আলোচ্য পদটি বিদ্যাপতি কর্তৃক ব্রজবুলি ভাষায় রচিত ‘মাথুর’ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। বৈষ্ণব রস-শাস্ত্রে বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের চারটি বিভাগের ‘প্রবাস’ হল অন্যতম। বৈষ্ণব পদাবলীতে শুধু নায়কের প্রবাস গমনই বর্ণিত হয়েছে। পূর্বে মিলিত নায়ক-নায়িকার মধ্যে কেউ যদি দেশান্তরে গমন করেন তখন তাকে বলে প্রবাস। শ্রীরূপ গোস্বামী ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থে প্রবাসের সংজ্ঞা জানিয়েছেন-
“পূর্বসঙ্গতয়োয়ুনো ভবন্দোশান্তরাদিভিঃ।
ব্যবধানস্ত যৎ প্রাজ্ঞৈঃস প্রবাস ইতীর্যতে।।”
অর্থাৎ পূর্বে সম্মিলিত নায়ক নায়িকার মধ্যে দেশান্তরাদির যে ব্যবধান তাকে প্রাজ্ঞাগণ ‘প্রবাস’ নামে অভিহিত করেছেন।
বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে যাকে বলা হয় ‘প্রবাস’, বস্তুত বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে তাকেই মাথুর নামে অভিহিত করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের মথুরাগমন এবং দীর্ঘকালের জন্য তাঁর অদর্শন শ্রীমতী রাধিকা এবং কৃষ্ণপ্রাণা গোপীদের অন্তরে যে সন্তাপ জ্বালা সৃষ্টি করেছে, তাকেই কবিরা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন এবং ‘মাথুর’ পর্যায়ে স্থান দিয়েছেন। এই পর্যায়ের একমাত্র রস করুণ তথা ‘বিরহ’। জীবন কখনো মিলনে কখনো আনন্দে মধুর কখনো বা বিরহে বিষণ্ণ। জীবনে মিলন, বিরহ সব থাকে তবুও মনে হয়, মিলন যেন মেলেনি। বিরহ যেন চির বিরাজমান। আসলে মিলন বিরহের মধ্যে ‘বিরহ’ই অধিকতর শ্রেষ্ঠ। যে প্রেমে বিরহ নেই, যে প্রেমে আঘাত নেই, সেই প্রেম ব্যর্থ ও অগভীর। তাই ভক্ত কবিরা বলেছেন—“বিরহভিন্ন দেহ যে শূন্য। বিরহ তো দেহের রাজা। যে ঘটে এই বিরহ সঞ্চারিত হয় না সেই ঘট শ্মশানের মত।” কৃপ্রেমের স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ কাব্যগ্রন্থে বলেছেন—
“এই প্রেম আস্বাদন তপ্ত ইক্ষু চর্বন
জীব জল না যায় তর্জন।”
প্রাথমিক বিশ্লেষণে বিরহ মূলত ভিন্ন প্রকারের, ভাবী, ভবন ও ভূত। কৃষ্ণকে অঙ্কুর মথুরায় নিয়ে যাবে, সে সন্দেহে ব্রজবাসীর মধ্যে আসন্ন যে বিরহ জেগেছিল তাই ভাবী বিরহ। কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেছে এই নিদারুণ দৃশ্যে ব্রজকুল বিরহে কাতর হয়ে পড়লে সৃষ্টি হয় ভবন বিরহের। আর মথুরা থেকে কৃষ্ণ কোনদিনই বৃন্দাবনে ফিরবেন না এমন এক শোকাবহ পরিস্থিতিতে যে বিরহের উদ্ভব হয় তা হল ভূত বিরহ। বৈষ্ণব পদাবলীতে এই ভূত বিরহ মাথুর নামে অভিহিত।
শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে মথুরায় অক্রুর চলে এসেছে ঘরে ঘরে তারই অনর্গল বার্তা সূচিত হয়েছে। কিন্তু শ্রীরাধা বিশ্বাস করেন না। রাধার ধারণা, শ্যামতো অন্তর মন্দিরে অনুরাগের তুলিকা শয্যায় নিদ্রিত। কোন পথ দিয়ে সে পালাবে—
“এই বুক চিরিয়া বাহির করিব গো
তবে তো শ্যাম মধুপুরে যাবে।”
রাধার এ বিশ্বাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কৃষ্ণ সত্যই চলে গেছে মথুরায়। পিছনে পড়ে আছে সাজানো কুঞ্জবন, ব্রজবাসী, গোপ-গোপিনী আর বিরহিণী রাধিকা। অতল হৃদয় বেদনা বিমথিত নিশি জাগরণের পালা চললো রাধার, ফলে—
“শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী।
শূন ভেল দশ দিশ শূন ভেল সগরী।”
শূন্যতার এই বেদনায় পরিপ্লাবিত বিরহিণী রাধিকার হৃদয় বেদনাই মাথুর পালা। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে প্রিয় আজ কতো দূরে। রাধিকার অন্তর বিদীর্ণ করে ফুটে ওঠে আত্মক্রন্দন—
“আন অনুরাগে প্রিয়া আন দেশে গেলা।
পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঁজর ভেলা।
তবে প্রিয় তাকে ভুলতে পারলেও রাধিকা কি করে ভুলবে। নব যৌবনের বেদনা উচ্ছ্বসিত দিনগুলো একে একে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এরপরে প্রিয়–সমাগমের মূল্য কি আছে?
অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব
কি করব বারিদ মেহে।
এ নব যৌবন বিরহে গোঙায়লু
কি করব সে পিয়া লেহে।।
বর্ষণ মুখর রাত্রিতে রাধিকার এই বেদনা আরও উচ্চকিত হয়ে ওঠে। ভরা ভাদ্র ঘন ঘন বাজ পড়ছে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ঝরছে তারমধ্যে শূন্য ঘরে একাকিনী রাধিকা যামিনী জাগছে। এ দুঃখের কথা কাউকে তো বলা যায় না। তবুও সখীকে বলেছে—
“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
এখানে যেন রাধার বিরহ ব্যথা বিশ্ব ব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে। আর অন্যদিকে প্রকাশ পাচ্ছে ভালোবাসার রূপ ঐশ্বর্যের উচ্ছ্বসিত ঘোষণা। ব্যর্থ যৌবন বেদনা বহন করতে করতে প্রতীক্ষার কাল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। প্রিয়সঙ্গবতিা রাধা জীবনের আশা ত্যাগ করল। রাধার এ মরণ কামনা তো প্রেমের জন্যেই। এখানেই মাথুরলীলার পদগুলি শত নিনাদে ঝংকৃত হয়েছে।
মাথুর পর্যায়ের অন্যান্য পদকর্তাগণ যথেষ্ট প্রতিভার সাক্ষ্য রাখতে সচেষ্ট হলেও বিদ্যাপতি এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। মাথুর বা বিরহের পদে তিনি রাধাকে নতুন আলোকে উপস্থাপিত করেছেন। দেহের লীলা—বৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে শৃঙ্গার রসের তিনি অদ্ভুত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। কৈশোর, যৌবন, বয়ঃসন্ধি সকল পর্যায়ের পদে রাধা রোমাণি টক সৌন্দর্য বর্ণিত। মাথুরে বাঁধা মাটির পৃথিবীতে নেমে এসেছেন। মাথুরের পদে রাধা প্রকৃত যৌবন বিদীর্ণ করে এক নব চেতনায় উপনীত হয়েছেন। দুঃখ বেদনা আশা নৈরাশ্যের টানাপোড়েনে রাধার প্রণয় থেমে থাকেনি। নায়ক-নায়িকার দেহ সম্ভোগের প্রতি কৌতূহল এবং প্রলাপ, নায়িকার পরিপূর্ণ প্রেমার্তি মিলে মিশে যে শিল্প-রস সৃষ্টি করেছে তা রসিক পাঠকের আদরের সামগ্রী। অবশেষে রাধা কৃষ্ণের প্রতি বিতৃস্থ হয়ে উঠেছেন—
‘যৌবন রূপ আছল দিন চারি।
সে দেখি আদর বা এল মুরারি।।’
এখানেই কাব্য সৌন্দর্যের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে।
একথায় বৈষ্ণুব পদাবলী মূলত বিরহের গীতি আলেখ্য। পূর্বরাগ থেকে মাথুর পর্যায়ে তা ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। এই বেদনার অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে এমনকি মিলন লগ্নেও বিচ্ছেদের আশাঙ্কা ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। এই বেদনা ছিল বলেই তো পদাবলী সাহিত্য এত মধুর,-“our sweetest songs are those that tell of saddest thought.”
Leave a comment