রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় নির্বাচন পদ্ধতি ছাড়াও ভোটদান পদ্ধতির উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ভোটদান পদ্ধতি সম্পর্কেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। ভোটদান পদ্ধতিকে সাধারণত নিম্নলিখিত তিনভাগে বিভক্ত করা হয়: 

  • (১) ঐচ্ছিক ও বাধ্যতামূলক ভোটদান পদ্ধতি (optional and compulsory voting), 

  • (২) প্রকাশ্য ও গোপন ভোটদান পদ্ধতি (open or public and secret voting) এবং 

  • (৩) একাধিক ভোটদান পদ্ধতি (plural or weighted voting)। 

(১) ঐচ্ছিক ভোটদান ও বাধ্যতামুলক ভোটদান পদ্ধতি:

বাধ্যতামূলক ভোটদান পদ্ধতি:

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ভোটদান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার তথা দায়িত্ব। এর সঠিক প্রয়োগ বা ব্যবহারের উপর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। নাগরিকদের মধ্যে নির্লিপ্ততা বা উদাসীনতা দেখা দিলে এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ না করলে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই কারণে ভোটদান বাধ্যতামূলক না ঐচ্ছিক হবে এ বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনার অবকাশ আছে। কোন কোন রাষ্ট্রে ভোটদান আইনত বাধ্যতামূলক। এই সকল রাষ্ট্রে নাগরিকরা ভোট না দিলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়। এবং এই অপরাধের জন্য অর্থদণ্ড বা কারাদণ্ড হতে পারে। সুইজারল্যাণ্ডের কতকগুলি ক্যান্টনে এবং বেলজিয়ামে ভোটদান বাধ্যতামূলক। তা ছাড়া কয়েকটি রাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক ভোটদানের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। এ প্রসঙ্গে স্পেন, আর্জেন্টিনা, রুমানিয়া, হল্যাণ্ড ও চেকোশ্লাভাকিয়ার নাম করা যায়।

ঐচ্ছিক ও বাধ্যতামূলক ভোটদানের সুবিধা:

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সুনাগরিক অপরিহার্য। এই সুনাগরিকতার পথে একটি বড় অন্তরায় হল নির্লিপ্ততা বা উদাসীনতা। ভোটদান আইনত বাধ্যতামূলক করলে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে জনগণের নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতা দূর হবে। সরকারী কাজকর্মে জনগণের আগ্রহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে। এবং জনগণের রাজনীতিক শিক্ষা ও চেতনার বিস্তার ঘটবে।

ঐচ্ছিক ও বাধ্যতামূলক ভোটদানের সাবধানতা:

বাধ্যতামূলক ভোটদান পদ্ধতিকে অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অন্ধভাবে সমর্থন করতে নারাজ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে জনগণের প্রতিক্রিয়া যাচাই করার পক্ষপাতী। এই পদ্ধতির মূল্যায়ন করার আগে দেখতে হবে যে, এই ভোট-পদ্ধতির প্রতি জনগণের কোন বিরূপ ধারণা আছে কিনা এবং জনগণ এই ব্যবস্থাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে কিনা। অর্থাৎ তাত্ত্বিক আলোচনার পরিবর্তে বাস্তব উপযোগিতা ও ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে এর মূল্য বিচার করতে হবে। 

ঐচ্ছিক ভোটদান পদ্ধতি:

অপরপক্ষে ভোটদান আইনত বাধ্যতামূলক না হলে তাকে ঐচ্ছিক ভোটদান‌ পদ্ধতি বলে। এ ক্ষেত্রে ভোটদানে বিরত থাকাটা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় না। তবে ভোটাধিকার প্রয়োগ না করাটা নাগরিক কর্তব্য পালনের ব্যর্থতা হিসাবে পরিগণিত হয়। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত প্রভৃতি অধিকাংশ দেশেই ঐচ্ছিক ভোটদান পদ্ধতি প্রচলিত আছে।

(২) প্রকাশ্য ভোটদান ও গোপন ভোটদান পদ্ধতি

প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি:

ভোটদান পদ্ধতি প্রকাশ্য বা গোপন হবে এ বিষয়েও রাষ্ট্রনীতিক ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ আছে। আগেকার দিনে নির্বাচকদের সংখ্যা ছিল অতিমাত্রায় সীমিত। এ ছাড়া অন্যান্য কারণেও তখন প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। ইংল্যাণ্ডে ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। জারতন্ত্রের অধীন রাশিয়ায়, ১৯০১ সাল পর্যন্ত ডেনমার্কে এবং ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রাশিয়ায় এ ধরনের ভোটদান পদ্ধতি প্রবর্তিত ছিল। প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতির সমর্থকদের মধ্যে মন্টেস্কু, জে. এস. মিল, ট্রিটকে প্রমুখ বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ভোটদান পদ্ধতির পক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তিসমূহের অবতারণা করা হয়।

(ক) জনস্বার্থের অনুপন্থী ও গণতন্ত্রসম্মত: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ভোট দেওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র একটি অধিকার নয়, এ হল জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কিত একটি গুরুদায়িত্বও বটে। অতএব সর্বসাধারণের স্বার্থ-জড়িত দায়িত্ব প্রকাশ্যে পালন করা দরকার। মিলের মতানুসারে জনগণের সাধারণ স্বার্থ সংক্রান্ত অন্যান্য দায়িত্বের মত ভোটদানের দায়িত্ব জনসমক্ষে সম্পাদন করা উচিত। তিনি বলেছেন: “The duty of voting, like any other public duty should be performed under the eye and criticism of the public.” গোপনে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকলে চক্ষুলজ্জা, সমালোচনা বা জনসাধারণের প্রতি দায়িত্ববোধ প্রভৃতি অর্থহীন হয়ে পড়ে। নির্বাচকরা গোপন ভোটের মাধ্যমে ব্যক্তি স্বার্থ ও শ্রেণী-স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ভোটাধিকারের অপপ্রয়োগ করতে পারে। তার ফলে দেশ ও দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতিতে এই আশংকা নেই। সুতরাং প্রকাশ্য ভোটদানই গণতন্ত্রসম্মত।

(খ) দুর্নীতিমুক্ত: প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি হল দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা। গোপন ভোটে নির্বাচকগণ কোন প্রার্থীর পক্ষে উৎকোচ গ্রহণ ও অন্যান্য দুর্নীতিমূলক আচরণের সুযোগ পান। প্রকাশ্য ভোটদান জনসমক্ষে সম্পাদিত হয়। তাই এই ব্যবস্থায় অসাধু উপায় অবলম্বনের সুযোগ থাকে না। তখন নির্বাচকগণ বিবেকবুদ্ধি অনুসারে যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন। তারফলে গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় থাকে। 

(গ) রাজনীতিক সচেতনতা বৃদ্ধি: প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি নির্বাচকদের অধিকতর দায়িত্বশীল ও রাজনীতি সচেতন করে তোলে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নীতি, মতাদর্শ, কর্মসূচী প্রভৃতি প্রকাশ্যে বিচার-বিবেচনা করে ভোট দিতে হয়। তারফলে ভোটদাতাদের রাজনীতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। মন্টেস্কু এই অভিমত পোষণ করেন। 

সমালোচনা: প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতির সমালোচনাও করা হয়। এই পদ্ধতিতে জনসমক্ষে ভোট দেওয়া হয়। তার ফলে ভোটদাতাদের মধ্যে কে, কাকে ভোট দিচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এবং তাদের সমর্থকরা তা সহজেই বুঝতে পারেন। এর ফলাফল ভাল হয় না। কারণ নির্বাচনের পর ভোটদাতাদের প্রতিহিংসামূলক অত্যাচার-উৎপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় অত্যাচারের আশংকায় ও ভয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে ভোটদাতারা বাধ্য হন।

গোপন ভোটদান পদ্ধতি:

বর্তমানে গোপন ব্যালটে ভোটদান হল সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি। এখন পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আপ্পাডোরাই মন্তব্য করেছেন : “Vote by ballot (or some form of secret voting) is now the universal practice.” গোপন ভোটদান পদ্ধতির এই ব্যাপক স্বীকৃতির পিছনে কতকগুলি কারণ বর্তমান। (১) এখন সকল রাষ্ট্রেই নির্বাচকদের সংখ্যা অতিমাত্রায় বেশী। এই অবস্থায় প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতির প্রয়োগ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই এই পদ্ধতি উপযোগিতা হারিয়ে অচল হয়ে পড়েছে। (২) প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি প্রচলিত থাকলে শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজে ভোটদাতারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে না। কারণ এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় অর্থনীতিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শ্রেণীই উৎকোচ প্রদান, ভীতি প্রদর্শন প্রভৃতি যে-কোন উপায়ে নির্বাচনী ফলাফলকে শ্রেণী-স্বার্থের অনুকূলে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হয়। যে-কোন উপায়ে এই শ্রেণীর প্রার্থীরা নির্বাচিত হওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করে। এই অবস্থায় ভোটদান প্রকাশ্যে হলে ভোটদাতারা ইচ্ছামত ও বিবেকবুদ্ধি অনুসারে ভোট দিতে পারে না। প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর অযোগ্য প্রার্থীরাই নির্বাচিত হন। এই অবস্থায় গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ স্বাধীন, দুর্নীতিমুক্ত ও অবাধ নির্বাচন হল প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় প্রকাশ্যে স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচন অসম্ভব। এই কারণে বর্তমানে গোপন ভোটদান পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে।

(৩) একাধিক ভোটদান পদ্ধতি:

কিছু বিশেষ গুণ বা যোগ্যতার বিচারে কোন ব্যক্তিকে একাধিক ভোটদানের অধিকার দেওয়া হলে তাকে একাধিক ভোটদান পদ্ধতি (Plural or Weighted Voting System) বলে। অর্থাৎ এই ভোটদান পদ্ধতিতে কয়েকটি বিশেষ গুণ বা যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তিবর্গ একাধিক ভোট প্রদানের সুযোগ পান। আগেকার দিনে নাগরিকদের একটি বিশেষ অংশকে একাধিক ভোটাধিকার বা বিশেষ গুরুত্ব আরোপের মাধ্যমে ভোটদানের সুযোগ দেওয়া হত। অতীতে জার্মানী, বেলজিয়াম, ইংল্যাণ্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রে একাধিক ভোটদান পদ্ধতি প্রবর্তিত ছিল। জার্মানীর কয়েকটি রাজ্যে প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধের আগে একাধিক ভোটদান পদ্ধতি বর্তমান ছিল। বেলজিয়ামের ১৯৮৩ সালের সংবিধানে এ ধরনের ভোটদান পদ্ধতির কথা বলা হয়। এই সংবিধান অনুসারে যে ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দেন বা নির্দিষ্ট মূল্যের সম্পত্তির অধিকারী তিনি অতিরিক্ত একটি ভোট এবং উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সরকারী পদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাযুক্ত ব্যক্তি অতিরিক্ত দু’টি ভোট দিতে পারতেন। 

একাধিক ভোটদান পদ্ধতির স্বপক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তিসমূহের অবতারণা হয়ে থাকে।

(ক) বিশেষ যোগ্যতার স্বীকৃতি: শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচক্ষণতা প্রভৃতি দিক থেকে সমাজে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকেন। সমাজের অন্যান্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে এঁদের গুণগত যোগ্যতার উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকে। প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে এঁদের যোগ্যতা অনেক বেশী। দক্ষতা ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতিস্বরূপ ভোটদাতাদের এই অংশকে অধিক ভোট প্রদানের অধিকার দেওয়া যুক্তিযুক্ত।

(খ) সিজউইকের মত: সিজউইক (Sidgewick) -এর মতানুসারে একাধিক ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের প্রকৃতিগত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি দূর করা সম্ভব। তাঁর আরও অভিমত হল যে, অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও রাজনীতিক চেতনাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদাতাদের মতামতের থেকে বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটদাতাদের মতামত অধিক মূল্যবান।

(গ) মিলের মত: জে. এস. মিলও একাধিক ভোটদান পদ্ধতিকে সমর্থন করেছেন। তাঁর মতানুসারে একাধিক ভোটদান পদ্ধতির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত নির্বাচকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাঁর কথায় এই ব্যবস্থা হল “Counterpoise to the numerical weight of the least educated.”

(ঘ) সম্পত্তির যুক্তি: একাধিক ভোটদান পদ্ধতির পক্ষে সম্পত্তির যুক্তিও দেখান হয়। সিজউইকের মতানুসারে বিহীন দরিদ্র ব্যক্তিদের তুলনায় সম্পদশালী ব্যক্তিগণ আত্মসংরক্ষণে অধিক উদ্যোগী। স্বার্থসংরক্ষণের জন্য এঁদের একাধিক ভোটদানের অধিকার দেওয়া যুক্তিসঙ্গত। তা না হলে সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্পত্তিবান ও অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থ বিপন্ন হবে। কারণ আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পত্তিহীন দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

অতীতে এক সময়ে ইউরোপের কিছু দেশে একাধিক ভোটদান পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের এই ভোটদান পদ্ধতি এখন অবলুপ্ত। বর্তমানে জার্মানী, বেলজিয়াম প্রভৃতি সকল দেশেই এই পদ্ধতিকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। একাধিক ভোটদান পদ্ধতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তি দেখান হয়।

(1) অগণতান্ত্রিক: একাধিক ভোটদান পদ্ধতি অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রে সাম্য ও সমানাধিকারের কথা বলা হয়। তা ছাড়া একজন ব্যক্তির একটি ভোট’—এই নীতি অনুসারে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার প্রবর্তিত হয়েছে। একাধিক ভোটদান পদ্ধতিতে বিশেষ ব্যক্তিকে বিশেষ অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শের বিরোধী।

(২) সম্পত্তি সংরক্ষণের যুক্তি ঠিক নয়: সম্পত্তিবানদের স্বার্থসংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মুষ্টিমেয় বিত্তবান ব্যক্তিকে একাধিক ভোটাধিকার প্রদানের ব্যবস্থা অযৌক্তিক। এই ব্যবস্থা শ্রেণীবৈষম্যকে সমর্থন ও সংরক্ষণ করে। এর ফলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্পদশালী মানুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এই শ্রেণীর হাতে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা ন্যস্ত হবে। এই কারণে এই ভোটদান পদ্ধতি শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়, সমাজতান্ত্রিক আদর্শেরও বিরোধী।

(৩) পুঁজিবাদী ব্যবস্থা: সম্পত্তির ভিত্তিতে একাধিক ভোটাধিকার প্রদান অসঙ্গত। সম্পত্তিবান ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের উপর শোষণ-বঞ্চনা কায়েম করেই সম্পদশালী হয়েছেন। এঁদের ভোটের ব্যাপারে বিশেষাধিকার দেওয়ার অর্থ হল শোষণ বঞ্চনাকে সমর্থন করা। অর্থাৎ একাধিক ভোটদান পদ্ধতি পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের পরিপোষক। সুতরাং এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করা অন্যায়।

(৪) শিক্ষার যুক্তিও অসার: শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে একাধিক ভোট প্রদানের নীতি সমর্থন করা যায় না। কারণ স্কুল-কলেজের কেতাবী শিক্ষার উপর রাজনীতিক সচেতনতা খুব বেশী নির্ভরশীল নয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা অশিক্ষিতদের থেকে অধিক রাজনীতি-সচেতন ও বিচক্ষণ তা জোর দিয়ে বলা যায় না। প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের থেকে বাস্তব জগতে পোড়খাওয়া তথাকথিত অশিক্ষিত ব্যক্তিরা রাজনীতিক ক্ষেত্রে অধিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। সাধারণ মানুষ জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজনীতিক ক্ষেত্রে অনেক বেশী সচেতন ও সক্রিয়।

(৫) পরস্পর বিরোধিতা: একাধিক ভোটদান পদ্ধতির যুক্তির ফাঁক ও পরস্পর বিরোধিতা আছে। ভোটদানের এই পদ্ধতি অনুসারে ভোটদাতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অযোগ্য। এই অযোগ্যতার কুফল দুর করা দরকার। তা হলে ভোটদাতাদের এই অংশের ভোটাধিকার অস্বীকার করলেই হত। কিন্তু তা না করে। মুষ্টিমেয় কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষাধিকার দেওয়া হয়েছে। সুতরাং উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা আছে। 

উপরিউক্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য বর্তমানে একাধিক ভোটদান পদ্ধতিকে আর স্বীকার করা হয় না। আধুনিক‌সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই ভোটদান পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়েছে।