প্রশ্নঃ এ.জি ফ্রাংকের নির্ভরশীলতা তত্ত্বটি বর্ণনা কর।

অথবা, এ.জি ফ্রাংকের নির্ভরশীলতা তত্ত্বটি আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সমাজবিজ্ঞানের আলােচনায় একটি গুরুত্বপুর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী নির্ভরশীলতা তত্ত্বকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মূলত নৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্ভরশীলতা বলতে বুঝায় পৃথিবীর এক রাষ্ট্রের ওপর অন্য রাষ্ট্রের নির্ভরতা; সহজ কথায় উন্নত রাষ্ট্রগুলাের ওপর অনুন্নত রাষ্ট্রগুলাের নির্ভরশীলতা। যে সকল সমাজবিজ্ঞানী নির্ভরশীলতা তত্ত্ব প্রদান করেছেন তাদের মধ্যে এ.জি. ফ্রাংকের তত্ত্ব অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।

এ.জি, ফ্রাংকের নির্ভরশীলতা তত্ত্বঃ ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় ফ্রাংকের বিখ্যাত পুস্তক “Capitalism and Under Development in Latin America.” এ পুস্তকে ফ্রাঙ্ক তার নির্ভরশীলতা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। ফ্রাঙ্কের নির্ভরশীলতা তত্ত্বের উল্লেখযােগ্য দিকগুলাে হলাে-

(১) বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দু’ধরনের রাষ্ট্র বিদ্যমান। ক. মেট্রোপলিটন; খ. স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলাে মেট্রোপলিটন রাষ্ট্রগুলাের ওপর নির্ভরশীল থাকে।

(২) স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলাে স্বাধীনভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে পারে না।

(৩) স্যাটেলাইট রাষ্ট্রসমূহের সামাজিক পরিবর্তন মেট্রোপলিটন রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়।

(৪) স্যাটেলাইট রাষ্ট্রসমূহ হলাে কাঁচামাল রপ্তানিকারী ও শিল্পজাত পণ্য আমদানিকারী।

(৫) মেট্রোপলিটন রাষ্ট্রগুলাে হলাে কাঁচামাল আমদানিকারী ও শিল্পজাত পণ্য রপ্তানিকারী।

(৬) জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত এমন রাষ্ট্রসমূহে ব্যাপক জনগােষ্ঠীর অংশগ্রহণ না হলে সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব হয়।

(৭) পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত IMF ও World Bank থেকে ঋণ নিয়েও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়।

(৮) স্ব-অর্থনীতিসম্পন্ন দেশগুলাে দ্বারা সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব।

(৯) আশ্রিত রাজ্যগুলাে স্বাধীন হলেও প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা লাভ করতে পারে না।

সমালােচনাঃ নির্ভরশীলতা ব্যাখ্যাদানে এ.জি, ফ্রাঙ্কের তত্ত্ব অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এ তত্ত্বের কিছু সমালােচনাও আছে। ফ্রাঙ্কের নির্ভরশীলতা তত্ত্বের উল্লেখযােগ্য সমালোচনার দিকগুলাে হলাে-

(১) ফ্রাঙ্কের সমালােচনা করে বিল ওয়ারেন বলেন, ফ্রাঙ্কের দাবি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এসব দেশের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আসার অর্থ হলাে ক্রমাগত অনন্নোয়ন। কিন্তু বিল ওয়ারেন দেখান, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে দ্রুতগতিতে শিল্পায়ণ ঘটছে ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে।

(২) ফ্রাঙ্ক বলেছেন, কেবলমাত্র কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু বডিনেইমার দেখিয়েছেন, কৃষি বিপ্লবের অবস্থা তৃতীয় বিশ্বে এখনও তৈরি হয়নি।

(৩) পিটার ইভান্স দেখিয়েছেন, ফ্রাংক অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তৃতীয় বিশ্বের কয়েকটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে দ্রুততম।

(৪) নরম্যান বলেছেন, ফ্রাঙ্কের দুর্বলতা হলাে শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্যের ওপর যথাযথ গুরুত্ব না দেয়া। তার মতে বর্তমান বিশ্বে মেট্রোপলিস স্যাটেলাইট স্টেট ব্যবস্থার বাস্তবতা কমে এসেছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রগুলাের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্ভাবনা পর্যালােচনায় এ. জি. ফ্রাঙ্কের নির্ভরশীলতা তত্ত্ব যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদিও এ তত্ত্বের অনেক সমালােচনা রয়েছে, তবুও এ তত্ত্বের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলাের পারস্পরিক সম্পর্ক ও একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। ‘মেট্রোপলিস-স্যাটেলাইট স্টেট’ ধরনের রাষ্ট্রের মাধ্যমে যার বাস্তবতা আমরা বর্তমান বিশ্বে দেখতে পাই।