প্রশ্নঃ হযরত ওসমান (রা)-এর চরিত্র ও কৃতিত্ব আলােচনা কর।

অথবা, ইসলামের সেবায় খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর অবদান আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ ইসলামী খেলাফতের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা) পূর্ববর্তী খলিফাদের ন্যায় কঠোর না হলেও বিদ্রোহ অরাজকতা দমন এবং বিভিন্ন জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদনে তার কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। তাই জার্মান ঐতিহাসিক ওয়েল হাউসেন বলেন- The murder of Othman was more epochmaking than almost any other event of Islamic History.

হযরত ওসমান (রা)-এর চরিত্রঃ উন্নত ও মহৎ চরিত্র বলতে যা বুঝায় তার সবটুকু ছিল ওসমান (রা)-এর মধ্যে। তিনি জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বপর্যায়ে একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তার চারিত্রিক শােভা ছিল নিম্নরূপ-

১. জাহেলিয়াত বিমুক্তঃ জাহেলী যুগেও ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা)-কে কোনাে কুসংস্কার, অমানবিকতা, অনৈতিকতা স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি জাহেলী যুগে বিরাজমান যাবতীয় কুসংস্কার ও কুচরিত্র থেকে বিমুক্ত ছিলেন।

২. পূর্ণ লজ্জাশীলতাঃ খলিফা হযরত ওসমান (রা) ছিলেন সর্বাধিক লজ্জাশীল ব্যক্তি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) হযরত ওসমান (রা)-এর প্রসঙ্গে বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক লজ্জাশীল ব্যক্তি হচ্ছে ওসমান ইবনে আফফান। তার অন্যতম উপাধি ছিল “পরিপূর্ণ লজ্জাশীল”।

৩. খাঁটি ঈমানদারঃ হযরত ওসমান (রা)-এর চরিত্রের অন্যতম শােভা ছিল তার ঈমানে কোনাে খাদ ছিল না। তিনি সর্বদা ঈমানের ওপর অবিচল থেকেছেন। তাই তার বিশেষ উপাধি ছিল ” পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী”।

৪. মহানবীর সন্তোষজনক সংবাদঃ ওসমান (রা) ছিলেন প্রথম অগ্রগামী ঈমানদার (আস সাবিকুনাল আউয়ালুন), জান্নাতের দশ সুসংবাদপ্রাপ্তের একজন (আশরায়ে মুবাশশারাহ) এবং সেই বিশিষ্ট ছয় জনের অন্যতম, যাদের প্রতি রাসূল (স) আমৃত্যু সন্তুষ্ট ছিলেন।

৫. অধিক নম্রতাঃ লজ্জাশীলতা, নম্রতা, ন্যায়পরায়ণতা, দানশীলতা ও মহানুভবতা ছিল হযরত ওসমান (রা)-এর উল্লেখযােগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি ছিলেন, অত্যন্ত বিনয়ী ও কোমল স্বভাবের, যা খেলাফত পরিচালনায় তার ব্যর্থতার কারণ হয়ে দেখা দেয়। অপরাধীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি বিধান করতে অনেক সময় তাঁর কোমল হৃদয় বিগলিত হয়ে যেত।

৬. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাঃ তিনি সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরতেন, কিন্তু তার মূল্য বেশি হতাে না।

৭. জনকল্যাণে সম্পদ ব্যয়ঃ হযরত ওসমান (রা) নিজের সব সম্পদ জনকল্যাণে ব্যয় করেন। ঐতিহাসিক তাবারী (রা)-এর মতে, তিনি দুটি উট রেখে বাকি সকল সম্পদ জনকল্যাণে ব্যয় করেছেন।

৮. দাস মুক্ত করাঃ হযরত ওসমান (রা) তার নিজস্ব সম্পদ ব্যয় করে দু’হাজার দাস মুক্ত করেছেন।

৯. দানশীলতাঃ হযরত ওসমান (রা) অকাতরে আল্লাহর রাস্তায় দান করে গেছেন। তাবুক যুদ্ধে তিনি দশ হাজার সৈন্যের খরচ বহন করেছেন। এ ছাড়া ১,০০০ উট, ৭০টি ঘােড়া, ১০০০ দিনার রাসূলের দরবারে পেশ করেন। এতে রাসূল (স) খুব খুশি হয়ে বলেন, আজকের দিনের পর ওসমান যে আমলই করুক না কেন কোনাে আমলই তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।

১০. স্ত্রীর সেবাশুশ্রূষাঃ হযরত ওসমান (রা) তার স্ত্রীর অসুস্থাবস্থায় সেবাশুশ্রষার জন্য বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হননি। তার এ মহৎ কম ও দায়িত্বশীলতার জন্য রাসূল (স) তাকে বদর যােদ্ধা হিসেবে গণ্য করে গনীমতের অংশীদার করেন।

১১. অনাড়ম্বর জীবনযাপনঃ হযরত ওসমান (রা) অতি সহজ সরল, অনাড়ম্বর ও পবিত্র জীবনযাপন করতেন। অগাধ সম্পদ এবং বিশাল সাম্রাজ্যের কর্ণধার হয়েও তিনি সাধারণ লােকের ন্যায় কালাতিপাত করতেন।

১২. সরলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতাঃ হযরত ওসমান (রা)-এর মতাে এত সহজ সরল, উদার ও সহিষ্ণ ব্যক্তি জগতে আরেকজন খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও তিনি সহিষ্ণুতা ও ধৈর্যকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

১৩. সমসাময়িক সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বঃ হযরত আবু বকর ও ওমর (রা)-এর পরে অতুলনীয় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন হযরত ওসমান (রা)। এ কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন হযরত ওসমান (রা)।

১৪. জনকল্যাণকামীঃ হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফতকালে বহু জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদিত হয়েছে। তিনি বহু মসজিদ, মাদরাসা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন।

১৫. মহানুভব রাষ্ট্রপ্রধানঃ হযরত ওসমান (রা) মাত্রাতিরিক্ত কোমলতা ও মহানুভবতার অধিকারী ছিলেন বিধায় দুর্দমনীয় আরবদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। সম্ভবত এজন্য স্বার্থপর আত্মীয় এবং কুচক্রীরা তার অমঙ্গল সাধনে সক্ষম হয়েছিল।

১৬. ধর্মনিষ্ঠাঃ হযরত ওসমান (রা) ইসলামী জীবনযাত্রার দিক থেকে ছিলেন রাসূল (স)-এর প্রতিচ্ছবি। তিনি সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন। রাসূল (স) কর্তক বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ জনের মধ্যে ওসমান (রা) অন্যতম। কথিত আছে, তিনি প্রতি শুক্রবার একজন ক্রীতদাস আযাদ করতেন।

ওসমান (রা)-এর কৃতিত্ব/অবদানঃ

১. সপরিবারে প্রথম হিজরতকারীঃ হযরত ওসমান (রা) তার স্ত্রীসহ প্রথমে আবিসিনিয়ায় হিজরত করলে রাসূল (স) মন্তব্য করেন, ওসমান এ উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম সপরিবারে হিজরতকারী।

২. বহুসংখ্যক কৃপ ওয়াকফকারঃ হযরত ওসমান (রা) বিরে রুমা, বিরে সাবিসহ বহুসংখ্যক কূপ ক্রয় এবং খনন করে মদনাবাসীর জন্য ওয়াকফ করে দেন। এর বিনিময়ে রাসূল (স) তাকে জান্নাতের আগাম সুসংবাদ দেন।

৩. তাবুক যুদ্ধে সর্বাধিক দানঃ তাবুক যুদ্ধে ১০ হাজার সৈন্যের ব্যয়ভার গ্রহণ ছাড়াও যুদ্ধের জন্য তিনি এক হাজার উট, সত্তরটি ঘােড়া এবং এক হাজার দীনার দান করেন।

৪ অহী লেখকঃ প্রথমে হযরত ওসমান (রা) ছিলেন অহী লেখক। নবী করীম (স)-এর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী লেখার দায়িত্ব তার ওপরই ন্যস্ত ছিল।

৫. পরামর্শদাতা ও মুফতিঃ হযরত আবু বকর ও ওমর (রা)-এর শাসনামলে হযরত ওসমান (রা) খেলাফতের একজন পরামর্শদাতা এবং শরীয়া বাের্ডের একান্ত মুফতি ছিলেন।

৬. বিদ্রোহ দমনঃ হযরত ওসমান (রা) ক্ষমতা গ্রহণ করেই পারস্য সম্রাট ৩য় হয়াজদেজর্দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে দমন করেন। তাছাড়া জান বিভিন স্থানে যে সকল গােলযােগ দেখা দেয়, সেগুলাে কঠোর হস্তে দমন করতে তিনি। সক্ষম হন।

৭.সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, তার সময়ে যে সকল নতুন এলাকায় ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয় সেগুলাের মধ্যে কেরমান, জুরজান, খােরাসান, হিরাত, কাবুল, গজনী, সািজস্তান, মাকরান, খাওয়ারেজম, ত্রিপােলী প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।

৮. নৌবাহিনী গঠনঃ হযরত ওসমান (রা)-এর আমলে সর্বপ্রথম মুসলিম নৌবাহিনী গঠিত হয়। তার ফেলাফতে আবদুল্লাহ ইবনে কায়স ছিলেন প্রথম আরব নৌ অধ্যক্ষ। কথিত আছে, তিনি রােমানদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০টি নৌ অভিযান পরিচালনা করেন। রােমানরা তার ভয়ে সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত। তিনি তাদের নিকট থেকে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ রােডস ও সাইপ্রাস দখল করেন।

৯. ক্রীতদাস মুক্তিঃ ঐতিহাসিক মুইর বলেন, দাসদের সামাজিক দুর্দশা হযরত ওসমান (রা)-কে সর্বদা ব্যথিত করে রাখত। তাই তিনি বহু অর্থ ব্যয়ে প্রায় দু’হাজার ক্রীতদাস খরিদ করে মুক্ত করে দেন।

১০. কাবাগৃহের সংস্কারঃ খলিফা হযরত ওমর (রা)-এর আমলে কাবাগৃহের যে সংস্কার কার্য শুরু হয়েছিল, খলিফা হযরত ওসমান (রা) কৃতিত্বের সাথে তা সমাধা করেন।

১১. মদিনার মসজিদের সম্প্রসারণঃ হযরত ওসমান (রা) ব্যক্তিগত উদ্যোগে কারুকার্য খচিত করে মদিনার মসজিদের শ্রীবৃদ্ধি করেন। তাছাড়া মসজিদটি সংস্কার করে কাঠের ছাদ ও প্রস্তরের স্তম্ভ সংযােজন করেন এবং মসজিদে নববীর পূর্বের দৈর্ঘ্য ছিল ১৪০ গজ আর প্রস্থ ছিল ১২ গজ। খলিফা তা সম্প্রসারণ করে যথাক্রমে ১৬০ গজ ও ১৫০ গজে উপনীত করেন।

১২. স্থাপত্যশিল্পে অবদানঃ ওসমান (রা)-এর সময়ে স্থাপত্য শিল্পে ব্যাপক অগ্রগতির দ্বার সূচিত হয়। জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য তিনি বাঁধ, পয়ঃপ্রণালী, মসজিদ, মক্তব, মাদরাসা, রাস্তাঘাট, সরাইখানা প্রভৃতি নির্মাণ করেন। মাহফুজা নামক বাধ নির্মাণ করে তিনি মদিনা নগরীকে প্লাবন থেকে রক্ষা করেন।

১৩. আল কুরআন সংকলনঃ হযরত ওসমান (রা)-এর অন্যতম কৃতিত্ব ছিল পবিত্র কুরআনের ধারাবাহিক সংকলন। কুরআনের নির্ভুল সংকলন ও সংরক্ষণ ইসলামের ইতিহাসে তার এক অক্ষয় কীর্তি। তিনি কুরআন পাঠে গরমিল ও পার্থক্য লক্ষ্য করে একটি কমিটি গঠন করেন এবং একটি নির্ভুল সংকলন প্রকাশ করে ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রেরণ করেন। অন্যথায় কুরআন বিকৃত হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। সঙ্গত কারণে তিনি নাজরানের যিম্মীদের রাজস্ব সামান্য হ্রাস করেন এবং ফাদাকের রাজস্ব পথচারীদের মধ্যে ব্যয় করেন।

১৪: অর্থনৈতিক সংস্কারঃ ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফতকালের শেষার্ধ অশান্ত গােলযােগপূর্ণ হলেও তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। বিশেষত হযরত ওমর (রা) কর্তৃত্ব গৃহীত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেন।

১৫. অংক ও ফারায়েয জ্ঞানঃ হযরত ওসমান (রা) অংকশাস্ত্র ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন সংক্রান্ত ফারায়েযশাস্ত্রে ব্যাপক জ্ঞান থাকায় ভূমি বণ্টনে অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

১৬. খেলাফতী কৃতিত্বঃ খলিফা ওসমান (রা)-এর গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু অর্থব্যবস্থা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি ইসলাম প্রচার, দারিদ্র বিমােচন ও নৈতিক মানােন্নয়নের জন্য বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

১৭. ইসলাম প্রচারঃ তিনি ইসলাম প্রচার প্রসারেও ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

১৮. সুশাসকঃ ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন, শাসন পদ্ধতির ক্ষেত্রে তিনি পূর্ববর্তী সুযােগ্য খলিফাদের নীতি অনুসরণ করেন। তার খেলাফতেও মজলিসে শূরার পরামর্শক্রমে সব ব্যাপার ফয়সালা করা হতাে। তার খেলাফতকালে রাজস্ব বিভাগ, কষি বিভাগ ইত্যাদির প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তিনি অনাথ, আতুর, বিধবা, গরিব ও অসহায়দের প্রতি বিশেষ সুদৃষ্টি রাখতেন।

উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলােচনায় প্রতীয়মান হয়, ইসলামের ইতিহাসে খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর অবদান নিঃসন্দেহে চির স্মরণীয়। তাই ঐতিহাসিক বার্নার্ড লুইস বলেন- The slaying of a caliph by rebellious Muslims established a mournful precedent and gravely weakened the religious and moral prestige of the office as a bond of unity of Islam.