সূচনা: ইংরেজদের ইতিহাস দর্শন-সহ সামগ্রিকভাবে পাশ্চত্য ইতিহাস ভাবনা ও সমালােচনা ভারতীয় ঐতিহাসিকদের প্রভাবিত করে।

[1] হিন্দু চেতনাসম্পন্ন: জেমস মিল-সহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক‌ হিন্দুদের মধ্যে সত্যবাদিতার অভাব রয়েছে বলে সমালােচনা করেন। হিন্দুদের ওপর এই আক্রমণ রােধের লক্ষ্যে রাজনারায়ণ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দুধর্ম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। থিওসফিক্যাল সােসাইটি ও আর্যসমাজের প্রচেষ্টায় প্রাচীন হিন্দুধর্মের হত মর্যাদা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, বিনায়ক দামােদর সাভারকর ছাড়াও বেশ কিছু ঐতিহাসিক‌ রাজপুত মুসলিম দ্বন্দ্বের উল্লেখ করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস লেখেন।

[2] মুসলিম চেতনাসম্পন্ন: কর্নেল টডের ‘Annals and Antiq uities of Rajasthan’-কে তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে এক শ্রেণির ঐতিহাসিক রাজপুত-মুসলিম দ্বন্দ্বে, মুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করেন। তারাও তখন হিন্দু চেতনার এই প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসলামের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। স্যার সৈয়দ আহমেদের হাত ধরে যে মুসলিম চেতনার জাগরণ ঘটে তারই বাহক ছিলেন মৌলানা‌ সৌকৎ আলি, মহম্মদ আলি জিন্না প্রমুখ।

[3] আঞ্চলিক ইতিহাস

  • অন্যান্য আলিক ভাষার ইতিহাস: গােবিন্দ সখারাম সারদেশাই তিন খণ্ডে ‘নিউ হিস্ট্রি অব দ্য মারাঠাস’ নামে গ্রন্থটি লেখেন। মহম্মদ লতিফ রচনা করেন হিস্ট্রি অব দ্য পাঞ্জাব যাতে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাঞ্জাবের ইতিহাসের উল্লেখ মেলে। শ্যামল দাস হিন্দি ভাষায় পাঁচ খণ্ডে লেখেন ‘বীরবিনোদ নামে মেবারের ইতিহাস, যা রাজপুতদের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। রাজেন্দ্রলাল মিত্র দু-খণ্ডে রচনা করেন অ্যান্টিকুইটিজ অব ওড়িশা’, রামকৃষ্ণ গােপাল ভাণ্ডারকার লেখেন আর্লি হিস্ট্রি অব দ্য ডেকান’, যাতে তিনি প্রাচীনকাল থেকে মুসলমান বিজয় পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের ইতিহাস তুলে ধরেন। কে. ভি. কৃয়আয়ার তাঁর হিস্ট্রি অব কেরালা’ গ্রন্থে ঔপনিবেশিক পর্বের কেরালার ইতিহাস তুলে ধরেন।

  • বাংলা ভাষায় ইতিহাস: উনিশ শতকের একেবারে গােড়ার দিকে রামরাম বসু লেখেন প্রতাপাদিত্য চরিত এবং রাজীবলােচন মুখােপাধ্যায় লেখেন মহারাজা কৃয়চন্দ্র রায়স্য চরিত্রম, রামগতি ন্যায়রত্ন লেখেন বাংলার ইতিহাস প্রথম ভাগ, আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লেখেন বাংলার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দুখণ্ডে বাংলার ইতিহাস লেখেন। এ ছাড়াও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিপ্লবী রাশিয়া এবং বিনয় কুমার সরকার বর্তমান যুগে চিন সাম্রাজ্য নামে গ্রন্থ লেখেন। প্রবােধচন্দ্র বাগচী তিনখানি গ্রন্থ লেখেন যথা—‘ভারত ও মধ্য এশিয়া’, ‘ভারত ও ইন্দোচিন’ এবং ভারত ও চিন।

[4] অর্থনৈতিক ইতিহাস: দাদাভাই নওরােজি পভার্টি অ্যান্ড আন- ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে ভারতের দারিদ্র্যের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে দায়ী করেন। রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর দু-খণ্ডে রচিত ইকোনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে ব্রিটিশ অর্থনীতির শােষণমূলক দিকটি তুলে ধরেন। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির সমালােচনা করেন মহাদেব গােবিন্দ রাণাডে, অমলেশ ত্রিপাঠী, নরেন্দ্রকৃয় সিংহ, গােপাল কৃয় গােখলে, জি. ভি. যােশী ও কে. টি. তেলাং প্রমুখ।

[5] জাতীয়তাবাদী ইতিহাস: ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার উৎকর্ষ তুলে ধরে রমেশচন্দ্র দত্ত তিন খণ্ডে লেখেন ‘সিভিলাইজেশন ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া গ্রন্থটি। জাতীয় ইতিহাস গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য শশীভূষণ চৌধুরী রচিত ‘সিভিল ডিসটারবেন্স ডিউরিং ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার রচিত ‘হিস্ট্রি অ্যান্ড‌ কালচার অব দ্য ইন্ডিয়ান পিপল প্রভৃতি।

[6] সামাজিক ইতিহাস: ভারতীয় সমাজ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাণাডে রেলিজিয়াস অ্যান্ড সােশ্যাল রিফর্মস’, শিবনাথ শাস্ত্রী ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, সালাউদ্দিন আহমদ সােশ্যাল আইডিয়াস অ্যান্ড সােশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল’, নগেন্দ্রনাথ বসু বাংলার জাতীয় ইতিহাস’, দুর্গাদাস সান্যাল বাংলার সামাজিক ইতিহাস প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।

[7] সাংস্কৃতিক ইতিহাস: আচার্য ক্ষিতিমােহন সেন ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা ও ভারতের সংস্কৃতি গ্রন্থ লিখে সমন্বয়বাদী ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটান। প্রমথনাথ মুখার্জি ইতিহাস ও অভিব্যক্তি গ্রন্থটি রচনার মাধ্যমে সনাতন ভারতের ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে তুলে ধরেন ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির তুলনামূলক আলােচনা করেন। সুকুমার সেন বাংলা ও বাঙালী’ গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেন। সতীশচন্দ্র মিত্রের যশাের-খুলনার ইতিহাস’, নিখিলনাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আনন্দনাথ রায়ের ফরিদপুরের ইতিহাস’, বিজয়চন্দ্র মজুমদারের ঢাকার ইতিহাস’, অচ্যুতচরণ চৌধুরির শ্রীহট্টের ইতিহাস’, কৈলাসচন্দ্র সিংহের ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত’ প্রভৃতি গ্রন্থে ভারতের আঞ্চলিক সমাজচিত্র ধরা পড়ে।

উপসংহার: অতীতের উত্তরাধিকার ধারায় আজ এবং আগামীতেও দেশীয় ইতিহাস চর্চা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।