সূচনা: ইউরােপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি অষ্টাদশ শতক থেকে এশিয়া ও আফ্রিকার পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। ঔপনিবেশিক শাসকরা ছিল শ্বেতাঙ্গ জাতিভুক্ত এবং শাসিত উপনিবেশের বাসিন্দারা ছিল কৃয়াঙ্গ জাতিভুক্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শাসক শ্বেতাঙ্গ এবং শাসিত কৃয়াঙ্গদের মধ্যে বিস্তর জাতিগত ব্যবধান দেখা দেয়।

[1] জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব: উপনিবেশের কৃয়াঙ্গ প্রজাদের চেয়ে শাসক শ্বেতাঙ্গরা নিজেদের শ্রেষ্ঠতর বলে মনে করে। ইংরেজ কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং তাঁর ‘শ্বেতাঙ্গদের বােঝা’ (‘White man’s burden’) নামক কবিতায় বলেছেন যে, পশ্চাদপদ কৃয়াঙ্গদের সার্বিক উন্নতি ঘটানাে শ্বেতাঙ্গদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

[2] অবজ্ঞা: শাসক শ্বেতাঙ্গরা উপনিবেশের শাসিত কৃয়াঙ্গদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার চোখে দেখত। কোনাে কোনাে ঔপনিবেশিক শহরে শ্বেতাঙ্গ ও কৃয়াঙ্গদের বসবাসের জন্য পৃথক অঞ্চলও চিহ্নিত করা হয়। ভারতীয় উপনিবেশে শ্বেতাঙ্গদের কোনাে কোনাে ক্লাব ও রেস্তোরার প্রবেশপথে লেখা থাকত ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। রুডইয়ার্ড কিপলিং ভারতীয়দের ‘Half-devil and half-child’ বলে অভিহিত করেছেন।

[3] বিভেদ: উপনিবেশের শ্বেতাঙ্গ শাসকগােষ্ঠী উপনিবেশগুলিতে বসবাসকারী ইউরােপীয় শ্বেতাঙ্গ ও স্বদেশীয় কৃয়াঙ্গদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিভেদ সৃষ্টি করেছিলেন। ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, রেলগাড়ি, সরকারি অফিস-আদালতেও কৃয়াঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের সমান মর্যাদা পেত না। তাছাড়া সামাজিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে উপনিবেশের মানুষদের মধ্যেও নানা বিভেদ সৃষ্টি করা হয়।

[4] দাসত্ব: শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে কৃয়াঙ্গদের ক্রীতদাসে পরিণত করে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। পরবর্তীকালে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ হওয়ার পরও শ্বেতাঙ্গদের দাসত্ব করতে বহু কৃয়াঙ্গ বাধ্য হয়।

[5] চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক: ইউরােপীয় শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা ভারত, চিন প্রভৃতি উপনিবেশগুলি থেকে বহু দরিদ্র চুক্তিভিত্তিক শ্রমিককে আফ্রিকা-সহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে বিভিন্ন শ্রমসাধ্য কাজে নিয়ােগ করে। বিদেশে তারা চরম দুর্দশার শিকার হয়। অনেকে আত্মীয়স্বজনকে হারিয়ে চিরদিনের মতাে বিদেশেই থেকে যায় এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়।

[6] জাতিগত দ্বন্দ্ব: শ্বেতাঙ্গদের শােষণ ও অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন উপনিবেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃয়াঙ্গরা শাসক সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। এই দ্বন্দ্বে শ্বেতাঙ্গরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চালিয়ে কৃয়াঙ্গদের বিদ্রোহ দমন করে। জামাইকা উপনিবেশে এরূপ জাতিগত বিদ্বেষ ও শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নির্যাতন অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠেছিল।

[7] শােষণ: শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি উপনিবেশের অর্থসম্পদ শােষণ করে কৃয়াঙ্গদের ওপর বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক শােষণ চালায়। তারা উপনিবেশগুলি থেকে বিভিন্ন কাঁচামাল খুব সস্তায় সংগ্রহ করে নিজ দেশে রপ্তানি করে শিল্পের বিকাশ ঘটায় এবং নিজেদের শিল্পজাত সামগ্রী উপনিবেশের বাজারগুলিতে রপ্তানি করলে। ঔপনিবেশিক বাসিন্দাদের কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়। ফলে উপনিবেশে বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক দুর্দশা বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার: উপনিবেশের কৃয়াঙ্গ জাতির ওপর শাসক শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক শােষণ-নির্যাতনের ফলে নির্যাতিত কৃয়াঙ্গরা শাসক শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে এই সংগ্রাম প্রবল হয়ে ওঠে। এর পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইউরােপীয় শ্বেতাঙ্গদের শাসন ও শােষণ থেকে মুক্তি পেয়ে কৃয়াঙ্গ উপনিবেশগুলি একে একে স্বাধীনতা লাভ করতে শুরু করে।