চোল বংশ:

চোল রাজবংশের উত্থান দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেবল রাজনৈতিক সংহতি নয়, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রেও চোল রাজাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।

আদি-মধ্যযুগে ভারতের রাজবংশগুলির মধ্যে চোল বংশ অন্যতম। অশোকের লেখায়, পেরিপ্লাসে, টলেমীর রচনায়, মহাবংশে চোলগণের উল্লেখ আছে। আনুমানিক দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে চোলরাজ কারিকল পেনার ও ভেলার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে চোল-শাসনের সূচনা করেন। কিন্তু চের, পাণ্ড্য ও পল্লবদের ক্রমাগত আক্রমণে এক শতকের মধ্যেই চোলরাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। চোলগণ চালুক্য বা পল্লবদের সামন্ত নৃপতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলে। নবম খ্রিস্টাব্দে পল্লববংশের পতন শুরু হলে বিজয়ালয়ের নেতৃত্বে চোলবংশের পুনরুভ্যুত্থান ঘটে।

বিজয়ালয় (৮৫০-৮৭১ খ্রিঃ) ছিলেন পল্লবরাজা নৃপতুঙ্গের অধীন সামন্ত নৃপতি। পল্লবরাজের হয়ে তিনি তাঞ্জোর অধিকার করেন। তাঁর পুত্র প্রথম আদিত্যও (৮৭১-৯০৭ খ্রিঃ) পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে শ্রীপুরামবিয়ামের যুদ্ধে পল্লবরাজাকে সাহায্য করেন। পরিবর্তে পল্লবরাজ অপরাজিত বর্মন তাঞ্জোরের ওপর আদিত্যের অধিকার স্বীকার করে নেন। এইভাবে শক্তিশালী হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত অপরাজিত বর্মনকে পরাস্ত করেন ও সমগ্র পল্লবরাজ্য নিজে অধিকারভুক্ত করেন। গঙ্গরাজ তাঁর আধিপত্য মেনে নেন। এইভাবে তিনি ক্ষুদ্র চোলরাজ্যকে এক সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। পরবর্তী রাজা প্রথম পরাস্তক দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছিলেন (৯০৭-′৫৩ খ্রিস্টাব্দ)। পাণ্ড্যরাজ দখল করে তিনি চোল রাজ্যসীমা কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। রাষ্ট্রকুটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণকে তিনি বল্লালের যুদ্ধে পরাস্ত করেন। কিন্তু তাঁর রাজত্বের শেষদিকে রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় কৃষ্ণ রাজরাজ সিংহাসনে বসার পূর্ববর্তী তিরিশ বছর অযোগ্য রাজাদের অধীনে চোলবংশ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর রাজরাজ সিংহাসনে বসলে চোলবংশের প্রকৃত গৌরবের সূচনা হয়।

প্রথম রাজরাজ (৯৮৫-১০১৪ খ্রি:) :

প্রথম রাজরাজ ছিলেন চোলবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। তাঁর নেতৃত্বে চোলরাজ্য একটি বৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় চোলরাজ্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ‘তাঞ্জোর লিপি’ থেকে তাঁর সামরিক কৃতিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। তিনি পাণ্ড্যগণকে পরাজিত করেন। ফলে মাদুরা তাঁর অধিকারে আসে। তিনি কেরলদেরও পরাজিত করেন। রাজরাজ ছিলেন প্রকৃতই সাম্রাজ্যবাদী শাসক। তাই তিনি স্থলযুদ্ধের পাশাপাশি জলযুদ্ধের প্রকৃত গুরুত্বও উপলব্ধি করেন ও একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন। এই নৌবহরের প্রথম সাফল্য হল ত্রিবান্দমের নৌযুদ্ধে চের নৌবাহিনীর ধ্বংসসাধন। রোমিলা থাপারের মতে, রাজরাজ কেরল ও চেরদের বিরুদ্ধে অভিযান করেছিলেন। এইজন্য তারা মালাবার উপকূলে আগত আরব বণিকদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। রাজরাজ আরবদের অগ্রগতি রুদ্ধ করার জন্য কেরল নিজ অধিকারভুক্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর সুগঠিত নৌবহরের সাহায্যে সিংহলেও অভিযান করেন। সিংহলরাজ পঞ্চম মহেন্দ্র রাজরাজার কাছে পরাস্ত হন ও সিংহলের দক্ষিণ পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নেন। রাজরাজ রাজধানী অনুরাধাপুর বিধ্বস্ত করেন ও চোল অধিকৃত ভূখণ্ডের রাজধানী স্থাপন করেন পোলন্নরুবতে। এখানে তিনি শিবমন্দিরও নির্মাণ করেন। এ ছাড়া রাজত্বের শেষের দিকে তিনি মালদ্বীপ জয় করেন। এই সিংহল জয় ও মালদ্বীপ জয় তাঁর সুগঠিত নৌবাহিনীর সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাজরাজ গঙ্গ ও চালুক্যগণের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। তুঙ্গভদ্রার অপর পারে অভিযান চালিয়ে তিনি গঙ্গরাজ্য মহীশুর অধিকার করে নেন। পূর্ব-উপকূলে রাজত্বকারী পূর্ব চালুক্যদের রাজধানী ‘বেঙ্গী’ অধিকার করে তিনি নিজ প্রতিনিধি বিমলাদিত্যকে সেখানকার সিংহাসনে বসান। বেঙ্গীতে চোলদের এই ক্ষমতাবৃদ্ধিতে আশঙ্কিত পশ্চিম চালুক্যরাজ সত্যাশ্রয় বেঙ্গী আক্রমণ করেন। সত্যাশ্রয়ের বিরুদ্ধে সমরাভিযান পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় যুবরাজ রাজেন্দ্রকে। রাজেন্দ্র বনগসি ও রাইচুর দোয়ারের অনেকাংশ নিজ অধিকারে আনেন ও মান্যখেড ভস্মীভূত করেন। এই অবস্থায় সত্যাশ্রয় বেঙ্গী থেকে সৈন্য প্রত্যর্পণে বাধ্য হন। এইভাবে সারা রাজত্বকাল ব্যাপী সমরাভিযানের দ্বারা রাজরাজ মাদুরা, অন্ধ্র, মহীশুর ও কুর্গের কিয়দংশ, উত্তর সিংহল-সহ বেশ কিছু দ্বীপে চোল-আধিপত্য প্রসারিত করেছিলেন।

রাজরাজ চোল কেবল সাম্রাজ্য-সংগঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সুশাসকও। শিল্প, স্থাপত্য ও সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। তিনি ছিলেন শৈব ধর্মাবলম্বী। তাঞ্জোরের সুবিখ্যাত রাজরাজেশ্বর মন্দির তাঁরই উল্লেখযোগ্য কীর্তি। তবে তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাবান ছিলেন। কারণ সুমাত্রার রাজা শ্রীবিজয় তাঁর অনুরোধেই মেগাপতমে বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেছিলেন। রাজত্বের শেষ দু-বছর (১০১২-১০১৪ খ্রিঃ) তিনি পুত্র রাজেন্দ্রের সাথে যুগ্মভাবে শাসন পরিচালনা করেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন চোলবংশের এক ‘মহান’ শাসক।

রাজেন্দ্র চোল (১০১৪-১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ) :

প্রথম রাজেন্দ্র ছিলেন চোলবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি। কন্যাকুমারী, মহেন্দ্রগিরি ও সুত্তুর অঞ্চলে প্রাপ্ত লিপিসমূহ থেকে তাঁর সামরিক কীর্তির কথা জানা যায়। সিংহাসনে বসেই তিনি পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে অগ্রসর হন এবং একাধিক সামরিক সাফল্যের দ্বারা চোল-শক্তিকে অপ্রতিহত করে তোলেন। রাজত্বের পঞ্চম বৎসরে সিংহল অভিযানের মাধ্যমে তিনি রাজ্যজয়ের সূচনা করেন। অবশ্য রাজরাজের রাজত্বকালে তিনি বহু সফল সমরাভিযানে নেতৃত্ব দেন। যাইহোক্, মহাবংশ থেকে তাঁর সিংহল অভিযানের বর্ণনা পাওয়া যায়। জানা যায় যে, তিনি রাজা পঞ্চম মহেন্দ্রকে বন্দি করেছিলেন। সমগ্র সিংহল তাঁর পদানত হয়েছিল। সিংহলকে তিনি একটি চোল-প্রদেশে পরিণত করেন। নৌ-অভিযানের ক্ষেত্রে সিংহল বিজয়ই তাঁর একমাত্র সাফল্য ছিল না। তিনি শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্য শ্রীবিজয়ের (মালয় উপদ্বীপ, সুমাত্রা, যবদ্বীপ) বিরুদ্ধেও নৌ-অভিযান প্রেরণ করেন। শৈলেন্দ্ররাজ বিজয় তুঙ্গবর্মন রাজেন্দ্রের নিকট পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন। অবশ্য এরপর তাঁকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই বিজয়ের ফলে চিনের সাথে ভারতের বাণিজ্যপথের অন্তরায় দূর হয়।

‘তিরুবালাঙ্গারু পট্ট’ থেকে তাঁর রাজ্যজয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। রাজত্বের ষষ্ঠ বৎসরে দিগ্বিজয়ে বের হয়ে তিনি পাণ্ড্য ও কেরলদের ওপর নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর নিজপুত্রের হাতে রাজ্যগুলির শাসনভার অর্পণ করেন। তাঁর পরবর্তী সংগ্রাম ছিল পশ্চিম চালুক্যরাজ জয়সিংহের সাথে। বেঙ্গীর সিংহাসনের উত্তরাধিকারের প্রশ্নে উভয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। বিমলাদিত্যের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র বিজয়াদিত্য ও রাজরাজ উভয়েই সিংহাসন দাবি করতে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে জয়সিংহ বিজয়াদিত্যের পক্ষ নেন। অন্যদিকে রাজরাজার পক্ষ নেন রাজেন্দ্র, কারণ রাজরাজ ছিলেন চোলরাজ মহান রাজরাজার কন্যা কুন্দভাকের পুত্র। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়সিংহই শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন ‘মাস্কির যুদ্ধে’। চোলদের অপর এক বাহিনী বেঙ্গীতে উপস্থিত হয়ে বিজয়াদিত্যকে হটিয়ে রাজরাজকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে। মাস্কির যুদ্ধের পর রাজেন্দ্র কলিঙ্গ অভিমুখে অগ্রসর হন। কারণ কলিঙ্গরা জয়সিংহকে সাহায্য করেছিলেন। যথারীতি কলিঙ্গরাজ রাজেন্দ্রের কাছে পরাস্ত হন।

কলিঙ্গজয়ের পর রাজেন্দ্রর সেনা আরও উত্তরে অগ্রসর হয়। এই উত্তর ভারত অভিযানের বর্ণনা পাওয়া যায় তিরুমলয় লেখ’ থেকে। এই অভিযানে সময় লেগেছিল দু-বছর (১০২১-‘২৩ খ্রিঃ) এবং সাম্রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্য নিয়ে এই অভিযান পরিচালিত হয়নি। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল পবিত্র গঙ্গাজল সংগ্রহ। পূর্ববঙ্গের শাসক গোবিচন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গের মহীপাল ও দক্ষিণবঙ্গের রণশুর চোল বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। এই অভিযানের মাধ্যমে উত্তর ভারত, দক্ষিণের এক প্রবল সাম্রাজ্যিক শক্তির পরিচয় পায়। এই অভিযানের সাফল্যের পর রাজেন্দ্র ‘গঙ্গাইকোণ্ড চোল’অর্থাৎ ‘গঙ্গাবিজেতা’ উপাধি নেন এবং কাবেরী নদীর তীরে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। এর নাম হয় ‘গঙ্গাইকোও চোলপুরম্’।

রাজেন্দ্রর রাজত্বের শেষদিকে পাণ্ড্য ও কেরলগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সম্ভবত রাজত্বের অত্তিমভাগে তিনি পশ্চিম চালুক্যগণের সাথেও সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সম্ভবত, চালুক্যদের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতে রাজেন্দ্রর মৃত্যু হয় (১০৪৪ খ্রিঃ)।

পরবর্তী চোল রাজাগণ :

প্রথম রাজেন্দ্রর মৃত্যুর পর চোল সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি শুরু হয়। তাঁর পুত্র প্রথম রাজাধিরাজ (১০৪৪-১০৫৪ খ্রিঃ) চের, চালুক্য ও পাণ্ড্য রাজ্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। সিংহলের বিরুদ্ধেও তিনি অভিযান প্রেরণ করেন। পরবর্তী শাসক দ্বিতীয় রাজেন্দ্র ১০৫৪ থেকে ১০৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন চালান। রাজাধিরাজের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য নৃপতি ছিলেন বীররাজেন্দ্র (১০৬২ ১০৭০ খ্রিঃ)। তিনি চালুক্যদের বিরুদ্ধে স্মৃতিস্বরূপ তুঙ্গভদ্রার তীরে একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। চোল নৃপতি কুলোতুঙ্গের রাজত্বকালে (১৯৭০-১১২০ খ্রিঃ) চোল-চালুক্য সংঘর্ষ কিছুটা কমেছিল। কারণ তাঁর মহিযী ছিলেন চালুক্য রাজকন্যা। অবশ্য পরবর্তী শাসকদের আমলে চোল চালুক্য সংঘর্ষ আবার বৃদ্ধি পেয়েছিল। এতদ্‌সত্ত্বেও দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত চোলশক্তি টিকেছিল। ইতিমধ্যে যাদব ও কাকতীয় বংশ দক্ষিণ ভারতে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। তাদের আক্রমণে শেষ পর্যন্ত চোল-শাসনের অবসান ঘটে।