ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সংজ্ঞা:

দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মার্কসীয় দর্শনের মৌলিক ও প্রধান সূত্রগুলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসবাদী রাষ্ট্র-চিন্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হল দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কসীয় দর্শন হল বস্তুবাদী দর্শন। মার্কস নিজে ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism) কথাটা ব্যবহার করেননি। মার্কস-এঙ্গেলসের রচনায় এই শব্দ দু’টির একত্রে ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় না। তাঁদের রচনায় ‘উৎপাদনের বস্তুবাদী অবস্থা’ (Materialistic condition of production), ‘ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা’ (Materialistic conception of History) প্রভৃতি শব্দের ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। তবে মার্কসবাদীরা এই কথাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদেরই অংশ। মানবসমাজ ও তার ইতিহাসের প্রকৃতি আলোচনার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্বের প্রয়োগকেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা বলা হয়। ওয়েপার (Wayper) বলেছেন: “Historical materialism is the application of the principles of dialectical materialism to the development of society.” হান্ট (Carew Hunt)-এর মতানুসারে মানবিক সম্পর্কের বিশেষ ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগ হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। তিনি বলেছেন: “Historical materialism, or the materialistic interpretation of history is simply dialectical materialism to the particular field of human relations.” Dialectical and Historical Materialism শীর্ষক গ্রন্থে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল নীতিগুলিকে সমাজজীবনের অনুশীলনের ক্ষেত্রে প্রয়োগকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রধান নীতিসমূহকে মানবসমাজ ও তার ইতিবৃত্ত এবং সামাজিক জীবনধারার বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করাকে বলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (“Historical materialism is the extension of the principles of dialectical materialism to the study of social life, an application of the principles of dialectical materialism to the phenomena of the life of society, to the study of society and of its history.”)!

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অর্থ:

মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাসের ধারা ব্যাখ্যা করেছেন। ইতিহাসে যুগে যুগে সমাজের পরিবর্তন ও অগ্রগতির মধ্যে শ্রেণী-সংঘাত পরিলক্ষিত হয়। এই বিরোধ ও সংঘর্ষের ফলে সমাজ পরিবর্তিত, বিকশিত ও উন্নত হয়। সামগ্রিকভাবে সমাজের এই পরিবর্তন ও অগ্রগতির মূলে যে নিয়ন্তা শক্তি বা বিধিবিধান পরিলক্ষিত হয় সে বিষয়ে সাধারণ তত্ত্বই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। প্রকৃত প্রস্তাবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হল সমাজজীবনের যাবতীয় ঘটনাকে অনুধাবনের ক্ষেত্রে এক সাধারণ তত্ত্ব বা পদ্ধতি। মানবসমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও বৈপ্লবিক রূপান্তরের বিজ্ঞান হল এই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। সমাজজীবনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কযুক্ত। এ হল মানবসমাজের বিকাশের সর্বজনীন বিধি সম্পর্কিত এক বিজ্ঞান। এ হল ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় এক সর্বজনীন তত্ত্ব। সমগ্র সমাজজীবন, তার মৌলিক নীতিসমূহ এবং সমাজ-বিকাশের ক্ষেত্রে চালিকা শক্তি বা নির্ধারক বিচার-বিশ্লেষণের ব্যাপারে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হল বিজ্ঞানসম্মত উপায়বিশেষ। কেলে ও কোভালসন (V. Kelle & M. Kovalson) তাঁদের Historical Materialism: An outline of Marxist Theory of Society শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Historical materialism gives an insight into the objective logic of development by showing the laws governing the development of material production and establishing the dependence on it of all the other elements of social life.”

ইতিহাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য:

ডারউইন জীবজগতের বিবর্তন সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ধারাটি (Laws of evolution of life) আবিষ্কার করেছেন। তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাসের বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক মূল সূত্রসমূহ। এঙ্গেলস বলেছেন: “Just as Darwin discovered the law of evolution in organic nature, so Marx discovered the law of evolution in human history.” মানব ইতিহাসের পরিবর্তন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা এত দিন ধরে। রাজনীতিক কারণসমূহের উপর জোর দিয়ে এসেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে মার্কসই প্রথম বললেন যে মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন হল খাদ্য, পানীয়, আশ্রয় ও পরিধেয়। রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি চর্চার আগে প্রাথমিক প্রয়োজন পূরণের জন্য মানুষকে কাজ করতে হয়। কিভাবে মানুষ উৎপাদন করে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষ কি রকম পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এসবের মধ্যেই নিহিত আছে একটি যুগের ইতিহাসের নির্যাস। ইতিহাসের এই নির্যাসটুকু অনুধাবন করতে পারলে সংশ্লিষ্ট যুগের সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রভৃতি সব বিষয়ে অবহিত হওয়া যাবে। অতএব মানুষের চিন্তাধারা নয়, জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থনীতিক ব্যবস্থাই সমাজ পরিবর্তনের মূলে বর্তমান। হাণ্ট (Carew Hunt) বলেছেন: “Man has to live before he can start to think.” মানবসমাজ ও ইতিহাসের পরিবর্তন ও অগ্রগতি সম্পর্কিত মার্কসীয় এই জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ‘মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের মূলকথা’ (The Fundamentals of Marxist-Leninist Philosophy) গ্রন্থে বলা হয়েছে: “Marx and Engels extended dialectical materialism to the study of society and its history and evolved a scientific theory of the general laws of social development. This theory is Historical Materialism.” মরিস কর্নফোর্থ তাঁর Dialectical Materialism শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The general theory of the motive forces and laws of social change, developed on the basis of Marx’s discoveries, is known as the materialist conception of history, or historical materialism.”

তিনটি সূত্র: ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে মানবসমাজের গঠন ও প্রকৃতি অনুধাবনের ক্ষেত্রে তিনটি মুখ্য সূত্র প্রয়োগ করা হয়। মরিস কর্নফোর্থ (Maurice Cornforth)-কে অনুসরণ করে এই তিনটি মূলসূত্র উল্লেখ করা যায়। সূত্র তিনটি হল: (১) সমাজের পরিবর্তন ও বিকাশ প্রকৃতির মতই সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়মের নিয়ন্ত্রণাধীন; (২) রাজনীতিক তত্ত্ব, ভাবাদর্শ, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়। সমাজের বৈষয়িক জীবনযাত্রার বিকাশের ভিত্তিতে, এবং (৩) বাস্তবে বৈষয়িক জীবনযাত্রার পদ্ধতি কর্তৃক সৃষ্ট মতবাদ ও প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। অর্থাৎ মার্কসীয় দর্শন ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে যে, মানব ইতিহাসের সকল ঘটনা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, বিচ্ছিন্ন হয়।

মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: মার্কসের মতে অর্থনীতিই হল সমাজের ভিত। ইতিহাস মূলত আর্থনীতিক অবস্থার দ্বারা আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। ধনোৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার বিধানগুলিই এই বিবর্তনের প্রধান কারণ। মানবসমাজের রাজনীতিক, সামাজিক ও অন্যান্য দিকগুলি আর্থনীতিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ আর্থনীতিক বনিয়াদ উপরি-কাঠামো (Super-structure)-কে প্রভাবিত করে। সমাজ পরিবর্তন ও শ্রেণী-সম্পর্কের মূল কারণ হল সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা। হাণ্ট বলেছেন: “The economic system of society…the substructure (Unterbau), always provides the real basis, and the religion, laws and institutions of society are superstructure (Oberbau) built upon and determined by it.” মার্কস আর্থনীতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে এবং শ্রেণী-সংগ্রামের কষ্টিপাথরে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেছেন যে, সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি অধ্যায়ে পরস্পর বিরোধী স্বার্থযুক্ত শ্রেণীসমূহের অস্তিত্ব সমকালীন আর্থনীতিক বাস্তবতা অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ফলশ্রুতি। এই হল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কেবল সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস ব্যাখ্যা করে না; মানুষ কিভাবে সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে তার পথও নির্দেশ করে। এর উদ্দেশ্য হল শ্রেণীহীন, শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ সৃষ্টির পথের সন্ধান দেওয়া।

আর্থনীতিক জীবনধারা সামাজিক ও রাজনীতিক জীবনধারাকে প্রভাবিত করে: বস্তুত মানবসমাজের সমস্ত লিখিত ইতিহাস হল শ্রেণী-সংগ্রামেরই ইতিহাস। কমিউনিস্ট ইস্তাহারে এঙ্গেলস বলেছেন: “মানুষের ইতিহাস শ্রেণী-সংগ্রামেরই ইতিহাস, এ সংগ্রাম শোষক ও শোষিতের মধ্যে; সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে শাসক ও শাসিত শ্রেণীর মধ্যে; …।” তিনি আরও বলেছেন যে, “ইতিহাসের প্রতি যুগের সমকালীন আর্থনীতিক উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতি এবং তা থেকে অনিবার্যভাবে উদ্ভূত সামাজিক সংগঠন সেই যুগের রাজনীতিক চিন্তাধারার ইতিহাসের ভিত্তি রচনা করে; এবং একমাত্র এর দ্বারাই ইতিহাস ব্যাখ্যা করা যায়।” মানুষের সামাজিক ও রাজনীতিক জীবনধারা তার আর্থনীতিক জীবনধারারই প্রতিবিম্ব। সমাজবিকাশের সাধারণ বিধান উৎপাদনের সামাজিক পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত। মানুষের জীবনধারণের জন্য বস্তুগত উপায় উৎপাদনের পদ্ধতি সামগ্রিকভাবে সামাজিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করে। স্ট্যালিনও অনুরূপভাবে বলেছেন যে, জীবনধারণের জন্য উপকরণ সংগ্রহের উপায় বা বৈষয়িক দ্রব্যাদি উৎপাদনের পদ্ধতি মানসমাজের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে নিয়ন্তা শক্তি হিসাবে কাজ করে।

উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্ব:

সুতরাং মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে উৎপাদন পদ্ধতিই হল সকল কিছুর মূল। প্রধানত উৎপাদন-পদ্ধতির পরিবর্তনই সমাজ-কাঠামোর পরিবর্তন সূচিত করে। প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু ও শক্তির উপর মানুষের শ্রমশক্তি প্রয়োগ করে বৈষয়িক দ্রব্য সৃষ্টি করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে উৎপাদন-পদ্ধতি (mode of production)। উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যেমন সংযোগ স্থাপিত হয়, তেমনি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মার্কস বলেছেন: “উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ কেবল প্রকৃতির উপরই কাজ করে না, পরস্পরের উপরও কাজ করে। বিশেষ সহযোগিতা এবং তাদের কাজের পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদন সম্ভব হয়। অর্থাৎ উৎপাদন হল সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক উৎপাদন। মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতায় উৎপাদন করে।”

উৎপাদন পদ্ধতির দু’টি দিক

উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক: উৎপাদন পদ্ধতি বলতে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের সমন্বয়কে বোঝায়। যে কোন নির্দিষ্ট সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি (mode of production) গড়ে উঠে উৎপাদন শক্তি (Productive forces) এবং উৎপাদন-সম্পর্ক (Production relations)-এর সমন্বয়ের ভিত্তিতে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপিত হয় উৎপাদন শক্তির মাধ্যমে। এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক হল উৎপাদন-সম্পর্ক। উৎপাদন শক্তি বলতে শ্রমিক ও তার শ্রমশক্তি এবং আনুষঙ্গিক হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি প্রভৃতিকে বোঝায়। আর উৎপাদন-সম্পর্ক বলতে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষের পারস্পরিক সংযোগ বা সম্পর্ককে বোঝায়। স্ট্যালিনের মতে “…উৎপাদন-কার্যক্রমের মধ্যে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কই মানুষের উৎপাদন সম্পর্ক।” উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ছাড়াও উৎপাদনের উপায়ের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করে। উৎপাদনের উপায় (means of production) হল উৎপাদন শক্তির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন উপকরণ এবং কাঁচামাল, জমিজমা, ঘর প্রভৃতি। সমাজের সম্পত্তি-সম্পর্ক (Property relations) গড়ে ওঠে এই উৎপাদনের উপায়ের উপর মালিকানার ভিত্তিতে। উৎপাদনের কাজে মানুষকে পরস্পরের সম্পর্কে আসতেই হয়। কারণ উৎপাদন বলতে সামাজিক উৎপাদন বোঝায়। স্ট্যালিনকে অনুসরণ করে বলা যায় যে, বস্তুগত মূল্য উৎপাদনে মানুষকে কোন-না-কোন পারস্পরিক উৎপাদন সম্পর্কে আবদ্ধ হতে হয়। এই সম্পর্ক শোষণহীন এবং পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার হতে পারে; প্রভুত্ব ও অধীনতার সম্পর্ক হতে পারে; এ আবার এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উত্তরণের অন্তর্বর্তীকালীন সম্পর্কও হতে পারে। তবে সকল সমাজব্যবস্থাতেই অপরিহার্যভাবে এক ধরনের উৎপাদন সম্পর্ক বর্তমান থাকে। উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সূচিত করে। অর্থাৎ উৎপাদন পদ্ধতির দু’টি দিক—উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ফলেই উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়। আর উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সমাজব্যবস্থাও বদলায়। সমাজের আর্থনীতিক বনিয়াদ অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র উপরি কাঠামো অর্থাৎ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ভাবধারার অল্পবিস্তর দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। মার্কস (Karl Marx) বলেছেন : “With the change of the economic foundation the entire immense super-structure is more or less rapidly transformed.”

উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য:

মানবসমাজের বিকাশের ইতিহাস বলতে উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাসকে বোঝায়। এই পরিবর্তনের কারণ হল উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে অসংগতি ও দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব এবং তার ফলে পরিবর্তনের কারণ উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বর্তমান। জে. ভি. স্ট্যালিন “দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ” শীর্ষক গ্রন্থে উৎপাদন ব্যবস্থার কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন।

[1] উৎপাদন ব্যবস্থা গতিশীল: উৎপাদন ব্যবস্থা গতিশীল। এ ক্রমাগত পরিবর্তিত ও উন্নত হয়। এই উৎপাদন-ব্যবস্থার গতি সবসময়ই অনুন্নত অবস্থা থেকে উন্নত অবস্থার দিকে থাকে। এই অগ্রগতির সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে সমাজব্যবস্থা, সামাজিক ধ্যান-ধারণা, রাজনীতিক চিন্তা-ভাবনা ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন ঘটে। স্ট্যালিন বলেছে: “সমাজ-বিকাশের ইতিহাস সর্বোপরি উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস… জনগণের পারস্পরিক উৎপাদন-সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ইতিহাস।” বস্তুত উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাসই হল সমাজব্যবস্থার ইতিহাস। এবং এই উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে মানুষের জীবনধারা বিন্যস্ত হয়ে থাকে। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে মানুষের সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক, আধ্যাত্মিক প্রভৃতি মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও অপরিহার্যভাবে পরিবর্তন ঘটে। মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা থেকে মানবসমাজের সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের পর্যায় পর্যন্ত এই বিষয়টি স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়।

[2] উৎপাদন-শক্তি সর্বাধিক গতিশীল: উৎপাদনের সর্বাধিক গতিশীল ও বিপ্লবী উৎপাদন হল উৎপাদন-শক্তি। উৎপাদন শক্তিই প্রথমে পরিবর্তিত ও উন্নত হয় এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে নূতন উৎপাদন-সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। তবে উৎপাদন-সম্পর্কও উৎপাদন শক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন ও বিকাশের মধ্যেই উৎপাদনের পরিবর্তন ও বিকাশ নিহিত থাকে। আবার সমাজব্যবস্থার স্থায়িত্ব উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের সামঞ্জস্যের উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের বিরোধ বাধলে সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা রাজনীতিক মতাদর্শ প্রভৃতির পরিবর্তন ঘটে। যখন নতুন উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের সৃষ্টি হয় তখন পুরাতন সমাজব্যবস্থার অবস্থান ঘটে। স্ট্যালিন বলেছেন, “ইতিহাসে সমাজের উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন ও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে মানুষের উৎপাদন ও আর্থনীতিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটেছে।”

[3] পুরাতন ব্যবস্থার মধ্যেই নতুন উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন- সম্পর্কের সৃষ্টি: নূতন উৎপাদন শক্তি এবং তদনুযায়ী উৎপাদন-সম্পর্ক পুরাতন ব্যবস্থার ধ্বংসের পর বা পুরাতন ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি হয় না। পুরাতন ব্যবস্থার মধ্যেই নূতন উৎপাদন-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্ক মানুষের উদ্দেশ্যমূলক ও সচেতন চেষ্টা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়। কারণ (ক) মানুষ স্বেচ্ছায় কোন বিশেষ উপাদান প্রক্রিয়া বেছে নিতে পারে না। সমাজে প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্ক মেনে নিয়ে তাকে উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে হয়; (খ) মানুষ উৎপাদনের হাতিয়ার বা উৎপাদন শক্তির কোন উপাদানের উন্নতি বিধানের ক্ষেত্রে তার সামাজিক ফলাফল বিবেচনা না করে কেবল প্রাত্যহিক স্বার্থ, প্রত্যক্ষ ও বাস্তব লাভ-অলাভের এবং শ্রম লাঘবের কথা চিন্তা করে। মার্কস বলেছেন: “উৎপাদন-সম্পর্কসমূহ উৎপাদন ব্যবস্থার বাস্তব শক্তির উন্নতির নির্দিষ্ট স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই গড়ে উঠে।” ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে তিনি আরও বলেছেন, “প্রত্যেক পুরাতন সমাজব্যবস্থার গর্ভে নূতন সমাজের উদ্ভবের সময় শক্তি ধাত্রী হিসাবে কাজ করে।” তাঁর নিজের কথায়: “Force is the midwife of every old society pregnant with a new one.” এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত উৎপাদন শক্তির বিকাশ ও উৎপাদন-সম্পর্ক স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে। কিন্তু সেই স্তরের পর উৎপাদন বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে প্রচলিত উৎপাদন-সম্পর্ক বা সম্পত্তি সম্পর্কের ধারক শ্রেণী। এই অবস্থায় উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন বিনা বাধায় হয় না, শ্রেণী-সংঘর্ষ ও বিপ্লবের মাধ্যমে হয়। এই সময় পুরাতন উৎপাদন সম্পর্ককে বাতিল করার জন্য নতুন প্রগতিশীল মতাদর্শ ও ধ্যান-ধারণা দরকার হয়ে পড়ে। অগ্রগতির স্বতঃস্ফূর্ত পদ্ধতির জায়গায় মানুষের সচেতন কর্মকাণ্ড ও ধীরগতি বিবর্তনের জায়গায় বিপ্লব দেখা দেয়। স্ট্যালিন বলেছেন: “The spontaneous process of development yield places to conscious actions of men…evolution to revolution.”

উৎপাদন শক্তি (Productive Forecs), উৎপাদন সম্পর্ক (Production Relations) এবং উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।

উৎপাদন-শক্তি

শ্রমিক ও তার শ্রমশক্তি এবং আনুষঙ্গিক হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি প্রভৃতিকে উৎপাদন শক্তি বলা হয়। উৎপাদন শক্তি গঠিত হয় উৎপাদনের উপায় এবং এই উৎপাদনের উপায়ে গতি সঞ্চারিত করার ক্ষেত্রে নিযুক্ত প্রয়োজনীয় শ্রমের হাতিয়ার ও অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে। স্ট্যালিন তাঁর Dialectical and Historical Materialism শীর্ষক গ্রন্থে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের একটি অর্থবহ সংজ্ঞা দিয়েছেন। উৎপাদনের উপায় বা উপাদানের মাধ্যমে বৈষয়িক দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করা হয়। এবং জনগণ উৎপাদনের অভিজ্ঞতা ও শ্রম-কৌশলের শক্তির সাহায্যে উৎপাদনের উপাদানগুলিকে ব্যবহার করে ও বৈষয়িক সম্পদ-সামগ্রী সৃষ্টি করে। সমাজের উৎপাদন শক্তি গঠিত হয় শ্রমের সংশ্লিষ্ট হাতিয়ার এবং বৈষয়িক সম্পদ সৃষ্টিকারী মানুষকে নিয়ে। এ প্রসঙ্গে শ্রমের সামগ্রী (object of labour), শ্রমের উপকরণ (implements of labour) এবং শ্রমের উপায় (means of labour) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক। কারণ বৈষয়িক সম্পদের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য উৎপাদনের উপায় বা উপকরণসমূহের (means of production) সাহায্য দরকার। উৎপাদনের উপায় বা উপকরণ গড়ে উঠে শ্রমের সামগ্রী ও শ্রমের উপকরণের সমন্বয়ের ভিত্তিতে।

শ্রমের সামগ্রী, উপকরণ ও উপায়:

শ্রমের সামগ্রী বলতে সেই সমস্ত বস্তুকে বোঝায় মানুষ যার মাধ্যমে নিজের স্বার্থে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে ও রূপান্তরের চেষ্টা করে। মানুষ প্রয়োজনীয় বস্তু উৎপাদনের উদ্দেশ্যে লোহা, কাঠ, কয়লা প্রভৃতি বস্তু ব্যবহার করে। এগুলিকেই বলে শ্রমের সামগ্রী। শ্রমের উপকরণ বলতে সেই সমস্ত যান্ত্রিক ও রাসায়নিক শক্তিকে বোঝায় যার দ্বারা মানুষ শ্রমের সামগ্রীর উপর প্রভাব বিস্তার ও নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারের চেষ্টা করে। শ্রমের উপকরণের উদাহরণ হিসাবে কাস্তে, হাতুড়ি, কোদাল, বেলচা এবং অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক উপাদানসমূহকে বোঝায়। শ্রমের উপায় সম্পর্কেও আলোচনা করা দরকার। কারণ উৎপাদনের ধারাকে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে শ্রমের সামগ্রী ও শ্রমের উপকরণ যথেষ্ট বিবেচিত হয় না। তার জন্য শ্রমের উপায়েরও প্রয়োজন আছে। যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, শক্তির বিভিন্ন উৎস, কারখানা-গৃহ প্রভৃতি শ্রমের উপায় হিসাবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ শ্রমের উপায় গঠিত হয় পণ্য-সামগ্রী কিভাবে উৎপাদন করা হয় এবং এই উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে হাতিয়ার ব্যবহার করা হয় তাকে নিয়ে।

ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রকৃতির উৎপাদন শক্তি:

উৎপাদন শক্তি ব্যক্তিগত (Individual) ও সামাজিক (Social) এই দু’ধরনের হতে পারে। উৎপাদন শক্তিকে তখনই ব্যক্তিগত প্রকৃতির বলা হয়, যখন শ্রমের হাতিয়ার সচল রাখার ক্ষেত্রে ব্যক্তির শ্রম কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে এবং যখন ব্যক্তির প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদনের উদ্দেশ্যে উৎপাদনের উপকরণ প্রয়োগ করা হয়। অপরদিকে উৎপাদন শক্তিকে তখনই সামাজিক প্রকৃতির বলা হয়, যখন সমষ্টিগত শ্রমের মাধ্যমে শ্রমের হাতিয়ারকে সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হয়।

উৎপাদন-শক্তির বিকাশ:

প্রকৃতির উপর মানুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার মাত্রা উৎপাদন শক্তির বিকাশের মাত্রার উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন শক্তির বিকাশের মাত্রা যদি অধিক হয়, তা হলে প্রকৃতির উপর মানুষের কর্তৃত্ব কায়েমের মাত্রাও অধিক হবে। উৎপাদন শক্তিই উৎপাদনের বিকাশের ক্ষেত্রে পরিচালিকা শক্তি হিসাবে বিবেচিত হয়। এই উৎপাদন শক্তির দু’টি প্রধান উপাদান আছে। এই দু’টি উপাদান বলতে মানুষ ও তার হাতিয়ারকে বোঝায়। উৎপাদনের হাতিয়ার এবং মানুষের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার উপর উৎপাদন-শক্তির বিকাশের মাত্রা নির্ভরশীল। উৎপাদনের উপায়ের উন্নতি সাধন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের শ্রমই হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের নিরন্তর উদ্যোগ-আয়োজনের ফলশ্রুতি হিসাবে শ্রমের হাতিয়ারসমূহ ক্রমশ উন্নত হতে থাকে। এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, দক্ষতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং এইভাবে উৎপাদনের উপাদানে মানুষ গতি সঞ্চারিত করে।

উৎপাদন সম্পর্ক:

উপাদান প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন-সম্পর্কও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎপাদন প্রতিক্রিয়াকে সচল রাখার ক্ষেত্রে উৎপাদন-সম্পর্কের তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। প্রকৃত প্রস্তাবে উৎপাদন-সম্পর্ককে বাদ দিয়ে উৎপাদন-প্রক্রিয়া সচল থাকতে পারে না। মনীষী মার্কসের মতানুসারে উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ প্রকৃতির উপর ক্রিয়া করে এবং তাদের পরস্পরের উপরও ক্রিয়া করে। উৎপাদন সম্ভব হয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান ও বিশেষ এক ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে। মানুষ নিজের প্রয়োজন পূরণের স্বার্থে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের সামিল হয়। উৎপাদনের কাজে মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে ব্যবহারের চেষ্টা করে। এই চেষ্টা করতে হয় সংঘবদ্ধভাবে। প্রত্যেক মানুষকে উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোন না কোন ভাবে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। মানুষের সংঘবদ্ধ কার্যকলাপের মাধ্যমে শ্রমের হাতিয়ার, উপকরণ, উপায় এবং পণ্য-সামগ্রী উৎপাদিত হয়। উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত মানুষের পারস্পরিক এই সম্পর্ককেই উৎপাদন-সম্পর্ক বলে।

উৎপাদন-সম্পর্কের প্রকৃতি:

প্রকৃতিগত বিচারে উৎপাদন সম্পর্ক সব সময় এক ধরনের হয় না। উৎপাদন-সম্পর্ক সকল সমাজব্যবস্থায় অভিন্ন প্রকৃতির হয় না। উৎপাদনের উপাদানের মালিকানার উপর উৎপাদন সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ভরশীল। অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক হল প্রধানত মালিকানার সম্পর্ক। উৎপাদনের উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা অথবা সমগ্র সমাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে এক ধরনের উৎপাদন সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অন্য এক ধরনের উৎপাদন-সম্পর্ক স্থাপিত হয়। উৎপাদন-উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য, প্রভুত্ব, শোষণ প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ উৎপাদনের উপাদানের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে সমবণ্টন, সমমর্যাদা ও সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

উৎপাদন-শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক:

উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টিও আলোচনা করা দরকার। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক হল নির্ভরশীলতার সম্পর্ক। উৎপাদন-সম্পর্ক গড়ে উঠে উৎপাদন শক্তি অনুসারে। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদনের উপাদানের প্রকৃতি ও বিকাশের মাত্রার উপর উৎপাদন সম্পর্ক নির্ভরশীল। উৎপাদন শক্তিকে বাদ দিয়ে উৎপাদন সম্পর্কের আলোচনা করা যায় না। অনুরূপভাবে উৎপাদন সম্পর্ককে বাদ দিয়ে উৎপাদন শক্তির আলোচনা করা যায় না। বস্তুত বিচ্ছিন্নভাবে এ দু’টির কোনটিরই আলোচনা করা যায় না। উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে উঠে। কোন সমাজব্যবস্থায় কখনই স্বতন্ত্রভাবে উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে উঠে না। উৎপাদন শক্তির মধ্যে উৎপাদন সম্পর্ক এক নির্দিষ্ট ধরনের সামাজিক বৈশিষ্ট্য আরোপ করে থাকে। অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্কের উপর উৎপাদন শক্তিগুলির সামাজিক বৈশিষ্ট্য নির্ভরশীল। প্রকৃত প্রস্তাবে উৎপাদন-সম্পর্ক উৎপাদন শক্তির উপর সক্রিয়ভাবে প্রভাব কায়েম করে থাকে।

উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সামঞ্জস্য:

উৎপাদন-সম্পর্ক উৎপাদন শক্তির উপর নির্ভরশীল থাকে। উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন ও অগ্রগতি ঘটে। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ও অগ্রগতি ঘটে। প্রথমে পরিবর্তিত, বিকশিত ও উন্নত হয় উৎপাদন শক্তি। এবং তার পর বিকশিত উৎপাদন শক্তির উপর নির্ভর করে এবং সেই শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে উৎপাদন সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। উৎপাদন শক্তি হল সর্বাধিক গতিশীল ও পরিবর্তনকারী উপাদান। উৎপাদন-ব্যবস্থার উন্নতিকল্পেও এই উৎপাদন শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটলে, সত্বর বা কিছুটা দেরিতে অনুরূপভাবে উৎপাদন সম্পর্কেরও পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটে। উৎপাদন শক্তির বিকাশকে উৎপাদন-সম্পর্কও প্রভাবিত করে। উৎপাদন শক্তির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে উৎপাদন-সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকলে উৎপাদন-শক্তির দ্রুত বিকাশ ও অগ্রগতি সহজে সম্ভব হয়। উৎপাদন শক্তির থেকে উৎপাদন-সম্পর্ক দীর্ঘকাল পশ্চাৎপদ থাকতে পারে না। অতি সত্বর বা কিছুটা দেরিতে উৎপাদন-সম্পর্ক বিকশিত ও উন্নত উৎপাদন শক্তির প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। অর্থাৎ উৎপাদন-সম্পর্ক ও উৎপাদন শক্তির মধ্যে এক রকম অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্যের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। উৎপাদন-সম্পর্ক গড়ে উঠে উৎপাদন-শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে।

উৎপাদন-শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ:

তবে সামঞ্জস্যই উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদন শক্তির মধ্যে সম্পর্কের একমাত্র প্রকাশ নয়। এক্ষেত্রে বিরোধের ঘটনাও স্বাভাবিক। উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন, বিকাশ ও উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। তবে তা মন্থর গতিতে হতে পারে বা দ্রুতলয়ে হতে পারে। যাই হোক পরিবর্তিত, বিকশিত ও উন্নত উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থার স্বার্থে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নতুন উৎপাদন সম্পর্ক অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু সমকালীন প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থ পুরাতন উৎপাদন-সম্পর্কের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এই শ্রেণী পুরাতন উৎপাদন সম্পর্ককে অব্যাহত রাখতে চায়। তারা প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের বিরোধিতা করে। এই অবস্থায় পুরাতন ও পশ্চাদপদ উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে নতুন ও বিকশিত উৎপাদন-শক্তির অসামঞ্জস্য প্রকট হয়ে পড়ে এবং বিরোধ দেখা দেয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে নতুন ও উন্নততর উৎপাদন শক্তির বিকাশের পথে পুরাতন ও পশ্চাদপদ উৎপাদন-সম্পর্ক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এই বিরোধের অবসান হয় তখনই যখন পুরাতন ও পশ্চাদপদ উৎপাদন সম্পর্কের বিনাশ ঘটে এবং নতুন ও উন্নততর উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নতুন উৎপাদন-সম্পর্ক গড়ে উঠে। তখন উৎপাদন-শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে আর বিরোধ থাকে না। উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যের সৃষ্টি হয়।

সামঞ্জস্য বিধানের নীতি: পরিবর্তিত নতুন উৎপাদন-সম্পর্ক উৎপাদন-শক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। উৎপাদন শক্তির বিকাশ ঘটে ও উন্নতি সাধিত হয়। তখন আবার সমকালীন উৎপাদন সম্পর্ক পশ্চাদপদ হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে বিকশিত ও উন্নততর উৎপাদন শক্তির অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। উৎপাদন ব্যবস্থার ভিতরে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় আবার নতুন উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদন-সম্পর্ক গড়ে উঠলে উৎপাদন ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ বিরোধের অবসান ঘটে। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে পুনরায় সামঞ্জস্য সাধিত হয়।

সামাজিক বিপ্লব: মার্কসীয় দর্শনে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের বিকাশ সাধন ও রূপান্তরের ইতিহাস পর্যালোচনা করা হয়েছে। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বিরোধের ফল হিসাবে পুরাতন সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটে। তার জায়গায় এক নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে। এইভাবে পুরাতন একটি সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত হয় এবং নতুন একটি সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। একে সামাজিক বিপ্লব বলে। এই সামাজিক বিপ্লবের আর্থনীতিক ভিত্তি হল উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ।

উৎপাদন সম্পর্কের ঐতিহাসিক বিবরণ

উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই উৎপাদন সম্পর্ক ও আর্থনীতিক সম্পর্ক স্থিরীকৃত হয়। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মানবসমাজের আদিম অবস্থা থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে উৎপাদন শক্তির উন্নতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে উৎপাদন-সম্পর্ক এবং আর্থনীতিক সম্পর্কের উন্নতি ও পরিবর্তন ঘটে।

(১) আদিম যৌথ সমাজ: আদিম যৌথ সমাজব্যবস্থায় সমগ্র সমাজই ছিল উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিক। তখনকার উৎপাদন শক্তির প্রকৃতির সঙ্গে এই উৎপাদন সম্পর্ক ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই সময় সকলে একত্রে পরিশ্রম করত এবং জীবিকার ব্যবস্থা করত। মামুলি ধরনের উৎপাদন-উপাদান এবং উৎপন্ন সামগ্রীর উপর ছিল সকলের মালিকানা। এই সময় উৎপাদনের উপকরণের উপর কোন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না; ছিল না কোন রকম শ্রেণীভেদ বা শ্রেণী-শোষণ।

(২) দাস-সমাজ: দাস-সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণ এবং উৎপন্ন দ্রব্যের উপর সমগ্র সমাজের মালিকানার পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম হয়। ক্রমশ মানুষ পশুপালন, কৃষিকর্ম ও প্রাথমিক কারিগরি আয়ত্ত করেছে। বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত উৎপাদনে শ্রমবিভাগের সৃষ্টি হয়েছে। এইভাবে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময় শ্রেণীভেদ ও শ্রেণী-শোষণের সূত্রপাত হয়েছে। দাস সমাজে দাস মালিকরাই ছিলেন উৎপাদনের উপকরণ এবং দাসদের মালিক। উৎপাদন ব্যবস্থার এই সম্পর্ক সেই যুগের অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

(৩) সামন্ত সমাজ: তারপর সমস্ত সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণগুলির মালিক হল সামন্তপ্রভুরা, আর উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকরা হল ভূমিদাস (serf)। এই ছিল এই সময়কার উৎপাদন-সম্পর্ক। তবে সামন্তশ্রেণীর অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনের উপাদান ও নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপারে কৃষক এবং কারিগরদের অধিকার স্বীকৃত ছিল। তখনকার অবস্থার সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থার এই সম্পর্ক ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। এই সময় কৃষির যথেষ্ট উন্নতি হয় এবং হস্তশিল্পের পাশাপাশি যন্ত্রশিল্পের উদ্ভব হয়। তখন দাসদের পরিবর্তে উৎসাহী শ্রমিকের প্রয়োজন দেখা দেয়। এখনকার অপেক্ষাকৃত উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থায় ভূমিদাস শ্রেণীর আবির্ভাব হল। এই সময় সমাজব্যবস্থায় সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাসের মধ্যে শ্রেণীভেদ, শ্রেণী-শোষণ ও শ্রেণী-দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল। সামন্ত সমাজের শোষণমূলক উৎপাদন-সম্পর্ক যন্ত্রশিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হল। তারফলে সামন্ত সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটলো এবং পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হল।

(৪) পুঁজিবাদী সমাজ: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের যাবতীয় উপকরণের মালিক হল পুঁজিপতি শ্রেণী। আর শ্রমিকদের জীবনধারণের জন্য পুঁজিপতিদের কাছে শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তির অভাবনীয় উন্নতি ও বিকাশ ঘটে। তার ফলে দ্বন্দ্ব ও সংকটের সৃষ্টি হয় এবং তা তীব্রতর হয়। কারণ এই সময় উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কলকারখানায় নিযুক্ত হয়। তার ফলে উৎপাদনে সামাজিক বৈশিষ্ট্য আসে। তখন সামাজিক উৎপাদনের সঙ্গে ব্যক্তিগত মালিকানার উৎপাদন সম্পর্ক সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে। উৎপাদন পদ্ধতির সামাজিক প্রকৃতির কারণে উৎপাদনের উপকরণগুলির উপর সামাজিক মালিকানা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের অবসান এবং উৎপাদনের উপকরণের উপর সামাজিক মালিকানা এবং শোষণহীন সম্পর্ক স্থাপন জরুরী হয়ে পড়ে। প্রকৃত প্রস্তাবে উৎপাদন শক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে উৎপাদন-সম্পর্কেরও পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ উৎপাদন শক্তির বিকাশের উপর উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশ নির্ভরশীল।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সমালোচনা:

বিরুদ্ধবাদী চিন্তাবিদ্‌গণ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কস-এর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। সমালোচকদের যুক্তিগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়।

(১) আর্থনীতিক উপাদানের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ: মানবসমাজের ইতিবৃত্তি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কস আর্থনীতিক শক্তিসমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু কেবলমাত্র আর্থনীতিক উপাদানই এককভাবে ইতিহাসের ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। আর্থনীতিক উপাদানের মত ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি অন্যান্য বিষয়ও মানুষের সামাজিক ও রাজনীতিক জীবনধারাকে প্রভাবিত করতে পারে। মার্কস এই সত্যটিকে উপলব্ধি করতে পারেননি। রাসেল বলেছেন: “Larger events in our political life are determined by the interaction of material conditions and human passions.” মানুষের কর্মপ্রেরণার উৎস কেবলমাত্র আর্থনীতিক প্রয়োজনের মধ্যে বর্তমান এমন নয়। ধর্মবোধ, আদর্শ, ভাবাবেগ প্রভৃতিও মানুষকে কর্মপ্রেরণা যোগায়।

(২) আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ: মার্কসবাদ-বিরোধীদের মতানুসারে মার্কসবাদ হল আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ। এবং এই আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদের মাধ্যমে মার্কসবাদ নিয়তিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কার্ল পপার (K. R. Popper) ও মার্কসবাদ-বিরোধী বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে পপারের The Open Society and Its Enemies গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতানুসারে মার্কসবাদে আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তিনি ‘সমাজতাত্ত্বিক নিয়ন্ত্ৰণবাদ’ হিসাবেও মার্কসীয় পদ্ধতিকে অভিযুক্ত করেছেন। মার্কসকে পপার ভণ্ড-ভবিষ্যদ্বক্তা (false prophet) হিসাবেও অভিযুক্ত করেছেন। কারণ মার্কসের কিছু ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে রূপায়িত হয়নি।

(৩) শ্রেণীভেদ ও শ্রেণীসংঘর্ষের সমালোচনা: ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যায় সমাজের সকল ইতিহাসকে দু’টি দ্বন্দ্বশীল শ্রেণীর সংঘর্ষের ইতিহাস হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই ধারণাও সঠিক নয়। ম্যাকাইভার বলেছেন: “It is an exaggeration to say that the history of states has been in effect nothing more than the history of class-struggle, that class-struggle is the immediate driving force in history….” মানব ইতিহাসে দ্বন্দ্ব-বিরোধ ছাড়াও সহযোগিতা-সম্প্রীতির নজিরও কম নেই। তাছাড়া সমাজে বিত্তহীন ছাড়াও বহু মধ্যবিত্ত শ্রেণী থাকে। এই সমস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরস্পর বিরোধী সর্বহারা বা বণিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়।

(৪) অসম্পূর্ণ: ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অসম্পূর্ণ। কারণ উৎপাদনের উপাদানসমূহের পরিবর্তনের মূল কারণের সন্ধান এই তত্ত্বে পাওয়া যায় না। অথচ উৎপাদনের উপকরণগুলির পরিবর্তনের কারণ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলে ইতিহাসকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।

(৫) বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামো তত্ত্বের সমালোচনা: অর্থনীতি যেমন দার্শনিক তত্ত্ব, আদর্শ প্রভৃতিকে প্রভাবিত করে, দার্শনিক তত্ত্ব, আদর্শ প্রভৃতিও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর সাম্যবাদী আদর্শের দ্বারা পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার অর্থনীতি প্রভাবিত হয়েছে। সমালোচকরা তাই অর্থনীতিকে বনিয়াদ এবং দার্শনিক তত্ত্ব, আদর্শ প্রভৃতিকে উপরি-কাঠামো হিসাবে স্বীকার করতে চান না। এ প্রসঙ্গে কোলাকাউস্কি (L. Kolakowski) ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর Main Current of Marxism শীর্ষক গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কোলাকাউস্কি ভিত্তি ও উপরি-সৌধ সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বকে সমর্থন করেন নি। ভিত্তি ও উপরি-সৌধের পারস্পরিক সম্পর্ক বা প্রভাব প্রসঙ্গে মার্কসীয় ব্যাখ্যাকে তিনি স্বীকার করেননি। আবার আর্থনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়াও অনেক সময় নতুন ভাবধারা ও মতাদর্শের ভিত্তিতে নতুন সমাজের উদ্ভব হয়।

(৬) আর্থনীতিক উপাদানই ক্ষমতার একমাত্র ভিত্তি নয়: উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিকানা যেমন মানুষকে ক্ষমতাশালী করে, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তি, দূরদর্শিতা, সাহস প্রভৃতি গুণাবলীর গুরুত্বও এক্ষেত্রে কম নয়। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যিনি বা যাঁরা ক্ষমতাসীন হন তাঁর বা তাঁদের এই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কারণ হিসাবে আর্থনীতিক উপাদানের কথা বলা যায় না। আবার মধ্যযুগে পোপের অবিসংবাদিত কর্তৃত্বের কারণ হিসাবে আর্থনীতিক উপাদানকে নির্দেশ করা যায় না।

(৭) দ্বন্দ্ববাদের সমালোচনা: বিরুদ্ধবাদী চিন্তাবিদদের মতানুসারে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে যে দ্বন্দ্ববাদের কথা বলা হয় তাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। ইতিহাসের অবিরাম গতিধারায় ‘বাদ’, ‘প্রতিবাদ’ ও ‘সম্বাদ’ সম্পর্কিত মার্কসীয় ব্যাখ্যা সর্বাংশে সত্য নয় (“History proceeds as an unending stream of which no one knows the beginning or the end. It provides no terminus a quo and thus makes it impossible to determine which of its stages are thesis, antithesis or synthesis.”Karl Federn)। ইতিহাসের সূত্রের ব্যাখ্যা হিসাবে দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্বকে সর্বাংশে স্বীকার করে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ এইভাবে ইতিহাসের আদি, মধ্য, অস্ত সম্পর্কে অবহিত হওয়া দুরূহ ব্যাপার।

(৮) মানব সভ্যতার ইতিহাস বলতে শুধু প্রগতির ইতিহাসকে বোঝায় না। সভ্যতার ইতিহাসে অগ্রগতির মত অধোগতি বা অবক্ষয়ও অসম্ভব নয়। পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির প্রগতির পরিবর্তে পশ্চাদ্‌গতি ঘটেছে।

(৯) মার্কসীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোকে সাম্প্রতিককালের পুঁজিবাদী সমাজের চেহারা-চরিত্র ব্যাখ্যা করা যায় না। আধুনিককালে অনেক দেশেই মিশ্র অর্থনীতি অনুসরণ করা হয়। তাছাড়া এখনকার অধিকাংশ রাষ্ট্রব্যবস্থাই হল জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মাধ্যমে এসব যথাযথভাবে ব্যাখ্যা যায় না।

(১০) সমালোচকদের মতানুসারে সমাজ বিজ্ঞান প্রকৃতি বিজ্ঞানের মত অভিন্ন নিয়মের অধীন নয়। প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিয়ম একবারে নিখুঁত। সমাজ বিজ্ঞানের নিয়ম এ রকম নিখুঁত হতে পারে না। সমাজকে অর্থনীতির গতির নিয়ম নিয়ন্ত্রণ করে। এ কথা ঠিক। কিন্তু এই নিয়ম প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিয়মের মত নিখুঁত নয়।

(১১) কোলাকাউস্কির অভিমত: ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদে মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোলাকাউস্কি মানবসমাজের পরিবর্তন সম্পর্কিত এই ব্যাখ্যাকে স্বীকার করেননি। তিনি এই ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের সকল পরিবর্তনের ব্যাখ্যা হিসাবে মার্কসবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। আবার মানব সভ্যতার বিকাশ সংক্রান্ত মার্কসীয় শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্বও মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর মতানুসারে এই পৃথিবী গ্রহের বিভিন্ন অংশ যুগ যুগ ধরে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন অবস্থায় কাটিয়েছে। এই বিচ্ছিন্ন অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সারবত্তাকে স্বীকার করা যায় না।

(১২) সংস্কারের মাধ্যমেও পরিবর্তন সম্ভব: ঐতিহাসিক বস্তুবাদে সমাজের গুণগত পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের মতানুসারে সংস্কার ও বিবর্তনের মাধ্যমেও কাম্য পরিবর্তন ঘটে।

(১৩) উৎপাদন ব্যবস্থাই সমাজ-সভ্যতার একমাত্র নির্ধারক নয়: উৎপাদন ব্যবস্থা অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের সভ্যতা সৃষ্টি সম্ভব। মানব ইতিহাসে এমন নজির আছে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। হাণ্ট বলেছেন: “Historical materialism does not explain why peoples living under similar conditions of production have developed widely divergent civilisation.” অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থাই সমাজ ও সভ্যতার একমাত্র নির্ধারক নয়।

(১৪) সমালোচকদের অনেকের মতানুসারে ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় ইতিহাসের ভূমিকা হল মুখ্য এবং মানুষের ভূমিকা হল গৌণ। অর্থনীতির নিয়ম অনুসরণ করে ইতিহাস অনিবার্য পরিণতির দিকে এগোতে থাকে।

(১৫) সমালোচকরা মার্কসীয় ইতিহাস তত্ত্বকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেন না। এই ইতিহাস তত্ত্ব মানবসমাজের ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেনি। বিশেষ একটি শ্রেণীর সমর্থনে ইতিহাসের ধারাকে বিচার-বিবেচনা করা হয়েছে। ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা যে ভাবে মানবসমাজের ইতিহাসকে স্তরবিভক্ত করেছে, সমাজের ভবিষ্যৎ ও ইতিহাসের অনিবার্য গতির ইঙ্গিত দিয়েছে তাও বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।

মূল্যায়ন: মার্কসীয় দর্শনে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিরুদ্ধে বহু ও বিভিন্ন বিরূপ সমালোচনা বর্তমান। এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্র-চিন্তার ইতিহাসে এবং আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচিত হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(১) বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানবসমাজের বিবর্তনের ধারায় আর্থনীতিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভূমিকাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে অন্যান্য উপাদানের ভূমিকাকেও একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। এঙ্গেলসও পরবর্তী কালে একথা স্বীকার করেছেন। আর্থনীতিক বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামোর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপরি-কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন উপাদানের কথা মার্কসবাদে অস্বীকার করা হয়নি। আর্থনীতিক বিকাশের ভিত্তিতে রাজনীতিক, দার্শনিক, ধর্মগত, আইনগত বিকাশ ঘটে। তবে এগুলি পরস্পরকে এবং আর্থনীতিক বনিয়াদকে প্রভাবিত করে। মার্কসবাদে বনিয়াদ ও উপরি সৌধের তত্ত্বের মাধ্যমে আর্থনীতিক বনিয়াদের সঙ্গে সমাজের মতাদর্শ, ভাবধারা ও সংগঠনসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস বা তাঁদের পরবর্তী কালের মার্কসবাদী দার্শনিকরা সমাজের মতাদর্শ, ভাবধারা ও সংগঠনসমূহের গুরুত্বকে উপেক্ষা করেননি। সুতরাং মার্কসবাদকে আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ বা ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে নিয়তিবাদ বলা যায় না।

(২) মানবসমাজের ইতিহাসে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য, তাও অস্বীকার করা যায় না। এঙ্গেলসের মতানুসারে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব এই দু’টি বিরাট আবিষ্কারের জন্য মার্কসের কাছে আমরা ঋণী। এই আবিষ্কার দু’টির জন্য সমাজতন্ত্র হয়ে উঠেছে বিজ্ঞান।

(৩) লেনিনও বৈজ্ঞানিক চিন্তার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে এক বিরাট অগ্রগতি হিসাবে গণ্য করেছেন। অনেকের মতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদই হল রাষ্ট্র-চিন্তার ইতিহাসে মার্কসের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিরুদ্ধে সমালোচকদের বক্তব্যের অধিকাংশই ভিত্তিহীন এবং একদেশদর্শিতা দোষে দুষ্ট।

(৪) অনেকের দাবি হল মানবসমাজের একমাত্র বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বলতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে বোঝায়। মানবসমাজের বিকাশের মৌল সূত্রের সন্ধান ঐতিহাসিক বস্তুবাদ থেকেই পাওয়া যায়। সমাজের বিকাশ ঘটে বৈষয়িক উৎপাদন ও মানুষের সক্রিয় উদ্যোগ-আয়োজনের মাধ্যমে। এই সত্যের সন্ধান দিয়েছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। বিশ্বের ইতিহাস তথা মানবসভ্যতার ইতিহাসের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

(৫) ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মাধ্যমে মানবসমাজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সূত্রবদ্ধ করা হয়েছে। বৈষয়িক সূত্রের মাধ্যমে সমাজ বিকাশের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। 

(৬) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজবিকাশের ইতিহাসকে অধিবিদ্যামূলক ও ভাববাদী প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত করেছে। এবং মানব-সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে বৈষয়িক উপাদানের সঙ্গে মানুষের শ্রম ও সক্রিয় প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অবদান বাস্তবিকই বৈপ্লবিক।