অথবা, হযরত ওমর (রা)-এর রাজ্য বিজয় কাহিনী ধারাবাহিকভাবে সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উপস্থাপনাঃ ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে হযরত ওমর (রা) ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইসলাম প্রচার প্রসারে তার অবদান অতুলনীয়। দিগ্বিজয়ী ও দক্ষ শাসকের গুণে গুণান্বিত হওয়ায় তিনি ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তার শাসনামলে মুসলিম সৈন্যরা বিশ্ব বিজয়ে প্রবৃত্ত হন এবং একের পর এক বিজয় অভিযান পরিচালনা করে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমারেখা সম্প্রসারণ করেন। তার রাজ্য বিজয়ের স্বরূপ নির্ণয়ে পি. কে. হিট্টি বলেন- After the death of prophet, sterile Arabia seems to have been converted as if magic into nursery of heroes the like of whom both in number and quality is hard to find anywhere. [History of Arabs P. 80]
হযরত ওমর (রা)-এর রাজ্য বিস্তারঃ হযরত ওমর (রা)-এর শাসনামলে মুসলিম সৈন্যরা বিশ্ব বিজুয়ে অগ্রসর হয়েছিল। একের পর এক বিজয় অভিযান চালিয়ে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের সীমারেখা বিস্তার করেন, তার রাজ্য বিজয়াভিযানসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ-
পারস্য বিজয়ঃ ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য দ্বিতীয় খলিফার আমলে পারস্য জয় করার প্রয়ােজনীয়তা অনিবার্য হয়ে ওঠে। নিম্নে পারস্য বিজয়ের ঘটনাবলি বর্ণনা করা হলাে-
ক. ব্যাবিলনের যুদ্ধঃ ৬৩৪ সালে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ সেনাপতি হরমুযের নেতৃত্বে ১০ হাজার পারসিক সৈন্যের এক বাহিনী মুসলিম সেনাপতি মুসান্নার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মুসান্না সৈন্যসহ ইউফ্রেটিস নদী পার হয়ে ব্যাবিলন প্রান্তরে পাল্টা হামলা করলে পারসিকরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে।
খ. নামারিকের যুদ্ধঃ প্রথম খলিফার শাসনামলে পারস্যের হীরা রাজ্য মুসলমানগণ দখল করলেও দ্বিতীয় খলিফার সময় পারসিকরা কিংবদন্তি যােদ্ধা রুস্তমকে পাঠায় হীরাত পুনর্দখলের জন্য। এ সংবাদে হযরত ওমর (রা) সেনাপতি আবু ওবায়দার নেতৃত্বে নতুন সৈন্যদল গঠন করে হীরায় নিযুক্ত মুসলিম সেনাপতি মুসান্নার প্রতি প্রেরণ করেন। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে উভয় বাহিনী মুখােমুখি হলে এবারও পারসিকরা পরাজিত হলে মুসলমানগণ হীরা পুনর্দখল করে।
গ. জাসর বা সেতুর যুদ্ধঃ নামারিকের যুদ্ধের শােচনীয় পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলার জন্য সেনাপতি বাহমনের নেতৃত্বে এক বিশাল পারসিক বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয়। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে মুসলিম সেনাপতি আবু ওবায়দা মুসান্নার পরামর্শ উপেক্ষা করে ইউফ্রেটিস নদীতে সাঁকো দিয়ে পার হয়ে পারসিকদের মােকাবেলা করেন। এজন্য একে সেতুর যুদ্ধ বলা হয়। কিন্তু পারসিকদের হস্তিবাহিনীর কারণে মুসলমানরা পরাজিত হয়। এতে মুসান্না আহত হলেন এবং আবু ওবায়দাসহ ৬ হাজার মুসলিম সেনা শাহাদাতবরণ করেন।
ঘ. বুয়ায়েবের যুদ্ধঃ সেতুর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ওমর (রা) হযরত জাবেরের নেতৃত্বে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে কুফার নিকটবর্তী বুয়ায়েবের প্রান্তরে পারসিক বাহিনীর মােকাবেলার জন্য এক বাহিনী পাঠান। এ যুদ্ধে পারসিক সেনাপতি মিহরানসহ বহু সৈন্য নিহত হয়।
ঙ. কাদেসিয়ার যুদ্ধঃ বুয়ায়েবে পরাজয়ের প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য মহাবীর রুস্তুমের সেনাপতিত্বে এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। তাদের প্রস্তুতিতে খলিফা ওমর (রা) সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে ৩০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী দিয়ে পারস্য অভিমুখে প্রেরণ করেন। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে মুসলিম বাহিনী কাদেসিয়া নামক প্রান্তরে তাবু ফেলে প্রথমে খলিফার নির্দেশমতাে পযায়ক্রমে পারস্য সম্রাট ও সেনাপতিকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু তারা দর্পভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিন দিন স্থায়ী এ যুদ্ধে সেনাপতি রুস্তুম নিহত হলে পারস্য বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
চ. মাদায়েন বিজয়ঃ সেলুসিয়া ও টেসিকোন শহরদ্বয়কে মাদায়েন বলা হতাে। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে খলিফার নির্দেশে সেনাপতি সাদ (রা) উক্ত শহরকে দখল করলে প্রচুর ধন-সম্পদ ও বিলাস-সামগ্রী মুসলিমদের হস্তগত হয়।
ছ. জালুলার যুদ্ধঃ মাদায়েন হতে ১০০ মাইল দূরে হালওয়ানে আশ্রয়গ্রহণ করে পারস্যরাজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে পুনরায় রণ প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে সাদ (রা) খলিফার অনুমতিক্রমে কাকারকে ১২০০ সৈন্যের এক বাহিনী বিয়ে জালুলী নামক প্রান্তরে পারসিকদের মােকাবেলা করতে নির্দেশ দেন। আট দিন অবরােধের পর জালুলার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করলে হালওয়ান তাদের দখলে আসে।
জ. জন নিহাওয়ান্দের যুদ্ধঃ জালুলার যুদ্ধের পর পারসিকরা মুসলমানদের এক সন্ধির্পত্রে স্বাক্ষর করে। ঘটনাক্রমে সম্রাট সন্ধি ভঙ্গ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ফিরােজানের নেতৃত্বে ১,৫০,০০০ পারসিক বাহিনী নিহাওয়ান্দের প্রান্তরে মুসলিম সেনাপতি নােমানের নেতৃত্বাধীন ৩০,০০০ সৈন্য বাহিনীর মােকাবেলা করেন। এ যুদ্ধেও মুসলমানরা বিজয়ী হয়। ফলে ফারস, কিরমান, মাকরান, সিস্তান, খােরাসান ইত্যাদি সমগ্র পারস্য মুসলিম দখলে আসে।
বাইজানটাইন বিজয়/রােমান সাম্রাজ্য বিজয়ঃ আরবদেশের উত্তর পশ্চিমে সিরিয়া, জর্ডান, প্যালেস্টাইন ও বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ নিয়ে গঠিত রােমান সাম্রাজ্যকে আগে বাইজানটাইন সাম্রাজ্য বলা হতাে। বাইজানটাইনে হযরত ওমর (রা)-এর বিজয়াভিযানসমূহ নিম্নরূপ-
ক. সিরিয়া বিজয়ঃ
১. দামেস্ক বিজয়ঃ পরপর কয়েকবার পরাজিত হয়ে হিরাক্লিয়াস সিরিয়ার এন্টিওক শহরে আশ্রয় নেয়। এ সময় খালিদ ইবনে ওয়ালিদ দামেস্ক অবরােধ করেন। টানা ৬ মাসে অবরােধের প্রচণ্ডতা দেখে খ্রিস্টানরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ল। একদা রাত্রে উৎসব উপলক্ষে সৈন্যরা মদ্যপান করে শহরের দরজা খুলে ফেলল। এ সুযােগে সুরক্ষিত দামেস্ক নগরী ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মুসলমানগণ দখল করতে সক্ষম হয়। এ বিজয়ের মূলে ছিল খালিদের তেজস্বিতা ও সৈন্য বিন্যাসের রণ-কৌশল।
২. ফিহলের যুদ্ধঃ দামেস্ক নগরী উদ্ধারের জন্য আগত ব্যর্থ রোমক সেনাবাহিনী জর্ডানে অবস্থান করছিল। আপস মীমাংসার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে ফিহলে রােমানদের সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং রােমীয়গণ এতে পরাজিত হয়। জর্ডান মুসলমানদের দখলে আসলেও তারা রােমীয়দের ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করেন।
৩. হিমস অধিকারঃ জর্ডান অধিকার করার পর মুসলিম বাহিনী সিরিয়ার পরাতন শহর হিমসের দিকে অগ্রসর হয়। ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে সামান্য কিছু বাধা পাওয়ার পর হিমসের জনগণ মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ইতােমধ্যে খলিফার নির্দেশ আসল বিজয় অভিযান বন্ধ রেখে বিজিত অঞ্চল সংস্কার করার। ফলে আবু ওবায়দা হিমসে, আমর ইবনে আস জর্ডানে এবং খালেদ দামেস্কে অবস্থান করতে লাগলেন।
৪. ইয়ারমুকের যুদ্ধঃ দামেস্ক, হিমস ও জর্ডানের পতনে রােম সম্রাট রাগান্বিত হয়ে স্বীয় ভাই থিওডােরাসের নেতৃত্বে দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ইয়ারমুক নামক স্থানে এসে তাঁবু ফেলেন। ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট ইয়ারমুক প্রান্তরে উভয় দলের যুদ্ধ সংঘটিত হলাে। এতে সেনাপতি থিওডােরাসসহ প্রায় এক লক্ষ সৈন্য নিহত হয়। মুসলিম বাহিনী ৩০০০ হাজার সৈন্যের শাহাদাতের বিনিময়ে এ যুদ্ধে জয় লাভ করে।
৫. জেরুজালেম অধিকারঃ ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর আমর ইবনুল আস ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে জেরুজালেম অবরােধ করেন। অল্পকালের অবরােধের পর রােমান সেনাপতি অরবাতুন নগর ছেড়ে চলে যায়। অতঃপর সেখানকার ধর্মীয় নেতা খ্রিস্টান পাদরি সাফ্রীউনিয়াস আত্মসমর্পণ ও শহরের চাবি অর্পণের প্রস্তাব করেন। সংবাদ পেয়ে খলিফা ওমর (রা) বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ করে প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এভাবেই বিনা রক্তপাতে ১৬ হিজরীর রজব মাসে ওমর (রা) নগরীর চাবি গ্রহণ করেন।
৬. জাযিয়া বিজয়ঃ জাযিয়াবাসী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলে মুসলমানরা তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু এরপরও রােমানদের প্ররােচনায় আবার বিদ্রোহ করলে আবু ওবায়দা তাদের ৩০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে জযিয়া দখল করেন।
৭.আর্মেনিয়া ও সাইলেসিয়া বিজয়ঃ রােমানদের প্ররােচনায় কুর্দী ও আর্মেনিয়ানরাও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াস পায়। উত্ত্যক্ত হয়ে মুসলমানগণ কুর্দী অধ্যুষিত উত্তর মেসােপটেমিয়া ও আর্মেনিয়া দখল করেন। এরপর মুসলমানগণ এশিয়া মাইনরের রােমান শক্তি কেন্দ্র সাইলিসিয়া প্রদেশও অধিকার করেন।
খ. মিসর বিজয়ঃ ফিলিস্তিন জয়ের পর আরব মহাশক্তির লক্ষ ছিল মিসর। কারণ রােমানরা বিতাড়িত হয়ে মিসরে আশ্রয় নিয়ে বারবার মুসলিম অধিকৃত এলাকায় আক্রমণ করে, যা মুসলমানদের মিসর অভিযানকে তরান্বিত করে। অতঃপর হযরত ওমর (রা)-এর অনুমতিক্রমে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মিসর জয় করেন।
গ. আলেকজান্দ্রিয়া দখলঃ আমর ইরনুল আস ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে রােমানদের মিসরস্থ প্রধান শক্তিকেন্দ্র দুর্গ অবরােধ করেন। রােমান সেনাপতি থিওডোরাসকে সহযােগিতা করতে সম্রাট সিজার্স ৫০ হাজার সৈন্য পাঠান। ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে প্রচণ্ড যুদ্ধে রােমানরা শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আলেকজান্দ্রিয়া পতনের সাথে সাথে রােমানদের শক্তি লােপ পায় এবং মিসর ইসলামী রাষ্ট্রের অংশে পরিণিত হয়।
ঘ. আফ্রিকা অভিযানঃ মিসর বিজয়ী সেনাপতি আমরের সাহায্যে পাঠানাে এক বাহিনী উত্তর আফ্রিকা অভিযানে প্রেরণ করেন। তারা ৬৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে রােমান সেনাপতি থিওডােরাস ও শাসনকর্তা সাইরাসের নেতৃত্বধীন ৬০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনীকে পরাজিত করেন। এতে বার্কা ও ত্রিপলীতে মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় বরং রােমানদের শক্তি চূর্ণ হয়ে যায়।
উপসংহারঃ হযরত ওমর (রা) একজন শ্রেষ্ঠ বিজেতা ছিলেন। মাত্র দশ বছরের শাসনকালে ইসলামের মহাশত্রু পারস্য ও রােমান সাম্রাজ্য জয়ের মাধ্যমে তিনি ইসলামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাই ঐতিহাসিক পি. কে হিট্টি বলেন- The conquest of the world receiving its impulse under Abu Bakar reached its high watermark under Omar.
Leave a comment