সূচনা: ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে রেলযােগাযােগ স্থাপিত হয়। এই সময়কালে ভারতে রেলপথের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে চারটি পৃথক পর্যায় লক্ষ করা যায়, যথা一

  • [1] গ্যারান্টি ব্যবস্থা, 

  • [2] সরকারি উদ্যোগ, 

  • [3] পুনরায় ‘গ্যারান্টি ব্যবস্থা’, 

  • [4] পুনরায় সরকারি উদ্যোগ।

[1] গ্যারান্টি ব্যবস্থা: ভারতে রেলপথ নির্মাণে কোম্পানিগুলিকে উৎসাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার কয়েকটি বিষয়ে কোম্পানিগুলিকে গ্যারান্টি বা প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ব্যবস্থা গ্যারান্টি ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

  • গ্যারান্টি ব্যবস্থার শর্ত: গ্যারান্টি ব্যবস্থার প্রধান শর্তগুলি ছিল- [a] সরকার কোম্পানিগুলিকে রেলপথ নির্মাণের জন্য বিনামূল্যে জমি দেবে। [b] কোম্পানিগুলির বিনিয়ােগ করা মূলধনের ওপর বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে সুদ দেবে। [c] সুদ পরিশােধের পর লভ্যাংশ সরকার ও কোম্পানির মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে। [d] সরকার ইচ্ছা করলে ২৫ বা ৫০ বছর পর রেলপথগুলি ক্রয় করতে পারবে।

  • গ্যারান্টি ব্যবস্থার প্রয়ােগ: সরকারি গ্যারান্টি পাওয়ার পর ৮টি ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে রেলপথ স্থাপনে মূলধন বিনিয়ােগ করে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ৪,২৫৫ মাইল রেলপথ নির্মিত হয়।

  • দুর্নীতি: লাভের গ্যারান্টি থাকায় কোম্পানিগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক বেশি খরচ করতে থাকে এবং তাদের বার্ষিক হিসাবে প্রচুর ঘাটতি দেখায়। এর ফলে এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

[2] সরকারি উদ্যোগ: ‘গ্যারান্টি ব্যবস্থায়’ নানা ত্রুটি দেখা দেওয়ায় সরকার এই ব্যবস্থা বাতিল করে নিজের হাতে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। সরকারি উদ্যোগে ১৮৬৯ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বেশ কিছু রেলপথ নির্মিত হয়। এর ফলে কোম্পানিগুলির মুনাফা লাভের পথ বন্ধ হয়। তারা পার্লামেন্টে সরকারি উদ্যোগে রেলপথ নির্মাণ বন্ধের দাবি জানায়। এই সময় ভারতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধের (১৮৭৮-১৮৮০ খ্রি.) ফলে সরকারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সরকারি উদ্যোগে রেলপথ নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।

[3] পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা: রেলপথ নির্মাণের জন্য ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা চালু হয়।

  • নতুন গ্যারান্টি ব্যবস্থার নীতি: [a] রেলপথ নির্মাণ পরিকল্পনার দায়িত্ব থাকে সরকারের হাতে। কোম্পানিগুলিকে শুধু রেলপথ নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। [b] পূর্ববর্তী পাঁচ শতাংশের পরিবর্তে বর্তমান ব্যবস্থায় সাড়ে তিন শতাংশ সুদের গ্যারান্টি দেওয়া হয়।

  • রেলপথের প্রসার: এই ব্যবস্থায় কোম্পানিগুলি প্রচুর লাভবান হয়। তবে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে প্রায় ২৮ হাজার মাইল রেলপথ নির্মিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে রেলের উন্নয়ন কিছুটা ব্যাহত হয়।

  • রেল বাের্ড গঠন: ভারতীয় রেল ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে রেল বাের্ড গঠিত হয়। এর ফলে রেল ব্যবস্থা আরও সম্প্রসারিত হয়।

  • অ্যাকওয়ার্থ কমিটি: রেলপথের সম্প্রসারণ ও রেল প্রশাসন সংস্কারের উদ্দেশ্যে স্যার উইলিয়াম অ্যাকওয়ার্থ-এর সভাপতিত্বে অ্যাকওয়ার্থ কমিটি (১৯২১ খ্রি.) নামে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি নিযুক্ত হয়। এই কমিটি রেলপথের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রতি পাঁচ বছরে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়ােগ, পৃথক বাজেট, সরকারি নিয়ন্ত্রণে রেলপথ নির্মাণ প্রভৃতি প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সরকার তখন এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।

[4] পুনরায় সরকারি উদ্যোগ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮ খরি.) সময় থেকে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ রেল ব্যবস্থায় বেসরকারি উদ্যোগ, ভারতীয় যাত্রীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, ভারতীয় পণ্যের ওপর বাড়তি মাশুল প্রভৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। এই অবস্থায় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সরকার কয়েকটি রেল কোম্পানির দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। রেল বাের্ড পুনর্গঠিত হয় এবং পৃথক রেল বাজেট তৈরি হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মূলত এই ব্যবস্থাই কার্যকর ছিল।

উপসংহার: রেলপথের মাধ্যমে দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটেছিল, আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ সম্ভব হয়েছিল এবং কর্মসংস্থানের সুযােগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে রেলপথের দ্বারা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে ব্রিটিশদের শােষণের শিকড় ছড়িয়ে পড়েছিল।