মিল্টনের মতো ওয়ার্ডওয়ার্থেরও কবিতা রচনার একটা বিশেষ আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল। এবং আজীবন কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেই তিনি এই আদর্শ বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কবির বয়স যখন চৌদ্দও পেরোয়নি সেই বয়সেই প্রকৃতির মধ্যে অনন্ত বৈচিত্র্য সম্বন্ধে তিনি সজাগ হয়ে ওঠেন। ওই বয়সে অন্যান্য কবিরা যেখানে প্রকৃতির বুকে লালিত হন, সেখানে ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়েন প্রকৃতির প্রেমে। প্রকৃতি সম্পর্কে এই বোধ ওয়ার্ডওয়ার্থের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে কবির এই পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয় কবি বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ আত্মকাহিনীমূলক ‘দ্য প্রিলুড’ (The Prelude) আখ্যান-কাব্যে এবং তাঁর আরও অনেক কবিতায়। এই প্রকৃতিকে কখনও তিনি এঁকেছেন একজন কঠোর গৃহশিক্ষিকারূপে, যে তরুণ কবিকে শেখাত শৃঙ্খলা ও আত্মসংযম। কখনও প্রকৃতিকে কবি দেখেছেন এক তরুণীরূপে যে আপন উচ্ছলতা নিয়ে কোথাও বা পর্বতিয়া, পাহাড়ি মেয়েরূপে, কোথাও বা লুসিরূপে (Lucy) মূর্ত হয়ে উঠত, মূর্ত হয়ে উঠত নৃত্যচপল ঝরনা বা ছোট্ট নদী বা ভাসমান মেঘের (floating clouds) মধ্য দিয়ে। প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, প্রকৃতিরই অংশীভূত বুথ (Ruth), মার্গারেট (Margaret) বা জলৌকা-সংগ্রাহক ‘লীচ গ্যাদারার’ (Leech-gatherer) -এর মতোই প্রকৃতিও কখনো কখনো কবির কাছে হয়ে উঠেছে গম্ভীর, বিষণ্ণ ও অসংলগ্ন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ সম্পূর্ণ একাকী যখন প্রকৃতির মুখোমুখি এসে দাঁড়াতেন, প্রকৃতিকে নিজের মধ্যে অনুভব করতেন তখন প্রকৃতিকে তিনি জীবন্ত প্রাণবন্ত সত্তারূপেই উপলব্ধি করেছেন। প্রকৃতি সম্পর্কে এই দিব্য অনুভবকে পরবর্তীকালে যথাযোগ্য ভাষায় রূপ দেবার চেষ্টা ওয়ার্ডওয়ার্থ করেছেন তাঁর কবিতায়।

প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের দৃষ্টিভঙ্গীর ক্রম-বিবর্তনের সুস্পষ্ট ধারাপথটি কবির আত্মকাহিনীমূলক কাব্য ‘দ্য প্রিলুড’ (The Prelude) এবং তৎসঙ্গে রচিত অন্যান্য কবিতার মধ্যেই ধরা পড়ে। ‘দ্য প্ৰিলুড’ কাব্যে জানা যায় কবির বয়স যখন দশ তখনই প্রকৃতির প্রতি এক দুর্বার আকর্ষণ তিনি বোধ করেছেন, তবে সে আকর্ষণের মধ্যে ছিল এক অন্ধ বা অবোধ আনন্দ ও ভয়, আর ছিল অনির্দিষ্ট, অস্পষ্ট, ভাসাভাসা অনুভব, কিন্তু তা এমন সর্বগ্রাসী যে কবির ইচ্ছে থাকলেও তা ঝেড়ে ফেলতে পারতেন না। এই বয়সে তিনি কী অনুভব করেছেন তা নয়, কেমনভাবে অনুভব করেছেন (not what he felt, but how he felt’) সেই কথা এবং কীভাবে তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে উঠলেন তার ক্রমপরিণতির মুখ্য স্তরগুলির কথা তিনি বিবৃত করেছেন তাঁর ‘ইমরটালিটি ওড’ (The Immortality Ode ) কবিতায়।

ষোল বছর বয়সে প্রকৃতি সম্বন্ধে এই সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় ভাবনার কোরক থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতি ও প্রকৃতি-প্রেম সম্বন্ধে তিনি প্রথম সজাগ হয়ে ওঠেন। তিনি অনুভব করেন তিনি প্রকৃতির একটা অংশমাত্র নন, প্রকৃতি তাঁরই এবং তাঁর নিজের চেতনা ও প্রকৃতি স্বতঃলব্ধ জ্ঞান বা স্বজ্ঞার মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই।

কবি-মানসিকতার পরিবর্তনের পরবর্তী পর্বে ওয়ার্ডওয়ার্থ তাঁর আশেপাশের মানুষ সম্পর্কে হয়ে উঠলেন কৌতূহলী এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষকেও ভালোবাসলেন। তাঁর প্রকৃতিপ্রেমের মধ্যে নতুন মানবিক আবেগবোধ তিনি আবিষ্কার করলেন, তিনি দেখলেন সাহচর্যহারা প্রকৃতিকে সহনীয় ও বিশিষ্টরূপে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা, তার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে মানুষ। কিন্তু এই পর্বকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও কবি শুধু এই বিশ্বের বুকেই নয়, প্রকৃতির বুকেও নিজেকে একজন পথিকরূপে অনুভব করেছেন, কবির ‘দ্য পিলুড’ কাব্যটিতে আমরা কবি-মানসিকতার এই পরিচয় পাই। প্রথমত, কলেজের ছুটিতে রাত্রে বনে বনে বেড়ানোর সময় তিনি নিজেকে এক ‘উৎসর্গিত আত্মা’ (Dedicated Spirit) বলে অনুভব করলেন। দ্বিতীয়ত ‘সিম্পলন পাশ’ (The Simplon Pass) বিষয়ক কবিতাবলীতে তিনি অনুভব করলেন, যে ভগবৎসৃষ্ট বৃষ্টি, বাতাস, তুষার, কুয়াশা সবকিছুর মধ্য দিয়ে একজনের ইচ্ছাই মূর্তরূপ পরিগ্রহ করেছে। কবি নিজেও এই ইচ্ছারই এক প্রকাশ। কবির ‘টিনটার্ন অ্যাবে’ (Tintern Abbey) কবিতাতেও এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।

এই হচ্ছে সর্বেশ্বরবাদ (ঈশ্বর ও সৃষ্টি অভেদ = Pantheism)। প্রকৃতির মধ্যে কবি বিশ্বমনের অস্তিত্বকে অনুভব করলেন। এই বিশ্বমনই এই প্রকৃতিকে ভেঙে-গড়ে নিত্যনতুন রূপ দিয়ে ‘নব নব নিত্যই নবরূপে হাজির করেছেন। এই আকাশ, বাতাস, সরিৎ, সাগর তাঁরই ইচ্ছার প্রকাশ।

কবির জীবনের কুড়ি বছর পর্যন্ত এই ছিল তাঁর মানসিকতা। বাইরের ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত কবি-জীবনে তেমনভাবে আসেনি। যে বড় ঘটনা কবির জীবনকে ধরে নাড়া দিল তা হচ্ছে ফরাসি বিপ্লব। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে ফরাসি বিপ্লবের প্রথম অভিঘাতে কবি উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সৌভাগ্যোদয় হবে, পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা, ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বিপ্লবের পরবর্তী ঘটনাবলী তাঁর আশা ও বিশ্বাসের মূলে কঠোর আঘাত হানল। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের শেষ পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণ হতাশা ও বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে রইলেন। মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশা এবং মহনীয় কিছু লাভের জন্য তাঁর নিজের ব্যক্তিগত প্রত্যাশা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। প্রকৃতির জগৎ থেকে তিনি মানুষের জগতে, কৈশোরের ব্যক্তিগত সুখের শান্ত জীবন থেকে রাজনীতি ও যুদ্ধের অশান্তির সীমান্তে এসে পড়লেন। এই অপরিচিত জগতে এসে তিনি ভুল করলেন। মানুষকে শ্রেষ্ঠ ও সৎ সৃষ্টি হিসেবে দেখতেই প্রকৃতি তাঁকে শিখিয়েছিল। কিন্তু কবি খুব দুঃখের সঙ্গে সেই মানুষের মধ্যে আবিষ্কার করলেন অমঙ্গলের শেকড় (Root of evil) এবং এই বিপ্লব তাঁকে শিক্ষা দিল যে মনুষ্য সমাজের মধ্যেই রয়েছে যুগ যুগ ধরে পুঞ্জীভূত পাপের ভাণ্ডার।

ফরাসি বিপ্লবের কালিমালিপ্ত দিকগুলি দেখে হতাশায় ভেঙে পড়া কবি মানুষের জগৎ থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন। তিনি সান্ত্বনা খুঁজতে চাইলেন প্রকৃতির বুকে। কবির আহত মানসিকতা পুনরুদ্ধারের কাজে প্রথমদিকে কবির বোন ডরোথি এগিয়ে এলেন, পরে এসে যুক্ত হলেন কোলরিজ। কবির স্বীকৃতি অনুসারে এই ডরোথি, কোলরিজ এবং সর্বশেষ স্বয়ং প্রকৃতি কবির আহত মানসিকতাকে আবার পূর্ববর্তী জীবনের শান্তি, স্বস্তি ও মানবপ্রেমের উপকূলে পৌঁছে দেয়।

প্রকৃতি কবিকে আপন পক্ষপুটে ফিরিয়ে নিয়ে এল, অধিকতর শাস্ত ও সংহত অনুভবের মধ্য দিয়ে কবি আবার মানবমুখী হলেন। তবে এ মানুষ রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বা নীতিবাদী মানুষ নয়, এ মানুষ আমাদের চোখে দেখা, আমাদের আশেপাশের সাধারণ ব্যক্তি মানুষ। যে মানুষ কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রমে ন্যুব্জ দেহ সেই মানুষই, কবির মতে একজন তাত্ত্বিক বা অর্থনীতিবিদের চেয়ে জীবন সম্পর্কে বেশি কথা বলতে পারবে।

এইভাবেই কবি এসে পড়লেন বোধের এক নতুন জগতে, যে জগতে রয়েছে নিয়মের এক স্থির বিন্দু। প্রাকৃতিক জগতের নিয়মের মতোই মানুষের মধ্যেও এক অপরিহার্য আত্মিক মর্যাদাবোধ বা চারিত্রিক সমুন্নতি তিনি খুঁজে পেলেন। প্রকৃতির মধ্যেও তিনি দেখেছিলেন শক্তি ও স্বাভাবিক মাধুর্য বা সৌষ্ঠবের প্রকাশ। এর ফলে কবির কাছে প্রকৃতি ও মানুষ মিলে এক হয়ে গেল। কবির কাছে মানুষের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ও মহাকাশের তারকার বিঘূর্ণন এই শক্তির প্রকাশ বলে মনে হল।

আগেই বলা হয়েছে কবি সমাজের ওপরের তলার মানুষের দিকে নয়, অতি সাধারণ মানুষের দিকেই ফিরে তাকালেন। মেষপালক, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, অবসরভোগী প্রভৃতি অতি সাধারণ মানুষেরাই হয়ে উঠল কবির কবিতার বিষয়বস্তু। কবির মানসিকতার এক সংকটময় দিনে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে জনৈক জলৌকা-সংগ্রাহকের (Leech-gatherer) সঙ্গে কবির সাক্ষাৎকারে সেই কঠিন পরিশ্রমী বৃদ্ধের মধ্যে যে দুর্বলতা ও জীবন সম্পর্কে সাহসহীনতার জন্য কবি লজ্জিত হন। কবি যেন সেই বৃদ্ধের দর্পণে নিজের মনের ছবিটি দেখতে পান। এইভাবেই প্রকৃতির মতোই সাধারণ মানুষের কাছেও কবি শিক্ষালাভ করেন। কবির কাছে তা friend, philosopher and guide ; এবং কবি-মানসিকতার healer and soother শুধু প্রকৃতিই নয়, মানুষও; এবং এইভাবেই জীবনের পরবর্তীকালে কবির কাছে প্রকৃতি ও মানুষ একই অর্থবহ হয়ে উঠেছে। দুইয়ে মিলে এক হয়ে গেছে। প্রকৃতির সন্তান মানুষের মধ্যে প্রকৃতির প্রতিচ্ছায়াই কবি দেখতে পেয়েছেন।

প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে এই কাল্পনিক অভেদ কল্পনাই রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডওয়ার্থের কাব্য-কল্পনার বৈশিষ্ট্য।