সূচনা: ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। তিনি বাংলার রাজস্ব আদায়ের অধিকার সরাসরি কোম্পানির হাতে তুলে দেন এবং প্রথমে পাঁচসালা বন্দোবস্ত ও পরে একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন।

[1] পাঁচসালা বন্দোবস্ত: রাজস্ব আদায়ের জন্য গভর্নর- জেনারেল ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে (১৪ মে) একটি ভ্রাম্যমাণ কমিটি গঠন করেন। যে ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে রাজি হত, এই ভ্রাম্যমাণ কমিটি তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দিত। পুরানাে জমিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হলে তিনি জমিদারি হারাতেন। এই ব্যবস্থা ‘ইজারাদারি ব্যবস্থা’ বা ‘পাঁচসালা বন্দোবস্ত’ (১৭৭২-১৭৭৭ খ্রি.) নামে পরিচিত।

  • কালেক্টর: পাঁচসালা বন্দোবস্তের সময় হেস্টিংস রাজস্ব ব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্কার করেন। কোম্পানির রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বে থাকা পূর্বর্তন সুপারভাইজারদের তিনি নতুন নামকরণ করেন ‘কালেক্টর’। কালেক্টররা জেলার রাজস্ব আদায়, বিচার ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত।

  • রাজস্ব বোর্ড গঠন: পরে ভ্রাম্যমাণ কমিটি বাতিল করে হেস্টিংস ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে একটি রাজস্ব বাের্ড’ বা ‘Board of Revenue’ গঠন করেন। হেস্টিংস বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে ছয়টি অংশে বিভক্ত করে প্রতিটি অংশে একটি করে ‘প্রাদেশিক কাউন্সিল’ গঠন (১৭৭৩ খ্রি.) করেন। তিনি কালেক্টর পদ বাতিল করে প্রতিটি কাউন্সিলে একজন করে ভারতীয় দেওয়ান নিয়ােগ করেন।

  • আমিনি কমিশন: হেস্টিংস রাজস্ব সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘আমিনি কমিশন গঠন করেন। আমিনি কমিশনের সুপারিশ অনুসারে প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলির অবসান ঘটিয়ে আবার কালেক্টর পদ চালু করা হয়। কালেক্টরদের হাতে জেলা প্রশাসনের যাবতীয় দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

[2] পাঁচসালা বন্দোবস্তের ত্রূটি: হেস্টিংস প্রবর্তিত পাঁচসালা বন্দোবস্তের বেশ কয়েকটি ত্রূটিবিচ্যুতি লক্ষ করা যায়, যেমন一

  • শােষণ: পাঁচসালা বন্দোবস্তে অসৎ ও লােভী ইজারাদার নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রজাদের ওপর শােষণ ও উৎপীড়ন চালাত।

  • নতুন জমিদার শ্রেণির উত্থান: নিলামের মাধ্যমে কোম্পানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু উঁইফোঁড় ব্যক্তি নতুন জমিদার বা ইজারাদার হয়ে ওঠেন। সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে বহু পুরােনাে জমিদার তাদের জমিদারি হারান।

  • অনিশ্চিত আয়: নতুন জমিদার বা ইজারাদাররা বহু ক্ষেত্রেই কোম্পানিকে ঠিকমতাে রাজস্ব পরিশােধ করত না। ফলে কোম্পানির আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

  • কৃষির অবনতি: ইজারাদাররা জমিতে স্থায়ীভাবে স্বত্ব না পাওয়ায় তারা জমি ও কৃষকের উন্নতির দিকে বিশেষ নজর দিত না। ফলে কৃষির উন্নতি ব্যাহত হয়।

[3] একসালা বন্দোবস্ত: হেস্টিংস ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে পাঁচসালা বন্দোবস্ত বাতিল করে প্রতি বছর জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার প্রথা চালু করেন। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত এই প্রথা একসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। এই বন্দোবস্ত ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চালু থাকে। এই বন্দোবস্ত অনুসারে

  • [i] প্রতি বছর পুরােনাে জমিদারদেরই জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার নিয়ম চালু হয়। 

  • [ii] বিগত তিন বছরের রাজস্বের গড় অনুসারে এই বন্দোবস্তে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। 

  • [iii] জমিদার রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হলে তার জমিদারির একাংশ বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব পরিশােধের নিয়ম চালু হয়।

[4] একসালা বন্দোবস্তের ত্রূটি: একসালা বন্দোবস্তেও বিভিন্ন ত্রূটিবিচ্যুতি ধরা পড়ে, যেমন

  • [i] এর ফলে কৃষকরা খুবই শােষিত হত। 

  • [ii] জমিদারদের সঠিকভাবে রাজস্ব আদায় করতে পারেননি। 

  • [iii] জমিদাররা নিজেদের আয় বৃদ্ধিতে খুব বেশি নজর দিলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে অবহেলা দেখান।

উপসংহার: হেস্টিংস রাজস্ব ব্যবস্থায় বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার দ্বারা সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজেছিলেন মাত্র। ড. তারা চাঁদ বলেন, ভারতের গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামাের ওপর হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার প্রবল আঘাত হানে।