শেক্সপিয়রের পারিবারিক ট্র্যাজেডি (domestic tragedy) নাটক ‘ওথেলো’র নায়িকা চরিত্র ডেডিমোনা। শেক্সপিয়র সৃষ্ট নাটকীয় চরিত্রগুলির মধ্যে সর্বকালের এক উজ্জ্বল চরিত্র হচ্ছেন ওথেলো-প্রিয়া ডেডিমোনা।
ভেনিসের কৃষ্ণাঙ্গ বীর সেনাপতি ওথেলোর বীরত্ব ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে ভেনিসের সিনেটরের কন্যা শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী ডেডিমোনা ও ওথেলোর বিবাহ সম্পন্ন হয়। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের এই বিবাহে শ্বেতাঙ্গ সমাজের অনেকেরই মত ছিল না। এই বিয়েতে ডেডিমোনার পিতা ভেনিসের সিনেটরেরও মত ছিল না।
শেষ পর্যন্ত সিনেটর এই বিবাহ অনুমোদন করে। বিবাহের পরই সামরিক প্রয়োজনে, তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ওথেলো সাইপ্রাসে যান। ডেডিমোনাও হন ওথেলোর অনুগামী।
আবেগপ্রবণ, রোমান্টিক চরিত্র এই ডেসডিমোনা। তাঁর সৌন্দর্য ও আভিজাত্য নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ এই সেনাপতিকে বিবাহ করায় তৎকালে ভেনিসের অনেক যুবকেরই ক্ষোভের কারণ হন। তাদের ক্ষোভ ও বিদ্রূপ সত্ত্বেও ডেডিমোনার কল্পনার রঙে কৃষ্ণাঙ্গ এই ওথেলোই অপরূপ ওথেলো হয়ে ওঠেন। ডেসডিমোনা সরল মনেই তাঁর ভালোবাসার পাত্রের উপর একান্ত নির্ভর করেন।
একনিষ্ঠ প্রেম নিয়ে ডেডিমোনার এই সূর্যমুখী মন কিন্তু এই যুদ্ধযাত্রায় ওথেলোর সহযোগী ইয়াগো প্রমুখ চরিত্রের প্রতিকূলতায় ক্রমেই বিশুদ্ধ হতে শুরু করে। ইয়াগো প্রমুখ ওথেলোর মনে ডেডিমোনার চরিত্র সম্বন্ধে সন্দেহের বীজ বপন করতে আরম্ভ করে। ডেসডিমোনার সরল ব্যবহার, অপরের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও সহৃদয়তা ওথেলোর মনে বিপরীত ধারণার সৃষ্টি করে। ওথেলো হয়ে ওঠেন গভীর সন্দেহপ্রবণ। আপনার সরলতায় ডেসডিমোনার চোখে এটা ধরা পড়ে না। ওথেলোর এক সহকারী ক্যাসিওর প্রতি অবিচারের প্রতিকারার্থে ডেডিমোনা ওথেলোর কাছে আবেদন জানান। কিন্তু ঈর্ষাতুর ইয়াগোর বিষাক্ত জলনিষেকে ডেডিমোনা সম্পর্কে ওথেলোর সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে। ওথেলো একে ক্যাসিওর প্রতি ডেডিমোনার অনুরাগ বলেই মনে করেন। ওথেলো প্রদত্ত একটা রুমাল ডেডিমোনার কাছ থেকে পড়ে যায়, কুড়িয়ে পান ক্যাসিও। ক্যাসিওর কাছে সেই রুমাল দেখে ডেডিমোনার প্রতি ওথেলোর সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। ফলে অপাপবিদ্ধ সরল মন সহানুভূতিশীল ডেসডিমোনা যতই ক্যাসিওর জন্য ওথেলোকে অনুরোধ করেন, করেন উপরোধ, ততই ডেডিমোনা সম্পর্কে ওথেলোর মনোভাব দৃঢ় থেকে দৃঢ়ীকৃত হয়।
ওথেলোর এই মানসিক পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত ডেসডিমোনার দৃষ্টি এড়ায় না। যার জন্য ভেনিসের সমাজ ও স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন, তাঁর এই শীতল ব্যবহার ডেসডিমোনার কাছে পরম দুঃখের, প্রায় মৃত্যুতুল্য। এর সঠিক কারণও ডেডিমোনা ধরতে পারছেন না। তাই তিনি ক্রমে হতাশ। আর ওথেলোও আপন ঈর্ষা বিষে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য ওথেলো শেষ পর্যন্ত ভালবাসাকেই শেষ করতে সঙ্কল্প করল। সঙ্কল্প করল ডেডিমোনাকে হত্যা করার।
শয্যায় অপেক্ষমান ডেসডিমোনার কাছে মৃত্যুদূতরূপী ওথেলোকে দেখেও তিনি ওথেলোকে কোনো অভিযোগ জানালেন না। কোনো বাদ-প্রতিবাদ-বিসম্বাদ কিছুই করলেন না। প্রিয়তমের হাতে তিনি মৃত্যু উপহার গ্রহণ করলেন। জীবনদীপ নির্বাপিত হল। ভালবাসার হাতেই ভালবাসার মৃত্যু ঘটল। পরিশেষে তাঁর মৃত্যুর জন্যও প্রিয়তমের উদ্দেশ্যে কোনো অভিযোগই তিনি জানালেন না। তিনি নিজেকেই এর কারণ জানিয়ে নিলেন বিদায়।
Nobody : I myself Farewell.
Command me to my kind lord, O farewell.
—ভোরের ফোটা ফুলটি অকাল নিদাঘেই শুকিয়ে গেল, ঝরে পড়ল।
Leave a comment