প্রশ্নঃ ঐচ্ছিক ক্রিয়া, অনৈচ্ছিক ক্রিয়া ও ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়া ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ আমাদের চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, কোনাে জিনিসের একদিকে ভাল দিক দেখা গেলে তার অপর পাশে খারাপ বা মন্দ দিক প্রতীয়মান হয়। আবার কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ভাল মন্দের মাঝামাঝি অবস্থান করে থাকে। উক্ত দিকগুলােই ঐচ্ছিক, অনৈচ্ছিক বা ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়া।

ঐচ্ছিক ক্রিয়াঃ ঐচ্ছিক ক্রিয়া বলতে সাধারণত মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে বুঝায়। অপরার্থে ঐচ্ছিক ক্রিয়া বলতে আমরা এমন এক ক্রিয়াকে বুঝি যা কোনাে এক উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত বিচার বিশ্লেষণ করে কোনাে ব্যক্তির দ্বারা নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদিত হয়ে থাকে। ঐচ্ছিক ক্রিয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উইলিয়াম লিলি বলেছেন, ঐচ্ছিক ক্রিয়া এমন ক্রিয়া যা মানুষ ইচ্ছা করলে বিভিন্ন উপায় সম্পাদন করতে পারে।

অতএব, আমরা বলতে পারি ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মূলত ব্যক্তির স্বাধীনতা প্রাধান্য পায়, একটি নির্দিষ্ট আশা বা কামনা গােপন থাকে এবং নীতিবিদ্যাকে সমর্থন করে। ঐচ্ছিক ক্রিয়া ব্যাখ্যা করলে আমরা ৩টি স্তর লক্ষ্য করি। যথা-

প্রথমতঃ অভাব কামনা পরিকল্পনা যুক্তি বিচার বিবেচনা সিদ্ধান্ত ইত্যাদি। মানসিক স্তর। যা মানুষকে কোনাে জিনিস পাবার জন্য ব্যাকুল করে তােলে এবং উপায় নির্ধারণ করে দেয়।

দ্বিতীয়তঃ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আঙ্গিক ক্রিয়া ও পেশাগত সঞ্চালনের স্তর। যা মানুষকে উপায় খুঁজে বের করার পর তার অর্জন করার জন্য শারীরিক শক্তি কাজে লাগানাের উৎসাহ প্রদান করে ও অবশেষে কাম্যবস্তুটিকে লাভ করে।

তৃতীয়তঃ ফলাফলের আকারে পরিসমাপ্তি বা বাস্তবায়নের স্তর। এ স্তরে মানুষ কাম্যবস্তুকে পাবার ফলে তার চাহিদার পরিবর্তন হয় এবং মানসিক তৃপ্তি লাভ করে থাকে।

অনৈচ্ছিক ক্রিয়াঃ অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার সাথে ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়ার নীতিগত পাথর্ক তেমন পরিলক্ষিত হয় না। অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার পরিধি কিছুটা কম হলে ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়ার পরিধি একটু বেশি হয়। মূলত মানুষের অবচেতন মনের সাথে জড়িত থাকে। তাছাড়া অনৈচ্ছিক ক্রিয়া মূলত নীতিবিদ্যার আলােচ্য বিষয় নয়। যেকোনাে জিনিসের মন্দ দিকের আবির্ভাব হিসেবে অনৈচ্ছিক ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোনাে কামনা বা আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও কোনাে পূর্ব পরিকল্পনার স্থান নেই।

পরিশেষে বলা যায় যে, অনৈচ্ছিক ক্রিয়া এমন একটি ক্রিয়া যেখানে কোনাে ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা ছাড়া কোনাে উদ্দেশ্য বা চাহিদাকে পেতে অবচেতন মনে কোনাে কাজ সম্পাদন করে তাকে অনৈচ্ছিক ক্রিয়া বলে।

ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়াঃ যে ক্রিয়া মানুষের নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছা বা বিচার বিবেচনা ছাড়াই সংঘটিত হয়ে থাকে তাকে ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়া বলে। ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়া বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। নিচে তা আলােচনা করা হলাে-

(ক) স্বয়ঃক্রিয়া ক্রিয়াঃ স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়ার দৃষ্টান্ত মানবদেহের মধ্যে দেখা যায়। মানবদেহ বিভিন্ন অংশের মাধ্যমে গঠিত হয় এবং এগুলাে দেহের সুষ্ঠু অস্তিত্বের জন্য সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে থাকে। তাই দেহ সুষ্ঠুভাবে টিকে থাকতে হলে এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এসব ক্রিয়া অন্য কোনাে শক্তির পরিবর্তে স্বয়ং দেহের দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে বলে এগুলাে স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়া বিচার বিবেচনা বা নির্বাচনের দ্বারা সংঘটিত হয় না বলে এগুলাে ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়া।

(খ) স্বতঃস্ফুর্ত ক্রিয়াঃ বাহিরের কোনাে উদ্দীপনা ছাড়া দেহের ভিতরের শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের ফলে যে ক্রিয়ার উৎপত্তি ঘটে তাকে স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া বলে। স্বত্বঃস্ফূর্ত ক্রিয়া মানসিক দিক দিয়ে শুরু হয় না বলে এ জাতীয় ক্রিয়াকে ইচ্ছা নিরেপেক্ষ ক্রিয়া বলে।

প্রতিবর্ত ক্রিয়াঃ বাইরের কোনাে উদ্দীপক ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমাদের দেহের উপর ক্রিয়া করার ফলে আমাদের স্নায়ু উদ্দীপক হওয়ার জন্য যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে থাকে তাকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে। যেমন- কোনাে আগুনের কাছে গেলে আমাদের গা গরম অনুভূত হয় এটাই প্রতিবর্ত ক্রিয়া।

ভাবজ ক্রিয়াঃ আমাদের অজ্ঞাতসারে যখন কোনাে ভাব ক্রিয়ার পরিণত হয় তখন তাকে ভাবজ ক্রিয়া বলে। এ জাতীয় ক্রিয়া সরাচর কোনাে সহযােগিতা ছাড়াই বা কখনাে কখনাে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভাবের শক্তি দ্বারা দৈহিক সদ্ভোরন। অনুভূতি হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, যখন কোনাে ব্যক্তি অন্যের ম্যাচ দিয়ে সিগারেট জ্বালায় তখন সে অজ্ঞাতসারে নিজের পকেটে ম্যাচ রেখে দেয়।

সহজাত প্রবৃত্তিমূলক ক্রিয়াঃ কাজের কোনাে পূর্ব শিক্ষা ছাড়া এবং কাজের ফলাফল ছাড়া কোনাে ধারণা সম্পর্কে নিছক সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে কোনাে ফলাফল উৎপন্ন করার ক্রিয়াকে সহজাত প্রবৃত্তিমূলক ক্রিয়া বলে। সহজাত প্রবৃত্তিমূলক ক্রিয়াকে অশিক্ষালব্দ ক্রিয়াও বলে।

উপসংহারঃ উপােরােক্ত আলােচনার পরিশেষে বলা যায় যে, একটি নীতিমূলক বিদ্যার অংশ হিসেবে ঐচ্ছিক অনৈচ্ছিক বা ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়ার নৈতিক মূল্য বিচার করে। তাই বলতে হয় ঐচ্ছিক ক্রিয়ামূলক কাজ ভিত্তি হলেও নীতিবিদ্যার ঐচ্ছিক, অনৈচ্ছিক ও ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।