প্রশ্নঃ ‘এরিস্টটল তার রাষ্ট্রচিন্তার সর্বত্র একটি ভারসাম্য সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন’ – তুমি কী এর সাথে একমত? তােমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।

অথবা, ‘এরিস্টটল রাষ্ট্রচিন্তার একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন’- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যেসকল দার্শনিক তাদের দর্শনচিন্তা দ্বারা মানবজীবন ও জাতিকে গভীরভারে আলােড়িত করেছেন, তাদের মধ্যে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রাচীন যুগের হয়েও চিন্তা-চেতনায়, মননে ও পাণ্ডিত্যে তিনি ছিলেন সহস্র বছর অগ্রগামী এবং ভবিষ্যৎপ্রজন্মের দিকনির্দেশক। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী চিন্তাবিদ। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, আদর্শ রাষ্ট্র, বাস্তবভিত্তিক রাষ্ট্র, সংবিধান ও সরকারের শ্রেণীবিভাগ, বিপ্লব ও এর কারণ, আইনের শাসন, আইনের সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি প্রত্যয় বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এরিস্টটল গভীর অন্তর্দৃষ্টিসহ সমকালীন অবস্থার ওপর নির্ভর করেছেন। ফলে তার রাষ্ট্রচিন্তায় শুধু হেলেনিক উপাদানসমূহের প্রভাবই নয়, পরবর্তীকালের রাষ্ট্রচিন্তায়ও এরিস্টটলের গভীর প্রভাব প্রতিফলিত হয়।

এরিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তাঃ এরিস্টটল ১৫৮টি দেশের সংবিধান বা শাসনব্যবস্থা পর্যালােচনা করে তার The Politics রচনা করেন এবং এতে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রদান করেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণ আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করা। আর সেজন্যই তিনি মধ্যবিত্তদের শাসনব্যবস্থায় আইনের শাসনের মাধ্যমে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা প্রদান করেছেন। তার রাষ্ট্রচিন্তার মৌলিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তিনি সর্বত্র মধ্যপন্থা অবলম্বন করার মাধ্যমে একটি ভারসাম্য সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন। নিম্নে এ বিষয়ে আলােচনা করা হলাে-

পরিবার তত্ত্বঃ এরিস্টটল তার The Politics গ্রন্থের প্রথম ভাগে পরিবার ও তৎসম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা আলােচনা করেছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি পরিবার কীভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সেটিও দেখিয়েছেন। তার মতে, রাষ্ট্র মানুষের প্রাথমিক সংঘ তথা পরিবার হতে উদ্ভূত এক প্রতিষ্ঠান। আর এ কারণেই রাষ্ট্র সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে হলে পরিবার সম্পর্কে ভালােভাবে জানতে হবে। এরিস্টটল পরিবারকে কেবল জৈবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমিত রাখেননি। তিনি পরিবারকে মানবিক গুণাবলী ও সুকুমার বৃত্তিসমূহের উৎকর্ষ অর্জনের এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যঃ এরিস্টটল তার The Politics গ্রন্থের প্রথম ভাগে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তিনি মনে করেন যে, নিতান্ত প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। রাষ্ট্রকে তিনি স্বাভাবিকভাবে উদ্ভুত এক মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন।

সরকার বা সংবিধানের শ্রেণীবিভাগঃ এরিস্টটল সর্বপ্রথম তার The Politics-এ সরকারের শ্রেণীবিভাগ করেছেন। তিনি দু’টো নীতির ওপর ভিত্তি করে এই শ্রেণীবিভাগ করেছেন। তা হলাে- শাসকের সংখ্যা ও শাসকের গুণ। আবার শাসকের গুণগত মান অনুসারে সরকারকে দু’ভাবে ভাগ করেছেন। যেমন- স্বাভাবিক রূপ ও বিকৃত রূপ।

আদর্শ রাষ্ট্রঃ এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলাে-

(১) রাষ্ট্রের অধিবাসীর সংখ্যা এরূপ হতে হবে যাতে তা আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যার সৃষ্টি না করে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রয়ােজন মেটাতে পারে।

(২) রাষ্ট্রীয় ভূ খণ্ডের আয়তন হবে মাঝারি ধরনের- না খুব বড়, না খুব ছােট।

(৩) ভৌগােলিক অবস্থানের দিক দিয়ে রাষ্ট্র হবে সমুদ্রকূল সংলগ্ন। যাতে সামরিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সরবরাহের সুবিধা হবে।

(৪) সর্বোত্তম রাষ্ট্রের নাগরিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে মিশ্র প্রকৃতির। বলবিক্রম ও ধী-নৈপুণ্যের গুণে-গুণান্বিত মানুষই হবে এই রাষ্ট্রের নাগরিক।

(৫) সমাজকাঠামাের মধ্যে দুই শ্রেণীর লােক থাকবে- অবিচ্ছেদ্য অংশ ও সহায়ক সদস্য। প্রথমশ্রেণীর লােকেরাই হচ্ছে রাষ্ট্রের পূর্ণ নাগরিক।

এ ছাড়া তিনি বিবাহ ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন।

নিয়মতান্ত্রিক সরকার ও আইনের শাসনঃ এরিস্টটল তার আদর্শ রাষ্ট্রের আলােচনায় কোনাে ব্যক্তি বা ব্যক্তিমণ্ডলীকে গুরুত্ব দেয়ার পরিবর্তে আইনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে একজন শাসক ব্যক্তি হিসেবে যতই জ্ঞানী বা গুণী হােক না কেন আইনকে বাদ দিয়ে তার পক্ষে শাসন করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, আইনের সার্বভৌমত্ব ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক শাসন প্রয়ােগ করা সম্ভবপর নয়। | বিপ্লব সম্পর্কে এরিস্টটল তিনি বিপ্লবের কিছু কারণ নির্দেশ করেছেন। যেমন-

(১) মনস্তাত্ত্বিক অসন্তোষ বিপ্লবের সর্বপ্রথম ও প্রধান কারণ। অবিচারবােধ থেকেই মনস্তাত্ত্বিক অসন্তোষের সৃষ্টি।

(২) মুনাফা ও সম্পদ লাভের আকাক্ষাও বিপ্লবের আরেকটি কারণ। ক্ষমতাসীনরা যখন সম্মান ও মুনাফা অর্জন করতে থাকে তখন ক্ষমতার বাইরের সবাই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং বিপ্লবের সূচনা করে।

(৩) শাসকশ্রেণী যখন উদ্ধত ভাব দেখায় এবং ব্যক্তিগত সযােগ লাভের চেষ্টা করে তখন অন্যরা বিপ্লব ঘটাতে উৎসাহী হয়।

(৪) শাসকবর্গের চক্রান্তের কারণেও বিপ্লব ঘটতে পারে।

(৫) অসমভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়ােগের ফলেও বিপ্লব ঘটাতে পারে।

নাগরিকতা সম্পর্কে এরিস্টটলঃ এরিস্টটল বলেন, একটি রাষ্ট্রে কেবল বসবাস করা জনগ্রহণ করা বা বৈধ অধিকার ভােগ করা- এগুলাের কোনােটিই নাগরিক তথা নাগরিকতার যথার্থ অর্থ প্রদান করে না। তিনি মূলত গ্রিক নগররাষ্ট্রের আদর্শকে সামনে রেখে নাগরিকের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মতে, নাগরিক সেই ব্যক্তি যে বিচারসংক্রান্ত কাজে এবং শাসনসংস্থার সদস্য হিসেবে আইনসংক্রান্ত কাজে এবং রাষ্ট্রীয় সভার আলােচনায় অংশগ্রহণ করে।

দাসতত্ত্ব সম্পর্কে এরিস্টটলঃ এরিস্টটলের মতে, পরিবার তথা গার্হস্থ্য অর্থনীতির বেশ কিছু উপকরণের প্রয়ােজন। প্রতিটি শিল্পকলার জন্য যেমন উপযুক্ত উপকরণের প্রয়ােজন হয়, ঠিক তেমনি গার্হস্থ্য অর্থনীতির জন্য কিছুসংখ্যক উপকরণের প্রয়ােজন রয়েছে। এই সকল উপকরণ যন্ত্রসদৃশ। তিনি দু’ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন অজৈব যন্ত্রপাতি যেমন- খাদ্য, পােশাক-পরিচ্ছদ, সম্পদ ইত্যাদি এবং জৈব যন্ত্রপাতি যেমন গৃহপালিত পশু, দাস ইত্যাদি। আর এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি দাসকে তার প্রভুর জীবন্ত সম্পদ এবং কর্ম সম্পাদনের হাতিয়ার বলে উল্লেখ করেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে,রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এরিস্টটল যে সকল তত্ত্ব প্রদান করেছেন সেগুলাের গ্রহণযােগ্যতা বর্তমান রাষ্ট্রচিন্তায়ও যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। কারণ তিনি মূলত তার সব তত্ত্বেই মধ্যপন্থা অবলম্বন করে একটি শান্তিপূর্ণ আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে একটি সহনশীল ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন।