষ্টি প্রতিভার যথার্থ ফসল হিশেবে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। মানব-মানবীর অন্তরলােকের নিগঢ় কথার উন্মােচনে, বর্ণনার মাধূর্যপূর্ণ ভাষায় এবং কাহিনী-গঠনের মনােহারিত্বে এই রােমান্টিক উপন্যাসটি বাঙলাদেশের পাঠক-পাঠিকার সামনে একটি নতুন রসলােকের দ্বার খুলে দিল। বাঙলাদেশের পাঠান যুগের একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা এই গ্রন্থের কাহিনীবস্তুর মূল প্রেরণা সঞ্চার করেছে এবং এই কাহিনী-গঠনের পেছনে উড়িষ্যা ও বঙ্গাধিপতি পাঠান কতলু খাঁ ও মুঘল সেনাপতি মানসিংহের রাজকীয় সংঘর্ষ টি উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করে রেখছে। বীরেন্দ্ৰসিংহ ছিলেন গড় মান্দারণ দুর্গের অধিপতি, কতলু খা তাঁকে নিজের পক্ষভুক্ত করবার জন্য বীরেন্দ্ৰসিংহকে পত্র দিলে বীরেন্দ্ৰসিংহ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর ফলে বীরেন্দ্ৰসিংহ বন্দী ও নিহত হন। কিন্তু কাহিনীর কেন্দ্রমূলে রয়েছেন মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহ; তাঁর প্রণয়াকাঙক্ষী হল কতলু খার কন্যা আয়েষা ও বীরেন্দ্ৰসিংহের কন্যা তিলােত্তমা। কিন্তু আয়েষা তার নারী- হৃদয়ের প্রেমগভীরতাকে বহন করেও নিজের আত্মসংযমের দ্বারা তিলােত্তমাকে তার প্রেমজগতে প্রতিষ্ঠার পথ মুক্ত করে দিয়েছে। বিমলার অতীত জীবন কাহিনী ‘দুর্গেশনন্দিনী’র ঘটনা-বয়নে জটিলতার সৃষ্টি করেছে। তার জীবন কাহিনীর মধ্যে রােমান্টিক উপাদান যথেষ্ট আছে বটে, কিন্তু সমাজ সমস্যার দিকটাও উপেক্ষিত হয় নি।
বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘দুর্গেশনন্দিনী’র মাত্র একবছর পরে লিখিত হয়। শুধু বঙ্কিম-রচিত উপন্যাসসমূহের মধ্যেই নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যেই কপালকুগুলা একটি সর্বশ্রেষ্ঠ রােমান্স হিসাবে স্বীকৃত। এই উপন্যাসটির গঠন-কৌশলে গ্রীক ট্র্যাজিডির মত সরল রেখায়িত যে একটি সংহত রূপ এনেছে তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়। এই গ্রন্থ রচনার সময় বঙ্কিমচন্দ্রের মনে হয়তাে এই প্রশ্বটি জেগেছিল যে কোন নারী যদি মনুষ্য লােকালয় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন সমুদ্রতটবর্তী অরণ্যে বাস করে এবং তার পরে বিবাহিত হয়ে কোন গৃহস্থ-ঘরে ফিরে আসে, তবে তার বন্য-প্রকৃতির কোন পরিবর্তন হবে কিনা। কপালকুণ্ডলার সবচেয়ে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, অন্তরে তার আদিম নারীর মত করুণা আছে। বিবাহিত জীবনেও তার অন্তরের গভীরে কোনরূপ প্রণয়ের আবেশ জাগল না। এই নারী প্রকৃতির মতই অপরূপা ও রহস্যময়ী। নবকুমার তার রূপে মুগ্ধ হল বটে, কিন্তু তাকে পেল না ও এজন্যেই নবকুমারের সারাটি হৃদয় এক গভীর আর্তিতে ভরে উঠল এবং কপালকুণ্ডলার সঙ্গে তার জীবনাবসান হল। কাহিনীর মধ্যে জটিলতা এনেছে নবকুমারের পূর্বপত্নী পদ্মাবতী বা মতিবিবির কাহিনী। তার চরিত্রকে এইভাবে গড়ে তােলবার জন্যেই বঙ্কিমচন্দ্র যেন এই উপন্যাসে ইতিহাসের অবতারণা করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের রস খুব একটা ঘনীভূত হয়ে ওঠেনি। মতবিবি চরিত্রটি বঙ্কিমচন্দ্রের একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি ও জীবন্ত চরিত্র।
বঙ্কিমচন্দ্রের অপর উপন্যাস হল ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯)। ত্রয়ােদশ শতাব্দীর ঠিক সূচনাতেই বক্তিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাসের পটভূমিকা গড়ে উঠেছে। কিন্তু তার প্রায় সবগুলাে চরিত্রই অনৈতিহাসিক। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের একটি সংকটমুহূর্ততে বঙ্কিম পটভূমি করেছেন বটে, কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের পরিবর্তে বেশী প্রাধান্য পেয়েছে হেমচন্দ্র ও মৃণালিনীর রােমান্স-প্রেমকাহিনী। ঐ উপন্যাসের ঘটনাসূত্রের মধ্যে জটিলতার সৃষ্টি করেছে পশুপতি ও মনােরমা কাহিনী। এই উপন্যাসে মনােরমা কপালকুণ্ডলার মতই রহস্যময়ী। তার চরিত্রবৈশিষ্ট্য একটি জটিলতা ও অস্পষ্টতার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। হেমচন্দ্র চরিত্রটি উপন্যাসের নায়ক হলেও বীরত্ব বা বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে আমাদের শ্রদ্ধা একেবারেই আকর্ষণ করতে পারে না, মৃণালিনী-চরিত্রটির মধ্যে কোনরূপ নারী-ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় না।
এর পরে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪) আকারে ছােট, কিন্তু বঙ্কিম-প্রতিভাসুলভ রােমান্স-রস এর মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে আছে। প্রাচীন তাম্রলিপ্তের জীবন এর উপজীব্য। এই ক্ষুদ্র গ্রন্থটির পরিবেশ রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র যে সুবিপুল কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন তা এক বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষেই সম্ভব। ‘যুগলাঙ্গুরীয়’কে এককথায় সংক্ষিপ্ত উপন্যাস বলা চলে।
তার পরে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘চন্দ্রশেখর (১৮৭৫)। এই উপন্যাসটির মধ্যে বঙ্কিম-প্রতিভাসুলভ রােমান্স রস যথেষ্ট আছে, কিন্তু তা হলেও এর মধ্যে তৎকালীন যে-সমাজ জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হয়েছে তাই-ই তার অন্যান্য উপন্যাস থেকে একে একটি পৃথক মহিমায় চিহ্নিত করেছে। এই উপন্যাসটির পটভূমিকা রচনা করেছে বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব মীরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ উপন্যাসের ঘটনায় প্রাণস্পন্দন সৃষ্টি করেছে। কিন্তু লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে এই উপন্যাসে বাঙলার ইতিহাস ও সমাজজীবন যেন একসূত্রে গ্রথিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তা হলেও এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। আখ্যায়িকার মূলকেন্দ্রে আছে প্রতাপ-শৈবলিনীর প্রেমকাহিনী। এই প্রধান কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মীরকাশিম-দলনীর কাহিনী। এই দুটি কাহিনীর মধ্যে যােগবন্ধন রচনা করেছেন উপন্যাসের নায়ক চন্দ্রশেখর। একটি অপরূপ কল্পনাশক্তির দ্বারা বঙ্কিমচন্দ্র একটি উপেক্ষিত গ্রামের তিনটি নরনারীর জীবন-কাহিনী তৎকালীন রাজনৈতিক আবর্তনের মধ্যে টেনে এনে নবাব-পরিবারের সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছেন, শৈবলিনী নিজের দুর্দম আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে কিশাের কালের প্রেমাস্পদ প্রতাপের সন্ধানে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে, আর দলনী বেগমের দুর্ভাগ্যের গতি নির্ণীত হয়েছে ইতিহাসের দ্বারা। শৈবলিনীর প্রবৃত্তিবেগও চন্দ্রশেখরের জীবনে ট্র্যাজেডি ঘনীভূত করে তুলেছে। বঙ্কিমচন্দ্র এখানে জাগতিক নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে নরকের বিভীষিকার মধ্যে শৈবলিনীর প্রায়শ্চিত্তের বিধান করেছেন। তাতে শিল্পী বঙ্কিম নীতিবাদী বঙ্কিমের কাছে পরাজিত হয়েছেন। এই উপন্যাসে প্রতাপের প্রেম ও ত্যাগ গভীরতায় একটি অপরূপ মহিমা লাভ করেছে।
এরপর বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম প্রখ্যাত উপন্যাস ‘রাজসিংহ’-এর (১৮৮২) নাম করতে হয়। এই উপন্যাসের বঙ্কিমচন্দ্র ঐতিহাসিক তথ্যকে যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে কাহিনী পরিবেশন ও চরিত্রগুলাে অঙ্কিত করেছেন। কাহিনীর কেন্দ্রভূমিতে আছে রাজসিংহ ও ঔরঙ্গজেবের ঐতিহাসিক সংগ্রাম এবং রাজসিংহ, চঞ্চলকুমারী, নির্মলকুমারী, মাণিকলাল প্রভৃতি চরিত্রগুলাে শিল্পী বঙ্কিমের হাতে অপরূপভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের কাহিনীধারা একটি নিরবচ্ছিন্ন গতিতে বয়ে গেছে এবং সেই গতি পাঠক-মনকেও মুগ্ধ বিস্ময়ে টেনে নিয়ে যায়। জেবউন্নিসা ও মােবারকের যে প্রণয়-কাহিনী উপন্যাসটিকে প্রাণবস্ত করেছে তার। মধ্যে ইতিহাসরস একেবারেই নেই, কিন্তু মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তিজীবনের রসেই শিল্পগুণের দ্বারা ইতিহাসের মধ্যেও গতি সঞ্চার করতে চেয়েছেন। এই কাহিনীর মধ্য দিয়ে ঐশ্বর্যময় মানবজীবন ও দূরদৃষ্টতার মাধ্যমে একটি সুগভীর জীবনােপলব্ধির কথাও তিনি পরিবেশন করেছেন। বঙ্কিম প্রতিভায় যেন এই উপন্যাসে ইতিহাসের কয়েকটি জীর্ণ পাতা সজীব ও মুখর হয়ে উঠেছে। ‘রাজসিংহ’ই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং লিখেছেন, “এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম।”
এর পর বঙ্কিমচন্দ্রের বহুবিশ্রত ত্রয়ী উপন্যাস আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) ও সীতারাম-এর (১৮৮৬) কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। এই তিনটি উপন্যাসই ইতিহাসে গৌণ; তত্ত্ব পরিবেশনই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে তিনি প্রধানতঃ গীতা বর্ণিত ‘নিষ্কাম’ কর্মের উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন।
‘আনন্দমঠ’-এর পটভূমিকা রচনা করেছে বাংলাদেশের ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঐতিহাসিক কাহিনী। এই বিদ্রোহের ঘটনাই উপন্যাসটিতে একটি সুগভীর রােমান্সরস সঞ্চারিত করে দিয়েছে। “ঘটনা ও সমাজ-শৃঙ্খলচ্যুত, বিপর্যস্ত জনসংঘের মনে বাস্তব প্রতিবেশের প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ জীবনযাত্রার অস্পষ্ট স্বপ্নছবি ভাসিয়া উঠিয়াছে তাহাই উপন্যাসের একমাত্র অবলম্বন। গ্রন্থের উপত্রমণিকায় নিবিড় অরণ্যের মধ্যে ভক্তি সাধনের আকুল প্রশ্ন যে দৈববাণী রূপ উত্তর মিলিয়াছে তাহাই উপন্যাসের মর্মকথা। উপন্যাসের সমস্ত পাত্র-পাত্রী এই সাধনার অঙ্গ ও উপকরণ মাত্র; তাহাদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব নাই। সন্তানধর্মের দীক্ষা তাহাদের পূর্ণনামের ন্যায় তাহাদের ব্যক্তিসত্তাকেও গ্রাস করিয়াছে।” কিন্তু এই প্রসঙ্গে উল্লেখনীয় যে সন্তানধর্মে দীক্ষিত জীবানন্দ-ভবানন্দের মধ্যে মানবসুলভ রূপমােহ ও প্রণয়বৃত্তিকে জাগ্রত করে বঙ্কিমচন্দ্র তাদের বেশ কিছুটা রক্তমাংসের মানুষ করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। তাই জীবানন্দ, মহেন্দ্র, শাস্তি, কল্যাণী উপন্যাসের ভূমিকায় জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্রন্থের মহাপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্রের ভাব-সাধনারই প্রতীক বলে মনে হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের যে বর্ণনা বঙ্কিমচন্দ্র দিয়েছেন তা যেমন সজীব তেমনি মর্মস্পর্শী। এই উপন্যাসটি ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতের দ্বারা বাঙলাদেশের অন্তরকে একটি জাতীয়তার মন্ত্রবাণীতে দীক্ষিত করেছিল।
তার পরবর্তী উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরাণী’তে (১৮৮৪) নিষ্কাম কর্মের গৌরব মহিমা নিয়েই কাহিনী বিস্তারলাভ করেছে। এই উপন্যাসেও তৎকালীন রাষ্ট্রগত বিশৃঙ্খলার পটভূমিকায় কহিনীর গঠনকর্মটি বঙ্কিমচন্দ্র সম্পন্ন করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তত্ত্বের একটি মূলকথা এই উপন্যাসে উচ্চারিত হয়েছে। হরবল্লভ, ব্রজেশ্বর, রঙ্গলাল, ব্রহ্মঠাকুরাণী, সাগর বৌ, নয়ান বৌ—তারা আমাদের একান্ত পরিচিত বলেই মনে হয়। এই উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য এই যে, নায়িকা প্রফুল্লকে বঙ্কিমচন্দ্র ভগবানের অবতার-স্বরূপ বলে বর্ণনা করতে চাইলেও তার ভিতরে যে একটি শাশ্বত নারীত্ব ছিল তা মাটির পৃথিবীকেই ধরে রয়েছে, দেবীত্বের মধ্যে নিজে রক্তমাসংগত প্রাণ-স্পন্দনটিকে হারিয়ে ফেলেনি। তাই প্রফুল্লকে কোন অবস্থাতেই বাঙলার সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
‘সীতারাম’ (১৮৮৬) বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রয়ী উপন্যাসের মধ্যে শেষতম উপন্যাস। তার পরে বঙ্কিমচন্দ্র কোন উপন্যাস রচনা করেন নি। এই উপন্যাসেও বঙ্কিমচন্দ্র কাহিনীর আবরণে ধর্মতত্ত্বের অবতারণা করেছেন। তার পটভূমিকা রচনা করেছে সীতারাম-নামক একজন হিন্দু রাজার মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনী। সংগ্রাম ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে এই হিন্দু রাজার উত্থানপতনের কাহিনী তাে আছেই, তা ছাড়া জীবনসংকটের বেদনাময় পরিস্থিতি এই উপন্যাসটিকেও মাটির পৃথিবীর সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। সীতারামের তিনজন স্ত্রী- শ্ৰী, নন্দা ও রমা। শ্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল বিয়ের ঠিক পরেই। কিন্তু এই শ্রীই ফিরে এলে সীতারাম তার রুপে উন্মাদ হয়ে গেলেন এবং তার অধঃপতনের মূলে এই শ্রীর রূপই কাজ করে গিয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাই সীতারামের অধঃপতনের মধ্যে একটি ধর্মতত্ত্বের সুস্পষ্ট প্রকাশ আছে বটে, কিন্তু অপরিতৃপ্ত রূপতৃষ্ণার সে সংযমহীনতা তা একান্তই মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সীতারামের পতনের মধ্যেও চিরন্তন মানসিক দিকটা বঙ্কিমের মহতী কল্পনায় এই উপন্যাসে উপেক্ষিত হয় নি। ধর্মতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা উপন্যাসকারের উদ্দেশ্য হলেও জীবনবােধের যে গভীরতা এই উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে তা উপন্যাস-রীতিকেই সার্থকতা দান করেছে।
Leave a comment