আগেকার দিনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মূলত দার্শনিক, আইনানুগ ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়বস্তুর বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই ধারা বর্তমান ছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে সামগ্রিকভাবে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি (Traditional Approach) বলা হয়। অপরদিকে আচরণবাদের উদ্ভব হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। তিনের দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় আচরণবাদের পীঠস্থানে পরিণত হয়। পঞ্চাশের দশকে আচরণবাদী বিপ্লব পরিপূর্ণতা লাভ করে। ষাট ও সত্তরের দশকে ইউরোপ ও এশিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও আচরণবাদী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বর্তমান। এই পার্থক্যগুলি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক। তাহলে উভয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রসমূহে মৌলিক পার্থক্য বর্তমান।

(১) আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মুখ্য উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ব্যক্তির আচরণকে প্রাধান্য প্রদান এবং আলোচনাকে বিজ্ঞানভিত্তিক করে তোলা। আচরণবাদীরা অভিযোগ করেন যে ঐতিহ্যবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ব্যক্তির আচার-আচরণ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চিন্তাধারা প্রভৃতিকে গুরুত্ব দেননি। আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই সব বিষয়ের উপরই গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন।

(২) মূল্যবোধের প্রশ্নে পার্থক্য: মূল্য ও নীতিবোধের প্রশ্নে ঐতিহ্যবাদী ও আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মূল্যমান-নিরপেক্ষ (value-free) করে তোলার পক্ষপাতী। তাঁরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এলাকা থেকে মূল্য ও নীতিবোধকে বাতিল করতে চান। আচরণবাদীদের মতানুসারে মূল্যবোধ হল অভিজ্ঞতাবাদী বিচার-বিশ্লেষণের বিরোধী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়কে বিজ্ঞানসম্মত করার জন্য অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠন করা দরকার। এই উদ্দেশ্যে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যাদি ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা দরকার এবং সংগৃহীত তথ্যাদিকে বিজ্ঞানসম্মত পন্থা-পদ্ধতিতে বিচার-বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আবশ্যক। মূল্যবোধের সঙ্গে তথ্য ও অভিজ্ঞতার পার্থক্য থাকে। তাই রাজনীতিক গবেষকদের উচিত মূল্য ও নীতিবোধকে বাদ দিয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা। কিন্তু ঐতিহ্যবাদীরা আচরণবাদীদের উপরিউক্ত বক্তব্যকে মানতে রাজী নন। ঐতিহ্যবাদীদের বক্তব্য হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা কখনই মূল্যবোধহীন ছিল না এবং কখনই তা মূল্যবোধহীন হবে না। রাজনীতিক ঘটনা ও সমস্যাদির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মূল্যবোধের ধারণাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ঔচিত্য-অনৌচিত্যের প্রশ্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বরাবরই আছে। রাজনীতিক কাজকর্ম, চিন্তা-ভাবনা এবং গবেষণার সঙ্গে মূল্য ও নীতিবোধের বিষয় সংযুক্ত থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয় বা সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মূল্য ও নীতিবোধকে পুরোপুরি পরিহার করে এগোনো যায় না। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাঁদের সামাজিক উত্তরাধিকার ও অভিজ্ঞতাকে কখনই উপেক্ষা করতে পারেন না। বিজ্ঞানীরাও ব্যক্তিগত মূল্যবোধকে পুরোপুরি বিসর্জন দিতে পারেন না। বস্তুত আচরণবাদীরা মূল্যবোধের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত নন।

(৩) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার প্রশ্নে পার্থক্য: বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে সমরূপতা (uniformity) বা নিয়মমাফিকতা (regularity) পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তিবর্গের আচরণের এই সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন অনুমান ও তত্ত্ব গড়ে তোলা যায়। তারপর সংশ্লিষ্ট অনুমান ও তত্ত্বের মাধ্যমে রাজনীতিক বিষয়াদি বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় এবং নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করাও সম্ভব। আচরণবাদীদের অভিমত অনুসারে এইভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে যথার্থ বিজ্ঞানের মর্যাদায় মণ্ডিত করা যায়। ঐতিহ্যবাদীরা তা অস্বীকার করেন। এঁদের মতানুসারে ব্যক্তির রাজনীতিক আচার-আচরণের মধ্যে অনেক সময়েই সমরূপতা বা নিয়মমাফিকতা পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু সব সময়ে নয়। মানুষের রাজনীতিক আচরণের মধ্যে মানবিক অনুভূতি, আর্থ-সামাজিক, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রভৃতি বর্তমান থাকে। তা ছাড়া মানুষ মননশীল। তাই মানুষের আচরণ পরিবর্তনশীল। এই কারণে মানুষের আচরণ অনুধাবন করে যথাযথভাবে অনুমান ও তত্ত্ব গঠন করা যায় না। আবার ভৌত বিজ্ঞানের বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বস্তুগত উপাদানসমূহের বিশ্লেষণ যেভাবে করা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তা অচল। বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা হল সব সময়ই নৈর্ব্যক্তিক। বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষের রাজনীতিক আচরণকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের স্তরে উন্নীত করার উদ্যোগ অবান্তর।

(৪) উপযোগিতার প্রশ্নে পার্থক্য: আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির উপর জোর দেন। তাঁরা ভৌত বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তাঁরা এই সমস্ত উপায়-পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চান। এবং আচরণবাদীরা মনে করেন যে এখানেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ। এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ফলাফল বা সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তব উপযোগিতার ব্যাপারে তাঁরা উদাসীন। অর্থাৎ বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের পদ্ধতি প্রয়োগই হল আচরণবাদীদের মূল উদ্দেশ্য। গবেষণালব্ধ ফলাফলের সামাজিক ও রাজনীতিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁরা চিন্তা করেন না। কিন্তু ঐতিহ্যবাদীরা বহুলাংশে উপযোগবাদী। তাঁদের মতানুসারে বাস্তব উপযোগিতাহীন অনুসন্ধান পদ্ধতির অনুশীলন অর্থহীন। যে গবেষণার দ্বারা রাজনীতিক সমস্যাদির সমাধানের পথ পাওয়া যাবে না তা নিষ্ফল। সমাজের রাজনীতিক সমস্যার সমাধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান গুরুত্বহীন। ঐতিহ্যবাদীদের মতানুসারে কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য না হয় তা হলে তার যথার্থতা প্রতিপন্ন হয় না। এ ধরনের অনুধাবন পদ্ধতি মূল্যহীন।

(৫) পরিমাপ ও সংখ্যায়নের প্রশ্নে পার্থক্য: আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ও অনুমানগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভুল করে তুলতে চান। এই কারণে আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় পরিসংখ্যান ও গাণিতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। তাঁরা পরিমাপ (measurement) ও সংখ্যায়ন (quantification) -এর সাহায্যে রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যাদির আলোচনার ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে চান। আচরণবাদীদের মতানুসারে ঘটনা ও তথ্যাদির বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা পরিমাপ ও সংখ্যায়নের মাধ্যমে স্বীকৃত না হলে তা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না। ঐতিহ্যবাদীরা কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় পরিমাপ ও সংখ্যায়নের পদ্ধতি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী নন। এঁদের মতে এই পদ্ধতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অচল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়গুলি পৃথক প্রকৃতির। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপাদানগুলি বস্তুগত নয়। মানুষের কাজকর্ম ও আচার-আচরণের মধ্যে আবেগ-অনুভূতির বহু বিষয় থাকে। এই সমস্ত বিষয়কে গাণিতিকভাবে পরিমাপ করা বা সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায় না।

(৬) আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানমূলক আলোচনার প্রশ্নে পার্থক্য: আচরণবাদীরা আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানমূলক আলোচনার উপর জোর দেন। তাঁদের মতানুসারে সামাজিক বিজ্ঞানসমূহ পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। পারস্পরিক সমন্বয় ও সহযোগিতার উপর সামাজিক বিজ্ঞানগুলির সাফল্য ও সার্থকতা নির্ভরশীল। এই কারণে আচরণবাদীরা আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানের সংহতিসাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ঐতিহ্যবাদীরা আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞান-সহযোগিতাকে অস্বীকার করেন না। কিন্তু তাঁরা এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের পক্ষপাতী। ঐতিহ্যবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশেষভাবে সজাগ। আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিকে তাঁরা একেবারে বাতিল করে দেন না। তবে এক্ষেত্রে সমন্বয়সাধনমূলক প্রয়াসকে তাঁরা সমর্থন করেন।

(৭) পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি প্রশ্নে পার্থক্য: আচরণবাদীরা সিদ্ধান্তসমূহের সত্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। তাঁদের মতানুসারে অভিজ্ঞতাবাদী ও পরীক্ষাসাপেক্ষ ধারণার উপর যে জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত তা যথার্থ ও বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা ছাড়া তথ্য-প্রমাণ সঠিক প্রতিপন্ন হয় না। আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সত্যতা যাচাই-এর এই পদ্ধতির উপর জোর দেন। ঐতিহ্যবাদীরা কিন্তু তা সমর্থন করেন না। তাঁদের মতানুসারে রাজনীতিক জীবনধারা, আচরণ ও ঘটনাবলীর সবকিছুই পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়। এসবের অতি অল্পই পর্যবেক্ষণ করা যায়। মানুষ সমাজ বহির্ভূত নয় এবং সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এই কারণে সমাজবদ্ধ মানুষের যাবতীয় আচার-আচরণের উপর বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। এই অবস্থায় সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানসমূহের কাজকর্ম বিচার-বিশ্লেষণ না করে ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণ অনুধাবন করা যায় না। অথচ আচরণবাদীরা কেবলমাত্র ব্যক্তির মনোভাব ও কাজকর্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণ অনুধাবন করতে চান।

(৮) আলোচ্য বিষয়ের প্রশ্নে মতপার্থক্য: আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অ-প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনায় আগ্রহী। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আচরণবাদী বিশ্লেষণই হল রাষ্ট্রহীন (state-less)। অপরদিকে ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক আলোচনায় অতিমাত্রায় উৎসাহী। ঐতিহ্যবাদীদের মতানুসারে রাজনীতিক কাজকর্ম মূলত প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়ে থাকে। ব্যক্তিবর্গের রাজনীতিক কার্যকলাপ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়। এই কারণে রাষ্ট্রই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। সুতরাং আলোচ্য বিষয় সম্পর্কেও এই দুই গোষ্ঠীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মধ্যে মতপার্থক্য আছে।

(৯) তত্ত্ব ও গবেষণার প্রশ্নে পার্থক্য: আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠনের পক্ষপাতী। তাঁদের মতানুসারে অভিজ্ঞতাবাদী গবেষণার মাধ্যমে অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠিত হতে পারে। তাঁদের আরও অভিমত হল যে তত্ত্বকে বাদ দিয়ে যে গবেষণা তা অর্থহীন। অনুরূপভাবে তথ্য ও পরিসংখ্যানহীন তত্ত্ব হল তাৎপর্যহীন। আচরণবাদী আলোচনা হল আত্ম-সচেতনভাবে তত্ত্বকেন্দ্রিক। আচরণবাদে তত্ত্ব ও গবেষণা হল সুবিন্যস্ত। আচরণবাদীদের মতানুসারে সুবিন্যস্ত ও পরস্পরের সঙ্গে যুক্তিসঙ্গতভাবে সম্পর্কযুক্ত প্রস্তাব ও ধারণার ভিত্তিতে বিভিন্ন অনুমানের সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্ট অনুমানসমূহ কঠোর গবেষণামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে তত্ত্বের ভিত্তি রচনা করে। আচরণবাদে তত্ত্ব ও গবেষণার সমন্বয়ের উপর জোর দেওয়া হয়। তবে ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও তত্ত্ব গঠনে আগ্রহী। তবে ঐতিহ্যবাদীদের তত্ত্ব হল মূল্যবোধ সমৃদ্ধ। কিন্তু আচরণবাদীরা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যহীন তত্ত্ব গঠনে আগ্রহী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আচরণবাদীদের মত অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠন, ঐতিহ্যবাদীদের মতে অসম্ভব।

একটি স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাদী এবং আচরণবাদী এই দুই গোষ্ঠীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অবদান অনস্বীকার্য। এই দুই গোষ্ঠীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। কিন্তু কোন দৃষ্টিভঙ্গিকেই একেবারে বাতিল করে দেওয়া যায় না। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ধারার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এখন অধিকতরভাবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও বর্তমানে পর্যবেক্ষণ, সংখ্যায়ন, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য গাণিতিক পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে। আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক পর্যালোচনা এমনকি ভৌত বিজ্ঞানের সাহায্য গ্রহণের উপরও জোর দেওয়া হচ্ছে।

আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির নামে অ-বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার পরিচয় দিয়েছে। আচরণবাদীরা বিষয়বস্তুর তুলনায় পদ্ধতি ও কৌশলের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা রাজনীতিক ঘটনাবলীর সামাজিক পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করেছেন। তার ফলে তথ্য ও পরিসংখ্যানের পর্যালোচনা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া চার্লসওয়ার্থ (J. C. Charlesworth) কর্তৃক সম্পাদিত Contemporary Political Analysis শীর্ষক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত The Limitations of Behaviouralism শীর্ষক রচনায় মূলফোর্ড সিবলী (Mulford Sibley) মন্তব্য করেছেন যে মূল্যবোধযুক্ত বিবেচনার কাঠামোর মধ্যেই আচরণবাদকে প্রয়োগ করা দরকার এবং কেবলমাত্র আচরণবাদী কলা-কৌশলের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে না। আচরণবাদে ব্যক্তির আচরণের উপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশকে উপেক্ষা করা হয়। অর্থাৎ আচরণবাদে অংশের আলোচনা করা হয়, সমগ্রের নয়। কিন্তু মূলফোর্ড সিবলী মন্তব্য করেছেন যে অংশের বিশ্লেষণ করা দরকার কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সমগ্রের সঙ্গে সেই সমস্ত অংশের সম্পর্কও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আবার প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির রাজনীতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করা যায় না।

আবার ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গিও ত্রুটিমুক্ত নয়। ঐতিহ্যবাদীরা প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য প্রদানের পক্ষপাতী। ঐতিহ্যবাদীদের প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনায় ব্যক্তির ভূমিকা অবহেলিত। কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনার ভিত্তিতে রাজনীতিক জীবনধারার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের আর্থ-সামাজিক ভিত্তির গুরুত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহ্যবাদীরা কিন্তু এ দিকটিকে অবহেলা করেছেন। দর্শন-প্রভাবিত ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গির অনুমানের সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতিক জীবন ও আচরণ পর্যালোচনার জন্য তথ্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য ও সমৃদ্ধির স্বার্থে ঐতিহ্যগত ও আচরণবাদী উভয় দৃষ্টিভঙ্গির অবদান অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহ্যবাদীরা ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক উপাদানের সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিকে প্রসারিত ও আলোচনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। অনুরূপভাবে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক করেছেন।